শুক্রবার, ২০ জানুয়ারী, ২০১৭

খতিব মাওলানা উবায়দুল হকের জীবন ও কর্ম

খতিব মাওলানা উবায়দুল হকের জীবন ও কর্ম

খতিব উবায়দুল হক : জীবন ও কর্ম
 লিখেছেন মাওলানা মুফতি ওসমান আল-হুমাম
প্রকাশনায়:খতমে নবুওয়াত প্রকাশনী

-------------------------------------------------------------------------------------------------
মৃত্যু সংবাদ
অন্য মনস্ক ছিলাম তখন, একেবারে অন্য মনস্কদৈনিক সিলেটের ডাক অফিস থেকে মোবাইলে যখন জানতে চাওয়া হলো, খতিব সাহেবের কোন খবর জানি কি না? তখন আমি অন্য মনস্ক ছিলামনা, আমার কোন খবর জানা নেইমৃত্যু সংবাদ হুট করে দিতে নেই ভেবে হয়তো সিলেটের ডাকের নুর আহমদ আমাকে কোন খবর দিলো না, শুধু বললো বিশেষ সূত্রে তারা জেনেছে-খতিব সাহেব খুব অসুস্থআমি যেনো একটু খবর নিয়ে তাদেরকে জানাইনুর আহমদের এতটুকু কথাই আমার অনুভূতির অর্ধেক নাড়িয়ে যায়আমি বুঝতে পারি কিছু একটা ঘটে গেছেদ্রুত সুবিদবাজারে ফোন করে জানতে পারি খতিব সাহেব আর বেঁচে নেইইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউনতখন ঘড়িতে রাত সাড়ে এগারোটা কিংবা বারোটাতিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন রাত সোয়া এগারোটায়সেদিন ছিলো শনিবার, ৬ অক্টোবর ২০০৭২১ আশ্বিন ১৪১৪ বাংলা২৩ রমজান ১৪২৮ হিজরিমৃত্যুকালে তাঁর বয়স ছিলো ৭৯ বছর ৫ মাস
জন্ম, পরিবার, গ্রাম
সিলেট শহর থেকে প্রায় ৭৪ কিলোমিটার দূরে বাংলাদেশের সর্ব উত্তর-পূর্বাংশের যে ভূমিতে ভারতের কাছাড় এবং বদরপুর ভেদ করে বরাক নদী উত্তরে সুরমা আর দেিণ কুশিয়ারা নামে খ্যাতি লাভ করেছে, সেই সবুজে ঢাকা গর্ব করার মতো ঐতিহ্যবাহী গ্রাম- বারঠাকুরিতে ১৩৩৫ বাংলার ১৪ বৈশাখ মোতাবেক ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দের ২ মে শুক্রবার উপমহাদেশের প্রখ্যাত আলেমে দ্বীন, জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের খতিব মাওলানা উবায়দুল হকের জন্মবারঠাকুরীনাম থেকেই বুঝা যায় এই গ্রামের ধর্মিয় ঐতিহ্য প্রাচীন সময়ের১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে ভরাট হয়ে যাওয়া স্থানীয় গায়বি দীঘির উত্তর পশ্চিম কোণে মসজিদ নির্মাণের জন্য মাটি খনন কালে আট ফুট প্রস্থ নকশি ইটের তৈরি একটি দেয়াল এবং ৩ ফুট লম্বা ও ১ ফুট প্রস্থ একটি শিলালিপি পাওয়া যায়, যার এক দিকে আরবি ক্যালিওগ্রাফিতে মসজিদ সংক্রান্ত হাদিস এবং অন্য দিকে গৌতম বুদ্ধের মূর্তি রয়েছেশিলালিপিটি সিলেট কেন্দ্রিয় মুসলিম সাহিত্য সংসদে সংরতি রয়েছেআবিষ্কৃত দেয়াল, হাজার বছরের পুরাতন বৌদ্ধ সভ্যতার নিদর্শনআর শিলালিপিতে মসজিদ সংক্রান্ত হাদিস আর গৌতম বুদ্ধের মূর্তি পাশাপাশি থাকা থেকে গবেষকরা মনে করেন এই অঞ্চলে মুসলমানদের আগমনপূর্ব সময়ে বৌদ্ধদের প্রভাব ছিলো এবং মুসলমানদের আগমনের পরও দীর্ঘদিন তারা একত্রে বাস করেছেনহিন্দু পুরোহিতদের মতো বৌদ্ধরাও ধর্মগুরুদেরকে ঠাকুরবলে থাকেনবারঠাকুরীনামকরণ যে বৌদ্ধ ঠাকুর থেকে, তার প্রমাণ হিসেবে গবেষকরা গায়বি দীঘিতে প্রাপ্ত শিলালিপির কথা বলে থাকেনএই গ্রামের গায়বি দীঘির প্রচুর কেরামতি এখনও স্থানিয় মুরব্বিদের মুখে শোনা যায়মিথলজি বলেন আর সত্য, সবই নিজেদের বিশ্বাসের ব্যাপারযেমন, বারঠাকুরী গ্রামে এখনো অনেকে বিশ্বাস করেন, ‘অনেক আগে গ্রামের দরিদ্র মানুষদের কোন অনুষ্ঠানাদি উপলে হাড়ি-পাতিল প্রয়োজন হলে গায়বি দীঘি থেকে পাওয়া যেতোঅনুষ্ঠান শেষে তা দীঘির পাড়ে রেখে দিলে আবার চলে যেতোএকবার কেউ একজন একটি থালা ফেরৎ না দেওয়ায় এই দীঘির অলৌকিক ঘটনা বন্ধ হয়ে যায়সে যাই হোক, এই গ্রামে এক সময় হিন্দু কিংবা বৌদ্ধ বারোজন ঠাকুরের বসতি ছিলো এবং ওদের থেকেই এই গ্রামের নাম বারঠাকুরীজকিগঞ্জের ইতিহাস ও ঐতিহ্যগ্রন্থের তথ্যানুসারে ইসলাম প্রচারের প্রথম দিকে এই অঞ্চলের বারোজন বৌদ্ধ ঠাকুর এক সাথে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে ছিলেন বলে এই গ্রামের নাম বারঠাকুরী।(কিংবদন্তী এবং নামকরণ, পৃষ্টা-৩৩৫)বর্তমানে সিলেট জেলার সবচেয়ে বেশি আলেম অধ্যুষিত এলাকা জকিগঞ্জ-কানাইঘাটবলা হয়ে থাকে, এই অঞ্চলের আলেমরা যাকে নির্বাচনে সমর্থন করেন তিনিই নির্বাচনে সফল হয়ে থাকেনগ্রাম ভিত্তিক আলেমের সংখ্যা হিসেব করলে বারঠাকুরী গ্রামে এখনও অধিকাংশই আলেমখতিব মাওলানা উবায়দুল হকের পূর্বেও এই গ্রামের ইতিহাসে আমরা দেখেছি সিলেটী নাগরী ভাষার কবি সুফি মাওলানা মোহাম্মদ সেলিম ওরফে শিতালংশাহ (র.) এবং হাকিমুল উম্মত মাওলানা আশরাফ আলী থানবি (র.)