শনিবার, ২৯ জুলাই, ২০১৭

" মুফতি-এ-আযম আমীমুল ইহসান বারকাতী রহ: " এর জীবন ও কর্ম


" মুফতি-এ-আযম আমীমুল ইহসান বারকাতী রহ: "



উপমহাদেশের যে কয়েকজন আলেমে দ্বীন তাদের সুতীè মেধায়, নিরলস অধ্যবসায় ও সুউচ্চ যোগ্যতার মাধ্যমে ইসলামের প্রাণকেন্দ্র আরব জগতকেও মুগ্ধ করতে সম হয়েছিলেন, তাদের মধ্যে অন্যতম ব্যক্তিত্ব ছিলেন বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদের সর্বপ্রথম খতিব (১৯৬৪-১৯৭৪) মুফতি সাইয়্যেদ মুহাম্মাদ আমীমুল ইহসান বারকাতী রহ:। তিনি ছিলেন একাধারে মুফাসসির, মুহাদ্দিস, ফকিহ ও মুফতি। ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞানের বহু উচ্চ মানসম্পন্ন গ্রন্থাবলির রচয়িতা ও সঙ্কলক। হজরত মুফতি সাহেব ১৯১১ সালের ২৪ জানুয়ারি সোমবার বিহার প্রদেশের মুঙ্গের জেলার অন্তর্গত পাঁচনা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম সাইয়্যেদ মুহাম্মাদ হাকিম আবদুল মান্নান রহ: ও মা সৈয়দা সাজেদা। তিনি চার ভাই ও তিন বোনের মধ্যে দ্বিতীয় ছিলেন। বাবা ও মা উভয় সূত্রেই তিনি নাজিবুত্তারাফাইন। মুফতি সাহেবের জন্মের কয়েক মাস আগে তার দাদী একটি স্বপ্ন দেখলেন যে, তার নামের সাথে আমীমুল ইহসান রাখার সুসংবাদ দেয়া হলো। তার জীবনের প্রতিটি স্তরেই এই সুসংবাদপ্রাপ্ত নাম সার্থক প্রমাণিত হয়েছিল। মুফতি সাইয়্যেদ মুহাম্মাদ আমীমুল ইহসান বারকাতী রহ: তার বাবা ও চাচার কাছ থেকে প্রাথমিক জ্ঞান অর্জন করেন। পরে হজরত মুফতি সাহেব ভারতের বিখ্যাত সুফি সাধক হজরত শাহ বারকাত আলী শাহ রহ:-এর মুরিদ হন। তাই মুফতি সাহেব নিজের নামের শেষে ‘বারকাতী’ কথাটি যুক্ত করেন। হজরত মুফতি সাহেব ১৯৩৩ খ্রিষ্টাব্দে কামিল (হাদিস) পরীায় প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়ে স্বর্ণপদক লাভ করেন এবং ‘মুমতাজুল মুহাদ্দিসিন’ উপাধিপ্রাপ্ত হন । ১৯৩৪ সালে তিনি তার শ্রদ্ধেয় ওস্তাদ মাওলানা মুফতি মুশতাক আহমেদ কানপুরী রহ: সাহেবের কাছ থেকে ‘মুফতি’ সনদ লাভ করেন। তখন থেকে তিনি ‘মুফত’ খেতাবে আখ্যায়িত হন। ১৯৩৫-৩৬ সালে কলকাতা সরকার তাকে ফতোয়া দেয়ার জন্য একটি সিলমোহর দেয়, যার মধ্যে লেখা GRAND MUFTI OF Calcutta তখন থেকে আজ অবধি মুফতি সাইয়্যেদ মুহাম্মাদ আমীমুল ইহসান বারকাতী অধিক সমাদৃত হন মুফতি-এ-আযম উপাধির মাধ্যমে। ১৯৩৪ সালে মুফতি সাহেবকে কলকাতার বৃহত্তর জামে মসজিদ ‘নাখোদা মসজিদ’-এর সহকারী ইমাম ও মাদরাসার প্রধান শিক পদে নিয়োগ দেয়া হয়। ১৯৩৫ সালে তাকে নাখোদা মসজিদের মাদরাসার দারুল ইফতার প্রধান মুফতির দায়িত্ব দেয়া হয়। এ সময় তিনি ধর্মীয় ও সামাজিক সমস্যাকল্পে প্রায় লাধিক ফাতওয়া প্রদান করেন। এ সময় তার সুনাম ও যশ চার দিকে ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৩৪ থেকে ১৯৪৩ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত তিনি নাখোদা মসজিদ ও দারুল ইফতার খেদমতে নিয়োজিত ছিলেন। হজরত মুফতি সাহেবের একটি অনন্য অর্জন রয়েছে, তিনি দুই বাংলার ঈদগাহতে ইমামতির দায়িত্ব পালন করেছেন। কলকাতা থাকার সময় কলকাতা ঈদগাহে ইমামতি করেন এবং ১৯৫৫ সালে আলিয়া মাদরাসায় হেড মাওলানার পদে উন্নীত হওয়ার পর তৎকালীন ঢাকার প্রধান ঈদগাহ পুরানা পল্টন ময়দানে ঈদের জামাতের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন এবং কয়েক বছর পর্যন্ত এই দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৪৩ সালে মুফতি সাহেব কলকাতা আলিয়া মাদরাসার শিকতার দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। ১৯৪৭ সালে আলিয়া মাদরাসা ঢাকায় স্থানান্তরিত হলে তিনি এই দেশে হিজরত করে আসেন। তখন তিনি নতুনভাবে ঢাকা আলিয়া মাদরাসায় অধ্যাপনার কাজে জড়িত হন। ১৯৫৬ থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত তিনি ঢাকা আলিয়া মাদরাসার হেড মাওলানা পদে নিযুক্ত ছিলেন। পরে জ্ঞান-বিজ্ঞানের গ্রন্থ প্রণয়ন এবং ধর্মীয় কাজে প্রচুর সময় দেয়ার স্বার্থে ১৯৬৯ সালের ১ অক্টোবর ওই পদ থেকে অবসর নেন। ১৯৬৪ সালে জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররম প্রতিষ্ঠার পর তৎকালীন কমিটির চেয়ারম্যান ইয়াহিয়া বাওয়ানীর অনুরোধে এবং মসজিদ কমিটির সর্বসম্মত সিদ্ধান্তক্রমে তিনি সেই মসজিদের খতিবের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। তিনি ইন্তেকালের আগ পর্যন্ত এই মহান দায়িত্ব কৃতিত্বসহকারে পালন করেন। হজরত মুফতি সাহেব রহ: প্রতি শুক্রবার সেখানে জুমার নামাজ পড়াতেন এবং আরবিতে স্বরচিত খুতবা পড়তেন। আরব দেশ থেকে আগত অনেক উচ্চশিতি আলেম ও রাষ্ট্রনায়ক তার খুতবা শুনে আবেগাপ্লুত হয়ে যেতেন। হজরত মুফতি সাহেব সমগ্র বিশ্বের মুসলমানদের কাছে পরিচিত ও গৃহীত তা হচ্ছে তার কিতাবের মাধ্যমে। তার রচিত কিতাবের সংখ্যা ২৫০-এর অধিক। আরবি ও উর্দু ভাষায় তিনি অসংখ্য বই লিখেছেন। তবে তার মধ্যে প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা কম। তার যে বই সমগ্র মুসলিম বিশ্বে প্রশংসনীয় এবং মিসরের আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক স্বীকৃত তা হচ্ছে ‘ফিকহুস সুনান ওয়াল আসার’। এ বইটি ৪০০-এর অধিক হাদিস ও শরাহ গ্রন্থের সার নির্যাস, যা হানাফি মাজহাব ও মতাদর্শের আলোকে রচিত হয়েছে। তার বইয়ের প্রশংসায় মাওলানা সাইয়্যেদ হোসাইন আহমেদ মাদানী রহ: বলেছেন, ‘আমি আজ পর্যন্ত ফিকহুস সুনান ওয়াল আসার-এর মতো কিতাব দেখিনি। হানাফি মাজহাবের এটি একটি অতুলনীয় যুক্তিপূর্ণ দলিলভিত্তিক কিতাব।’ মুফতি সাহেবের আরেকটি বিখ্যাত বই হচ্ছে, ‘কাওয়ায়িদুল ফিকহ’ যাতে ফিকহ শাস্ত্রের মৌলিক উসূল ও পরিভাষাসমূহ আলোচিত হয়েছে। তার একটি অন্যতম রচনা হচ্ছে নামাজের চিরস্থায়ী ক্যালেন্ডার। বর্তমানে সারা বাংলাদেশে তার রচিত নামাজের সময়সূচি অনুযায়ী নামাজের সময় ও ওয়াক্ত নির্ধারণ করা হয়। হজরত মুফতি সাহেব ঢাকায় আসার পর তার ভাই সাইয়্যেদ মুহাম্মাদ নোমান বারকাতির মাধ্যমে একটি পরিত্যক্ত মসজিদের কথা জানতে পারেন। পরে তিনি কলুটোলায় অবস্থিত সেই মসজিদটির পুনঃসংস্কার করেন এবং সেখানে নিয়মিতভাবে নামাজ পড়ার বন্দোবস্ত করেন। উল্লেখ্য মুফতি সাহেব নিজের জীবনে মোট তিনবার হজ করেন। সাইয়্যেদ বংশের এই উজ্জ্বল নত্র হজরত মুফতি সাইয়্যেদ মুহাম্মাদ আমীমুল ইহসান রহ: ১৯৭৪ সালের ২৭ অক্টোবর (১৩৯৫ হিজরির ১০ শাওয়াল) এ দুনিয়াবাসীকে বিদায় জানিয়ে মহান আল্লাহর সান্নিধ্যে জান্নাতবাসী হন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

ইসলামের দৃষ্টিতে বৃক্ষরোপণ ও সবুজ বনায়নের গুরুত্ব

ইসলামের দৃষ্টিতে বৃক্ষরোপণ ও সবুজ বনায়নের গুরুত্ব হাফেয মাওলানা মুফতি ওসমান আল-হুমাম উখিয়াভী সিনিয়র মুহাদ্দিস জামেয়া ইসলামিয়া বাইতুল ক...