এর আধ্যাত্মিক খলিফা ও উপমহাদেশের খ্যাতনামা শায়খুল হাদিস আল্লামা আনওয়ার শাহ কাশ্মিরী (র.)এর হাদিসের শিষ্য মাওলানা জহরুল হক(র.) সহ এমন অনেক খ্যাতনামা আলেমের জন্ম এখানেতবে খতিব মাওলানা উবায়দুল হকের মতো অন্য কেউ দেশ-বিদেশে এতো সাড়া জাগাতে পারেননিঅবশ্য দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আজও এই গ্রামে সাহিত্য প্রেমিক শেকড় সন্ধানি আর ভক্তবৃন্দ আসেন শিতালংশাহের মাজারেমাওলানা জহরুল হক হলেন খতিব মাওলানা উবায়দুল হকের পিতাতিনি ১৩৩৫ হিজরিতে দারুল উলুম দেওবন্দ থেকে হাদিসের সর্বোচ্চ ডিগ্রি অর্জন করে ১৩৩৬ হিজরিতে হাকিমুল উম্মাত মাওলানা আশরাফ আলী থানবী (র.)এর কাছ থেকে খেলাফতি লাভ করেছিলেনখতিব মাওলানা উবায়দুল হকের পিতা ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল এবং বাংলাদেশে জহরুল হকনামে পরিচিত হলেও নিজ এলাকা জকিগঞ্জের লোকেরা তাঁকে জানতেন উরফিজ আলী মৌলভীনামেস্থানীয় মুরুব্বীদের সাথে আলাপ করে জানা যায় উরফিজ আলী মৌলভীতাঁর সময়ে অনেক কিংবদন্তির জনক এবং বড় আলেম ছিলেনএখনও গ্রামের প্রবীণদের কাছে তাঁর অনেক কেরামতির কথা শোনা যায়মাওলানা জহরুল হক ওরফে উরফিজ আলী মৌলভী সম্পর্কে মাওলানা তাজুল ইসলাম আউয়াল মহল লিখেছেন-তিনি এতোই তাক্বওয়া সম্পন্ন বুজুর্গ ছিলেন যে নিজ খরচে যাতায়াত ও খানা সাথে নিয়ে বিভিন্ন স্থানে ওয়াজ-নসিহত করে সমাজে এক বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেনযা যুগ যুগ ধরে আগত বংশধরদের প্রেরণা যোগাবেএ আল্লাহর ওলী আত্মপ্রচার বিমূখ রাহেলিল্লাহের এক নিবেদিত প্রাণ ব্যক্তিত্বতিনি ছিলেন সমসাময়িক কালের এক যুগ সংস্কারক’(ইসলামী রেনেসাঁয় অনন্য যাঁরা, পৃষ্টা-১০১)১৩৬৪ হিজরিতে মাওলানা জহরুল হক (র.) ইন্তেকাল করেনগায়বি দীঘি আর ত্রি-নদীর মিলন কেন্দ্রের মধ্যখানে একটি জাম গাছের নীচে তাঁর কবর রয়েছেমাওলানা জহরুল হকের পিতা ছিলেন মুন্সী উমীদ রেযা এবং দাদা আদেল রেযাবিশেষ সূত্রে প্রাপ্ত তথ্যানুসারে আমরা বলতে পারি, খতিব মাওলানা উবায়দুল হকের মা মুসাম্মাৎ আয়েশা বেগম একজন অত্যন্ত পরহেজগার, কর্তৃত্বশীলা, পর্দানশীলা এবং সুন্দরী মহিলা ছিলেনতিন ভাইয়ের মধ্যে খতিব সাহেব ছিলেন দ্বিতীয়, প্রথম ছিলেন মাওলানা আহমদুল হক ছিলেন একজন প্রবীণ গ্রন্থ ব্যবসায়ীসিলেট শহরের জিন্দাবাজারে স্বাধীনতাপূর্ব সময়ে দীর্ঘদিন আশরাফিয়া কুতুবখানা নামে তাঁর একটি বইয়ের দোকান ছিলোতৃতীয় ছেলে মাওলানা আব্দুল হকতিনি দীর্ঘদিন ঢাকা আলিয়া মাদ্রাসার সিনিয়র শিকের দায়িত্ব পালন করে অবসর নেওয়ার পর বর্তমানে একটি কওমী মাদ্রাসায় হাদিসের শিক্ষকের দায়িত্বে আছেনমুসাম্মাৎ আমাতুল্লাহ, মুসাম্মাৎ সাঈদা, মুসাম্মাৎ আবিদা এবং মুসাম্মাৎ হামিদা এই তাঁর মোট চার বোনসিলেট থেকে জকিগঞ্জ যাওয়ার পথে মূল রাস্তার ডান দিকে শিতালং শাহের মাজার এবং বাম দিকে খতিব মাওলানা উবায়দুল হকের জন্ম ভূমি বারঠাকুরী গ্রামএই গ্রামের নামেই বর্তমানে গোটা ইউনিয়নের নাম ৭ নং বারঠাকুরী ইউনিয়ন
খতিব সাহেবের শিক্ষা জীবন খতিব মাওলানা উবায়দুল হকের পিতা মাওলানা জহরুল হক দেওবন্দ থেকে দেশে ফিরে প্রথম কয়েকদিন ঢাকায় মাওলানা মুফতি দীন মুহাম্মদ (র.) এর প্রতিষ্ঠিত বেগম বাজার মসজিদ সংলগ্ন ক্বাসিমুল উলূম মাদ্রাসায় শিকতা করেনপরে মুফতি দীন মুহাম্মদ বার্মায় চলে গেলে মাদ্রাসায় কিছু অনিয়ম দেখা দিলোতখন খতিব সাহেবের বাবা গ্রামের বাড়ি জকিগঞ্জের বারঠাকুরীতে চলে আসেনএই সময় কিছু ছাত্রও তিনির কাছে আসেন প্রাইভেট পড়ার জন্যতিনি গ্রামের মসজিদের বারান্দায় ওদেরকে পড়াতে শুরু করেনপরবর্তিতে তা মাদ্রাসায় রূপান্তরিত হয়অতঃপর তিনি মসজিদের দণি পাশে একটা ছন-বাঁশের ঘর তৈরি করেছিলেন বাইরের ছাত্রদের থাকার জন্যখতিব সাহেবের নিজের ভাষ্যমতেÑ‘ঐ সময় আমরার কিছু সুদবুদ হইছে, ওনিই পড়াইছেন আমাদেরকেঐ মসজিদে থাকিয়াই আমরা কোরআন শরিফ পড়ছিএরপরে উর্দু, ফার্সি প্রাথমিক কিতাবাদি কিছু পড়ছিএকবার আমাকে পাঠশালা স্কুল, বাবুর বাড়ি, নিজ গ্রাম, বারঠাকুরী সংলগ্ন, ওখানে পাঠাইলেন এবং বললেন যে, তুমি স্কুলে কিছু পড়, প্রাথমিক শিা লাভ করোআমি ঐখানে গেলামবাবুর বাড়ির স্কুল, মাষ্টার-শিক তারা খুবই মেধাবি এবং যোগ্য কিন্তু তাদের আচরণ ছিলো হিন্দুয়ানীযেমন, সালামের জায়গায় আদাব, মাথা নত করা ইত্যাদি আমার পছন্দ লাগলো নাআসিয়া আব্বাকে বললাম যে, ঐখানেতো সালাম-সুলামের নিয়ম নাই, শুধু আদাব-উদাব এইসব কথা-বার্তাআমারতো ইচ্ছা করে না যাইতেতিনি বললেন-তবে আর যাইয়ো নাঐ শেষ আমার স্কুলের পড়াদু-একদিন মনে হয় গেছিলাম, এরপরে আর নাআরো কিছু আব্বার কাছে পড়ার পর বয়স যখন আট-দশ কিংবা এগারো বছর হয়েছে তখন আমাকে পাঠাইদিলেন ঘুংগাদি, মাওলানা আতহার আলী সাহেবের বাড়িতে মাদ্রাসায়মোটকথা খতিব মাওলানা উবায়দুল হকের প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় নিজ বাড়িতে পিতার কাছেএরপর তিনি সিলেটের বিয়ানিবাজার থানার অন্তর্গত ঘুংগাদি গ্রামে হাকিমুল উম্মত মাওলানা আশরাফ আলী থানবি (র.)এর খলিফা মাওলানা আতহার আলী (র.) প্রতিষ্ঠিত মাদ্রাসায় চলে যানউল্লেখ্য যে, মাওলানা আতহার আলী(র.) কিশোরগঞ্জি বলে ইতিহাসে পরিচিতি লাভ করলেও মূলত তাঁর বাড়ি সিলেটের বিয়ানিবাজারের ঘুংগাদি গ্রামেঘুংগাদি মাদ্রাসায় তখন একজন শিক ছিলেন জকিগঞ্জের মাওলানা শামসুল হক (র.) শাহবাগিখতিব সাহেব তিনির কাছে ফার্সি, মিজান-মনশাইব ইত্যাদি প্রাথমিক কিছু কিতাব পড়েনদুই বছর ছিলেন তিনি ঘুংগাদিতেএরপর তিনি হবিগঞ্জে গিয়ে মাওলানা মুদ্দাস্সির আহমদ ও মাওলানা মুসির আলী (র.)এর কাছে কিছুদিন লেখা-পড়া করেনওরা দুজনই ছিলেন দারুল উলূম দেওবন্দ থেকে ডিগ্রিপ্রাপ্ত বড় আলেমঅতঃপর ফিরে আসেন নিজ বাড়িতে এবং ভর্তি হোন পিতার প্রতিষ্ঠিত মুন্সিবাজার সংলগ্ন আয়ারগাঁও মাদ্রাসায়কিছুদিন এখানে পড়ার পর ১৩৬২ হিজরি মোতাবেক ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে তিনি উচ্চ শিক্ষার জন্য চলে যান ভারতের উত্তর প্রদেশে অবস্থিত বিশ্ববিখ্যাত ইসলামি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দারুল উলূম দেওবন্দেখতিব সাহেব সেখানে ১৩৬২ হিজরি মোতাবেক ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে কাফিয়ার কাসে (বর্তমান বাংলাদেশের কওমি মাদ্রাসাগুলোর হিসেবে দশম শ্রেণী) ভর্তি হয়েছিলেনখতিব সাহেবের নিজের ভাষ্যানুসারে তিনি কাস ছুওম পড়ে গিয়ে এই কাসেই আবার ভর্তি হয়েছেনদু বছর পর ১৩৬৪ হিজরিতে তিনি তাঁর পিতার অসুস্ততার সংবাদ শুনে বাড়িতে আসেনআনুমানিক দশ বার দিন পর তাঁর পিতা মাওলানা জহরুল হকের ইন্তেকাল হয়। (ইন্নালিল্লাহি....রাজুন)পিতার ইন্তেকালের পর এক সপ্তাহের মধ্যে তিনি পুনরায় দেওবন্দ চলে যানতিনি হিজরি ১৩৬৬/৬৭ মোতাবেক ১৯৪৭/৪৮ খ্রিস্টাব্দ শিক্ষাবর্ষে দাওরায়ে হাদিস, হিজরি ১৩৬৭-৬৮ মোতাবেক ১৯৪৮/৪৯ শিক্ষাবর্ষে দাওরায়ে তাফসির এবং হিজরি ১৩৬৮-৬৯ মোতাবেক ১৯৪৯/ ৫০ খ্রিস্টাব্দ শিক্ষাবর্ষে ফনূনাতের কিতাবসমূহ পড়েন এবং খোশকতের মশ্ক করেনউল্লেখ্য যে, তিনি দাওরায়ে হাদিসের বার্ষিক পরীক্ষায় প্রতি বিষয়ে সমস্ত প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রেকর্ড পরিমাণ নম্বর লাভ করে দারুল উলূম দেওবন্দের ইতিহাসে বাংগালি ছাত্রদের মুখ উজ্জল করেছিলেন
দারুল উলূম দেওবন্দে যারা তাঁর শিক ছিলেনদারুল উলূম দেওবন্দে খতিব মাওলানা উবায়দুল হক (র.) পরিপূর্ণ বোখারি শরিফ এবং তিরমিযি শরিফ প্রথম খণ্ড পড়েন শায়খুল ইসলাম মাওলানা সাইয়েদ হোসাইন আহমদ মাদানি (র.)এর নিকট, পূর্ণাঙ্গ মুসলিম শরিফ পড়েন মাওলানা ইবরাহিম বলিয়াবি (র.)এর নিকট, পরিপূর্ণ আবু দাউদ শরিফ, তিরমিযি শরিফ দ্বিতীয় খণ্ড, শামায়েলে তিরমিযি ও হেদায়া আখেরাইন পড়েন মাওলানা এযায আলী আমরুহি (র.) নিকট, তাফসিরে বায়যাবি ও তাফসিরে ইবনে কাসির পড়েন মাওলানা ইদরিস কান্দলবি(র.) নিকট (উল্লেখ্য যে, মাওলানা ইদরিস কান্দলবি (র.) দেওবন্দের ছাত্রজীবনে তাঁর পিতা মাওলানা জহরুল হক(র.)এর সহপাঠী ছিলেন), নাসায়ী শরীফ পড়েন মাওলানা ফখরুল হাসান (র.) এর নিকট, ইবনে মাজা শরীফ পড়েন মাওলানা আবদুশ শুকুর দেওবন্দি (র.) এর নিকট, হুজ্জাতুল্লাহিল বালেগা পড়েন মাওলানা কারী মুহাম্মদ তৈয়্যব (র.)এর নিকট, তাফসিরে জালালাইন শরিফ পড়েন হাফেজ মাওলানা মুহাম্মদ আব্দুল জলিল (র.)এর নিকটখতিব মাওলানা উবায়দুল হক দারুল উলূম দেওবন্দে এছাড়াও আরো যাদের কাছে বিভিন্ন কিতাব পড়েছেন বলে জানা যায়, তাঁরা হলে-মাওলানা আবদুস সামী, মাওলানা আবদুল আহাদ, মাওলানা বশীর আহমদ, মাওলানা মিয়াজী মুহাম্মদ সাঈদ গঙ্গোহী, মাওলানা কারী মুহাম্মদ মিয়া, মাওলানা ইশতিয়াক আহমদ ও মাওলানা হাবীবুল্লাহ বিহারী (র.) প্রমুখ
কর্ম জীবন
হযরত মাওলানা উবায়দুল হকের কর্মজীবন শুরু হয় শিকতা দিয়েদারুল উলূম দেওবন্দে পড়াশুনার শেষ বছর ঢাকাস্থ বড় কাটারা হোসাইনিয়া আশরাফূল উলূম মাদ্রাসার মুহতামিম হযরত মাওলানা আবদুল ওহাব পীরজী হুযুর(র.)এর আগ্রহে এবং দারুল উলূম দেওবন্দের সম্মানিত শিকদের পরামর্শে খতিব সাহেব বড় কাটারা মাদ্রাসায় শিক হিসেবে যোগ দেনএই মাদ্রাসায় তিনি হিজরি ১৩৬৯ থেকে ১৩৭২ সন পর্যন্ত বুখারি শরিফ, তিরমিযি শরিফ, আবু দাউদ শরিফ ও বায়যাবি শরিফ প্রভৃতি পড়ানতিনি শিকতার চতুর্থ বছর হজ্জের উদ্দেশ্যে বোম্বাই গিয়ে বিভিন্ন কারণে আর যেতে পারেননিঅবশেষে হযরত মাওলানা সাইয়েদ হোসাইন আহমদ মাদানি ও মাওলানা এযায আলীসহ অন্যান্য শিকদের সাথে দেখা করার উদ্দেশ্যে বোম্বাই থেকে দেওবন্দ চলে গেলেনসেখান থেকে মাওলানা এযায আলী (র.) তাঁকে উত্তর প্রদেশস্থ শাহজাহানপুরের এক মাদ্রাসায় শিকতার জন্য পাঠিয়ে দেনসেখানে কিছুদিন শিকতা করার পর মাওলানা এযায আলী তাঁকে নিয়ে আসেন এবং পাকিস্তানের করাচি শহরে অবস্থিত হযরত মুফতী শফী (র.)র দারুল উলূম মাদ্রাসায় শিকতার জন্য পাঠিয়ে দেনতিনি সেখানে শিক্ষাবর্ষ ১৩৭৩ হিজরি মোতাবেক ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দে আবু দাউদ শরিফ ও হেদায়া আখেরাইন ইত্যাদি কিতাবের পাঠদান করেনঅতঃপর হাকীমুল উম্মত মাওলানা আশরাফ আলী থানবী(র.)এর খলীফা এবং পাকিস্তান নেজামে ইসলাম পার্টির শীর্ষ নেতা হযরত মাওলানা আতহার আলী (র.) মুফতী শফী (র.)এর অনুমতিক্রমে মাওলানা উবায়দুল হককে ঢাকায় নিয়ে এসে নেজামে ইসলাম পার্টির রচনা ও প্রকাশনা বিভাগের দায়িত্ব দেনতবে অল্পদিন পর পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক সরকার ভেঙ্গে সকল রাজনৈতিক দল বেআইনি ঘোষণা দিয়ে যাবতীয় রাজনৈতিক কার্যকলাপ বন্ধ করে দেয়যার ফলে নেজামে ইসলাম পার্টির সকল তৎপরতা বন্ধ হয়ে যায়অন্যদিকে এই সময় মাদ্রাসা-ই আলিয়া ঢাকায় সিনিয়র শিকের একটি পদ শূন্য হলে মাওলানা উবায়দুল হককে এ পদে যোগদানের জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি তাঁর শিক হযরত মাওলানা সাইয়েদ হোসাইন আহমদ মাদানী (র.)এর অনুমতিক্রমে মাদ্রাসা-ই-আলিয়া ঢাকায় যোগ দেনমাদ্রাসায়ে আলিয়া ঢাকায় তিনি ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সহকারী শিক, ১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত হাদিস বিভাগের লেকচারার, ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তাফসির বিভাগে এসিস্ট্যান্ট প্রফেসর, ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯৭৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এডিশনাল হেড মাওলানা এবং ১৯৮০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত হেড মাওলানা পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দের ২ মে খতিব মাওলানা উবায়দুল হক সরকারি আলিয়া মাদ্রাসা থেকে অবসর গ্রহণ করেনমাদ্রাসা-ই আলিয়া ঢাকায় চাকুরীরত অবস্থায় দেশের কওমী মাদ্রাসাসমূহের সঙ্গেও তাঁর সুগভীর সম্পর্ক ছিলোফলে দেখা গেলো তিনি আলিয়া মাদ্রাসা থেকে অবসর গ্রহণের পর বিভিন্ন মাদ্রাসা কর্তৃপরে অনুরোধে বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করতে বাধ্য হলেনযেমন, ১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে বেশ কয়েক বছর ফরিদাবাদ এমদাদুল উলূম মাদ্রাসায়, ১৯৮৬ এবং ৮৭ খ্রিস্টাব্দ এই দুই বছর চট্টগ্রামের পটিয়া মাদ্রাসায়, এবং ১৯৮৭ খ্রিস্টাব্দ থেকে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত সিলেট কাসিমূল উলূম দরগাহে হযরত শাহজালাল (র.) মাদ্রাসায় শায়খুল হাদিসের দায়িত্বে ছিলেনতা ছাড়া ১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে কয়েক বছর তিনি ঢাকার ইসলামপুর ইসলামিয়া মাদ্রাসায় মুহতামিমের দায়িত্ব পালন করেন১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে মৃত্যুণ পর্যন্ত তিনি ঢাকা আজিমপুরের ফয়জুল উলূম মাদ্রাসার শায়খুল হাদীস ও মুহতামিমের দায়িত্বে ছিলেনএ ছাড়াও খতিব মাওলানা উবায়দুল হক জামেয়া এমদাদিয়া কিশোরগঞ্জ এবং কুমিল্লা কাসিমুল উলূম মাদ্রাসার মজলিসে শুরার সভাপতি, সিলেট জামিআ সিদ্দিকিয়ার উপদেষ্টা পরিষদের প্রধান, মঈনুল উলূম হাটহাজারী, পটিয়া মাদ্রাসা এবং সিলেট জামেয়া কাসিমুল উলূম দরগাহ মাদ্রাসাসহ আরো অনেক ইসলামি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মজলিসে শুরার গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলেনঢাকা আলিয়া মাদ্রাসার হেড মাওলানার দায়িত্বে থাকাকালিন সময়ে তিনি ১৯৮৪ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশের জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের খতিবের দায়িত্ব প্রাপ্ত হয়ে ছিলেন এবং ২০০৭ খ্রিস্টাব্দের ৬ অক্টোবর মৃত্যুণ পর্যন্ত তিনি এই দায়িত্বে ছিলেন
ইসলামী ব্যাংকিং ও ইসলামী বীমায় খতিব সাহেবের ভূমিকা
বাংলাদেশ ইসলামী ব্যাংকের শরিয়াহ বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন খতিব মাওলানা উবায়দুল হকএ ছাড়া তিনি ছিলেন ইসলামী ব্যাংকসমূহের শরিয়া কাউন্সিলের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যানবিভিন্ন ইসলামী ব্যাংক, ইসলামী ইন্স্যুরেন্স ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহের শরিয়াহ বোর্ডের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেছেন তিনিপ্রচলিত বিশ্ব ব্যাংকের পূঁজিবাদি পদ্ধতি আর নীতির ভেতরে থেকে ইসলামী ব্যাংক নিজস্ব সীমাবদ্ধতা নিয়ে কতটুকু সুদ মুক্ত? এই প্রশ্ন সামনে রেখে অনেক আলেম খতিব সাহেবের সমালোচনা করতেনআমরা দীর্ঘ আলোচনায় না গিয়ে বলবো-নাই মামা থেকে কানা মামা ভালোনীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন খতিব সাহেবতিনি জাতীয় শরিয়াহ কাউন্সিলের চেয়ারম্যানের দায়িত্বেও ছিলেনসুদমুক্ত ব্যাংকিং ব্যবস্থা চালুর স্বপ্নে তিনি আজীবন নিঃস্বার্থ কাজ করেছেনএমন কি তাঁর জীবনের শেষ খুতবাতেও সুদের বিরুদ্ধে তীব্র ঘৃণা প্রকাশ করে গেছেন
খতিব সাহেবের আধ্যাত্মিক জীবন আমরা ইতোমধ্যে জেনেছি যে, খতিব মাওলানা উবায়দুল হক বোখারি শরিফ পড়েছেন হযরত মাওলানা সাইয়েদ হোসেন আহমদ মাদানি (র.) এর কাছেমাওলানা সাইয়েদ হোসাইন আহমদ মাদানী (র.) তাঁর প্রথম মুর্শিদও ছিলেনতিনি দারুল উলূম দেওবন্দে তাফসীর কাসে পড়াকালে মাওলানা মাদানির আধ্যাত্মিক শিষ্যত্ব গ্রহণ করেনহযরত মাদানি (র.) এর ওফাতের পর খতিব সাহেব হাকীমুল উম্মত মাওলানা আশরাফ আলী থানবী (র.)এর খলীফা হযরত মাওলানা আতহার আলী (র.) এবং তাঁর মৃত্যুর পর হযরত থানবি (র.)এর অন্য খলিফা হযরত মাওলানা মুহাম্মদ উল্লাহ হাফেজ্জী হুজুর (র.) থেকে আধ্যাত্মিক ফয়েয হাসিল করেন বলে শোনা যায়খতিব সাহেবের জীবনী লেখকদের অনেকে লিখেছেন হযরত হাফেজ্জী হুজুর(র.) তাঁকে বায়আত ও খিলাফতি প্রদান করেছেনহযরত হাফেজ্জী হুজুর (র.) তাঁর পির বা মুর্শিদ ছিলেন কি না তা জানতে চাইলে হযরত খতিব সাহেব মরহুম আমাকে বলেন-আমার পির সাহেব নয়, আবার পির সাহেবওউনাকে আমি ভক্তি করতাম, কারণ আমার আব্বা এবং হাফেজ্জী হুজুর ছিলেন হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানবী (র.) মুরিদ এবং খলিফাউনাদের সম্পর্ক ছিলো সেই থানাবন থেকেইএই হিসেবে উনাকে মুরুব্বী মানতামযেমন মাওলানা আতহার আলী সাহেবকে মুরুব্বী মানতাম, তেমনি হাফেজ্জী হুজুরকেএই কথা খতিব সাহেব বেশ কয়েকবার আমাকে বলেছেনতবে তিনি যে হযরত হাফেজ্জী হুজুরের খলিফা ছিলেন তাতে কোন সন্দেহ নেইতিনি ইচ্ছেকৃত এই বিষয়টি সর্বদা এড়িয়ে যেতেনকারণ কি তা তো আমরা স্পষ্ট বলতে পারবো নাতবে আমার ধারণা তিনি কাউকে মুরিদ করতে চাইতেন না বলে এই আত্মগোপনের পথ অবলম্বন করে ছিলেনইংল্যান্ডে একবার এই রকমের একটা ঘটনাও ঘটেছিলোফেনির মাওলানা নুরুল্লাহ সাহেব বার্মিংহামে থাকেনতিনি তাঁর বাসায় খতিব সাহেবকে দাওয়াত করে নিয়ে নিজে মুরিদ হতে চাইলে খতিব সাহেব খুব রেগে গিয়ে বললেন-আমি পির হইলাম কবে?’ মাওলানা নুরুল্লাহ সাহেব বললেন-আপনারতো হযরত হাফেজ্জী হুজুর (র.) এর এজাজত আছেআমি দীর্ঘ দিন ঢাকায় হযরত হাফেজ্জী হুজুরের কামরাঙিরচর মাদ্রাসায় শিক ছিলাম এবং সেখানে যেনেছিখতিব সাহেব সেদিন মাওলানা নুরুল্লাহ সাহেবকে মুরিদ না করলেও তাঁর এই কথার কোন প্রতিবাদ করেননিএই হিসেবে আমরা বলতে পারি খতিব সাহেব হাফেজ্জী হুজুরের খলিফা ছিলেনহযরত হাফেজ্জী হুজুর (র.)এর ইন্তেকালের পর খতিব সাহেব হযরত থানবীর সর্বকনিষ্ঠ খলিফা ভারতের মাওলানা আববারুল হক সাহেবের সঙ্গে আধ্যাত্মিক সম্পর্ক স্থাপন করে ছিলেন
বিদেশ সফর
খতিব মাওলানা উবায়দুল হক সরকারী ও বেসরকারী উদ্যোগে বিভিন্ন ইসলামী অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণে সৌদী আরব, মিসর, ইরাক, ইরান, কুয়েত, মরক্কো, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, সিঙ্গাপুর, ভারত, পাকিস্তান, আমেরিকা, রাশিয়া, বৃটেন ও দণি আফ্রিকা সফর করেনখতিব সাহেব বেশ কয়েকবার ইংল্যান্ড সফরে যান বিভিন্ন ইসলামী সংগঠনের দাওয়াতেআমার জানা মতে তিনি প্রথম ইংল্যান্ড গিয়েছিলেন দাওয়াতে ইসলামী ইউকের উদ্যোগে আয়োজিত খতমে নাবুওয়াত সম্মেলনে এবং সর্বশেষ গিয়েছিলেন লন্ডন ইব্রাহিম কলেজের উদ্যোগে আয়োজিত এক শিা সম্মেলনেমধ্যখানে আরো দুএকবার গিয়েছেনপ্রতিবারই সেখানে কিছু সময় আমি তাঁর খেদমতে থাকার চেষ্টা করেছিইংল্যান্ড সফরে গেলেই তিনি আমাদের বসতি শহর বার্মিংহামে দুএকদিনের জন্য আসতেন এবং আমাদের ঘরে থাকতেনঅনেক আলেমকে আমরা ইংল্যান্ড সফরকালে দেখেছি পাগলের মতো চাঁদা উঠানোর কাজে ব্যস্ত থাকেন, অনেকে হালালÑহারামের দিকে তেমন একটা নজরই রাখেন না, মদের রেষ্টুরেন্টসমূহে গিয়েও চাঁদা উঠাতে লজ্জাবোধ করেন নাশুধু আলেমদের কথা বলবো কেনো? বিভিন্ন দলের নেতা, সামাজিক নেতা, কিংবা সাধারণ ভিজিটার ইংল্যান্ড গেলেই পাউন্ডের হিসাবে টাকা গুণে প্রবাসিদের পকেট খালির চেষ্টায় প্রায়ই ব্যস্ত থাকেনআর বর্তমানেতো বিভিন্ন প্রজেক্ট, ফাট-বাড়ি ইত্যাদির নামে আছে কতো রঙের খেলা, সরকারি বড় বড় আমলারা পর্যন্ত এই খেলায় পিছিয়ে নেইকিন্তু আমরা খতিব মাওলানা উবায়দুল হককে এই রকমের খেলায় কিংবা কাজে কোনদিন ব্যস্ত হতে দেখিনিতিনি এসব চাঁদাবাজি অপছন্দ করতেনঅথচ আমরা জানি তিনি বাংলাদেশের অনেকগুলো মাদ্রাসার পরিচালক ছিলেনখতিবের পদটা জাতীয়ভাবে সম্মানিত হলেও পারিবারিক জীবনে তাঁর খুব একটা অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা ছিলো নাতবু তিনি যে কয়বার ইংল্যান্ড গিয়েছেন, একবারও টাকা দিয়ে পাউন্ড হিসাব করতে দেখিনি
বার্মিংহামের রেডিও মিনারের মাধ্যমে আমি খতিব সাহেবের মুখোমুখি ইংল্যান্ডে বাংলাদেশীদের একটা বিরাট অংশ রেস্টুরেন্ট ব্যবসার নামে মদের ব্যবসার সাথে জড়িতবেশির ভাগ আলেমরা চাঁদার উদ্দেশ্যে বৃটেন সফর করেন বলে এই ব্যাপারে কথা বলতে অনাগ্রহিতাই আমি একবার রেডিও মিনারের প থেকে আয়োজন করেছিলাম এক বিতর্ক সভারদুঃখজনক হলেও সত্য কেন আলেম এতে অংশগ্রহণে আগ্রহী হয়ে উঠেননিশেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে টেলিফোনে খতিব মাওলানা উবায়দুল হকের মুখোমুখি হয়ে ছিলাম এই প্রশ্ন নিয়েÑমদের ব্যবসা কোন ভাবে হালাল করা যায় কি ? উত্তরে তিনি বলেনÑআমার আশ্চর্য লাগে একজন মুমিন মুসলমান মদ হারাম জানার পর ও প্রশ্ন করে মদের ব্যবসা হালাল করা যায় ক্ ি? পবিত্র কোরআনে মদকে রিজসবলে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে, যার অর্থ নজিস বা পায়খানাপায়খানা ব্যবসা হালাল করার চেষ্টা একটি ঘৃণিত কাজপায়খানার ব্যবসা যে কোন মতে জায়েয হতে পারে না তা একজন সাধারন মুসলমানও বুঝেবোখারী শরিফের হাদিসে এ সম্পর্কে স্পষ্ট রয়েছেহযরত আয়েশা (রা.) বলেনÑ‘যখন মদের আয়াত অবতীর্ণ হয় তখন নবি করিম (স.) মসজিদে গিয়ে মদের ব্যবসা হারাম সম্পর্কে ঘোষণা দিলেনতাছাড়া অন্য একটি হাদিস হয়রত আব্দুলাহ ইবনে ওমর (র.) থেকে বর্ণিত যে, মহানবি (স.) বলেছেনÑ‘মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন লানত দিয়েছেন মদের উপর, মদপানকারীর উপর, মদ যে অন্যকে পান করায় তার উপর , মদ যে ক্রয় করে তার উপর, মদ অন্যের মাধ্যমে বের করায় তার উপর, যে মদ বহন করে বা পরিবেশন করে (সার্ভিস করে) তার উপর, মদের সাথে সম্পর্কিত এই নয় শ্রেণীর লোকের উপর আলাহ পাকের লানত অর্থাৎ অভিশাপের কথা মহানবি (স.) ঘোষনা করেছেনবোখারী শরিফে হয়রত জাবের ইবনে আব্দুলাহ (রা.) থেকে আরোকটি হাদিস বর্নিত রয়েছে যে, তিনি নিজে মক্কা বিজয়ের দিন মহা নবী (সা.) এর কাছ থেকে শুনেছেন-ইন্নাল্লাহা হার-রামা বাইয়াল খামরি ওয়াল মাইতাতি ওয়াল খিনজিরী ওয়াল আছনামঅর্থাৎ নিশ্চয় আলাহ তায়ালা মদ, মৃত পশু-পী, শুকর এবং মূর্তি বিক্রি ব্যবসা হারাম করে দিয়েছেনএভাবে আরো অসংখ্য হাদিস রয়েছে- এই হাদিসগুলো স্পষ্ট করে দিয়েছে মদপান যেমন হারাম তেমনি মদের ব্যবসাও হারামঅন্য একটি হাদিসে এসেছে ইজতানিবুল খারমা ফাইন্নাহা মিফতাহু কুলে শাররিনঅর্থা-মদ থেকে তোমরা বেঁচে থাক, কারণ সকল অনিষ্টের চাবি হলো মদআরোকটি হাদিসে রয়েছে আল খামরু উম্মুল ফাওয়াহিশ ওয়া আকবারু কাবাইরঅর্থাৎ -মদ হলো সকল নাপাকিসমূহের মূল এবং কবিরা গোনাহ সমূহের মধ্যে বড় গোনাহহয়রত আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, মহানবি (স.) বলেছেন-যে ব্যক্তি মদ পান করে, এই মদ পান করা অবস্থায় তার ঈমান থাকে নাএই সমস্ত হাদিস পড়ে এবং উলামায়ে কিরাম স্পষ্ট ভাষায় বিস্তারিত বর্ণনা সত্ত্বেও কোন মুসলমানের অন্তরে মদের ব্যবসা হালাল হওয়ার ধারনা থাকতে পারে নামহানবী (স.) বলেছেন-শবে কদরে মুমিনদের সকল গোনাহই মাফ হয় কিন্তু চার ব্যক্তির প্রতি আল্লাহ তায়ালা রহমতের দৃষ্টি দেন নাএর মধ্যে
১) ঐ ব্যক্তি যার সাথে শরাবের সম্পর্ক রয়েছে
২) যে পিতা-মাতা কে কষ্ট দেয়
৩) যে আত্মীয়দের হক্ক আদায় করে না
৪) যে অন্য কোন মুসলমানের সাথে হিংসা-বিদ্বেষ রাখে
এতে বুঝা যায় মদ সকল গোনাহ থেকে বড় গোনাহ এবং তা অত্যন্ত কঠিন শাস্তিযোগ্য অপরাধআমার বিশ্বাস এ সব কথা শোনার পর কোন মুসলমান মদের ব্যবসার সাথে সম্পর্ক রাখতে পারে নাযারা এখনো মদের ব্যবসার সাথে সম্পর্কিত আমি আশা করবো তারা এই গোনাহের কাজ বর্জন করবেনআল্লাহ পাক অর্থোপার্জনের অনেক রাস্তা মানুষের সামনে উন্মুক্ত করে রেখেছেনযারা চুরি-ডাকাতি করে তাদের ধরণা এ সকল ছেড়ে দিলে পরিবারের ভরণ - পোষণ অসম্ভব হয়ে যাবেএ ভাবে মদের ব্যবসায়ীদেরও ধারনা থাকতে পারে, অথচ আল্লাহ তায়ালা যেমন চুর-ডাকাতকে এই পথ ছেড়ে দিলে অর্থোপার্জনের অন্যপথ করে দেন, তেমনি সাহস করে মদের ব্যবসা ছেড়ে দিলে আল্লাহ পাক রিজিকের অন্যপথ উন্মুক্ত করে দিবেনআমি মনে করি এতটুকু আলোচনাই মদের ব্যবসা হারাম হওয়া সম্পর্কে যথেষ্টএকটি হাদিস উল্লেখ করে আমি আমার বক্তব্য শেষ করছিহয়রত আব্দুলাযহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্নিত মান কানা ইরিদু বিল্লাহী ইয়াল ইয়াওমীল আখেরী ফালা ইয়াস তাতীর খামরা ওয়ামান কানা ইউমিনু বিল্লাহী ওয়াল ইয়াওমীল আখের, ফালা ইয়াজর্লিসু আলা মাদাতি ইসরাবু আলাইহাল খামরুঅর্থৎ যে ব্যক্তি আল্লাহ এবং কিয়ামতের উপর ঈমান রাখে সে কখনো শরাব পান করতে পারে নাআবার এরশাদ করেন-যে ব্যক্তি আল্লাহ ও কিয়ামতের উপর বিশ্বাস রাখে সে কখনো মদের ঐ দস্তরখানার সাথে সম্পর্ক স্থাপন করতে পারে না, যেখানে নিজে বা অন্যরা বসে মদ পান করে থাকেমহান আলাহ পাক আমাদের সর্বপ্রকার পাপ থেকে রা করুন এবং আমাদের যারা এখনো মদের মতো খারাপ জিনিষের ব্যবসার সাথে সম্পর্কিত তাদের কে হালাল পথে অর্থোপার্জনের তৌৗফিক দিনওয়াখেরু দাওয়ানা আলহাদু লিল্লাহী রাব্বিল আলামীনইংল্যান্ড সম্পর্কে খতিব উবায়দুল হকের একটি গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্যখতিব মাওলানা উবায়দুল হক ইংল্যান্ড সফরে গেলে প্রায়ই বলতেন, কোরআন এবং হাদিসের ভাষ্য হলোÑমহান আল্লাহ পাক গোটা বিশ্বে ইসলামী হুকুমত প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত কিয়ামত করবেন নাউসমানিয়া খিলাফতের সময় স্পেন পর্যন্ত ইসলাম এসে থেমে গিয়েছিলোবিভিন্ন কারণে তখন ইসলাম ইংলিশ চ্যানেল অতিক্রম করতে পারেনিমনে হচ্ছে এখন ইসলাম ইংলিশ চ্যানেল অতিক্রম করে ইংল্যান্ডে চলে আসবেকিন্তু এক্ষেত্রে প্রবাসী মুসলমানদের ভূমিকা রাখতে হবে খুব সচেতনভাবেএখানের প্রতিটি মুসলমানকে স্মরণ রাখতে হবে, বৃটেনের অমুসলিমরা কোরআন-হাদিস পড়ে ইসলাম বুঝতে আসবে না, ওদেরকে ইসলাম বুঝাতে হবে মুসলমানরা তাদের চরিত্র এবং ব্যবহার দিয়েএখানের প্রতিটি মুসলমানকে জীবন্ত কোরআনের ভূমিকা পালন করতে হবেযদি মুসলমানরা এখানে সঠিক দায়িত্ব পালন করতে পারেন তবে খুব দ্রুত এখানে ইসলামি শাসন প্রতিষ্ঠা লাভ করবেআর যদি মুসলমানরা নিজেদের দায়িত্ব আদায়ে গাফেল হয়ে পড়েন তবে স্মরণ রাখবেন এর শাস্তি হিসেবে আপনাদের প্রজন্মগুলো নষ্ট হয়ে যাবে এবং অন্য জাতিগুলোকে আল্লাহ হেদায়াতের আলোতে এনে এই কাজ উদ্ধার করে নিবেন
ভিন্নমতের প্রতিও খতিব ছিলেন সহনশীল
খতিব মাওলানা উবায়দুল হক নিজে একটা নির্দিষ্ট আদর্শের বিশ্বাসী ছিলেনতিনি ছিলেন আকাবিরে দেওবন্দের পূর্ণাঙ্গ অনুসারিকিন্তু তিনি তাসবির দানা হাতে নিয়ে নিজেকে দেওবন্দি-দেওবন্দি বলে জপ করার পে ছিলেন নাতিনি সব ইসলামি দলের সাথে সর্বদাই সু-সম্পর্ক বজায় রেখে চলতেনএখানে তাঁর কোন ভণ্ডামি ছিলো না, ছিলো না কোন স্বার্থিক কারণতাঁর সহজ বক্তব্য ছিলো-এখতেলাফতো আছে এবং থাকবেকিন্তু আমরা একে অন্যের খেলাফ হবো কেনোমানবিক ভালো আচরণ একের সাথে অন্যের থাকাতে আপত্তি কোথায়? আর কেউ যদি আমাকে ডাকে তাঁর মাহফিলে গিয়ে কথা বলার জন্য আর সে নাস্তিক-মুরতাদ না হয়, তবে আমার যেতে আপত্তি কোথায়? আমিতো গিয়ে আমার কথা বলবোমুসলমান হিসাবে আমরা প্রতিটি ইসলামী দলের সাথে একটি ইসলামী সম্পর্ক রাখতে পারি
খতিবের বিরুদ্ধে কয়েকটি অপ-প্রচারের উত্তর
১) ২০০১ খ্রিস্টাব্দের শেষদিকে জাতীয় ঈদগাহে খতিব সাহেবের দেওয়া ঈদের খুতবাকে কেন্দ্র করে সুযোগসন্ধানি মহল আমেরিকাকে বুঝাতে চেষ্টা করে-খতিব আমেরিকার বিরুদ্ধে বক্তব্য দিয়েছেনগরিবের বৌ সকলের ভাবিবাংলাদেশ সরকারের জন্য বিষয়টি একটি চিন্তার কারণ হয়ে গেলোদেশের শত্ররা এ কথাকে বেশি প্রচার শুরু করেএ সবের জবাবে খতিব তখন বলেছিলেন-ঈদের প্রধান জামায়াতে দেয়া আমার খুতবা নিয়ে একটি সুযোগসন্ধানী মহল এক তীরে দুই পাখি শিকারের মতলব এঁটেছেতারা বিভিন্ন পয়েন্ট বের করে হিংসা বিদ্বেষ চরিতার্থ করতে চায়এই সুযোগসন্ধানিরা বিদেশে গিয়ে দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছেআমিতো দেশের বিরুদ্ধে কিছু বলিনি, যা বলেছি ইসলামী আকিদা থেকে বলেছিখুতবায় সরকারের সমালোচনা ছিলো নারাশেদ খান মেনন অতীতেও আমার বিরুদ্ধে বয়ান রেখেছেতার বামপন্থী দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আমরা কখনো খুতবা পাঠ করিনিসরকারের ওপর মহলের সাথে খতিব-ইমামদের কোন সংঘাত নেইসরকার পক্ষ কথা বলবেন তাদের আন্তর্জাতিক পলিসি অনুযায়ী আর খতিব-ইমামগণ কথা বলবেন আন্তর্জাতিক ইসলামী ভ্রাতৃত্ববোধ প্রাধান্য দিয়েখুতবার ওপর মতার ছড়ি ঘুরানো চলবে নারাষ্ট্রীয় কূটনৈতিক পলিসি যাই হোক, যতদিন মুসলিম বিশ্বে অত্যাচার-অবিচার চালানো হবে আমি তার বিরুদ্ধে বলবোইতার সাথে সরকারি নীতির সম্পর্ক নেইনতুবা সরকার ঠিক করে দিক খতিব-ইমামগণ কি এক হাজার বছর আগের ইবনে বতুতার আমলের গৎবাধা খুতবা পাঠ করবেন না কি বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে দিক নির্দেশনামূলক খুতবা পাঠ করবেনএ নিয়ে প্রায়শই দেশের বুদ্ধিজীবী ও শিতি মহল বিতর্ক তোলেনতারা বলেন, খুতবা গৎবাধা হবে কেন, বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে পাঠ করা হোকআবার দিক নির্দেশনা মূলক বক্তব্য দিলে তাদের গা জ্বলে ওঠে
২) বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদ হলেও এই কথা সর্বজন স্বীকৃত যে, মাওলানা উবায়দুল হকের মতো মেধাসম্পন্ন সাহসী ব্যক্তিত্ব এই মসজিদের খতিব হওয়ার পর এই পদ জাতীয় বিভিন্ন বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছেদেশের যে কোন সংকটময় মূহুর্তে খতিবের ভূমিকা দেশ, জাতি এবং ধর্মদ্রোহী শ্রেণী সহ্য করতে না পেরে শুরু করে তাঁকে এই পদ থেকে সরিয়ে দেয়ার গভীর ষড়যন্ত্রপাশাপাশি তারা খতিবের বিরুদ্ধে চালায় বিভিন্ন মিথ্যা অপপ্রচারএরই মধ্যে আওয়ামীলীগ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠনের পর সরকারি ছত্রছায়ায় ষড়যন্ত্রকারিরা তাদের ষড়যন্ত্রের মাত্রা আরো বৃদ্ধি করে দেয়আওয়ামীলীগ সরকারের শেষ দিকে তারা তাওহিদী জনতার বিবেকী কণ্ঠ, ইসলামী তাহজিব-তামাদ্দুন রার সংগ্রামী সিপাহসালার খতিব মাওলানা উবায়দুল হককে বায়তুল মোকাররমের খতিব পদ থেকে সরানোর মরণ কামড় দিলো বিভিন্ন বাম পত্রিকা এই সময় উলঙ্গ হয়ে নেমে যায় খতিবের বিরুদ্ধেমস্কোপন্থী কমিউনিস্টদের পত্রিকা দৈনিক সংবাদ লিখেÑ‘খতিব প্রকৃতপে একজন জামাতিজামাত প্রভাবিত ইসলামি ব্যাংক বাংলাদেশ’-এর শরিয়াহ বোডের চেয়ারম্যান হিসাবে তিনি ২০ হাজার টাকা মাসে সম্মানি নিয়ে থাকেনখতিব তিন বিয়ে করেছেনকিশোরগঞ্জের স্ত্রীর সাথে তাঁর ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছেখতিবের ছেলেরা কেউ আরবি শিতি নয়ইত্যাদিদৈনিক সংবাদে প্রকাশিত এই সব ভিত্তিহীন সংবাদের ভিত্তিতে অবশেষে দৈনিক আজকের কাগজের প থেকে তৎকালিন সাংবাদিক সেলিম জাহিদ মুখোমুখি হয়েছিলেন খতিব সাহেবেরখতিব সাহেবের সেদিন তাঁর বিরুদ্ধে প্রচারিত অভিযোগের উত্তরে যা বলেছিলেন তা ২০০১ খ্রিস্টাব্দের ৬ মে দৈনিক আজকের কাগজে প্রকাশিত হয়েছিলোআমরা এখানে দৈনিক আজকের কাগজের দীর্ঘ বক্তব্য থেকে সংেেপ শুধু সারমর্ম নেবোখতিব সাহেব সেদিন খুব দৃঢ়তার সাথে সকল অপপ্রচারের জবাব দিয়ে বলে ছিলেনÑ‘তারা বলেছে ইসলামী ব্যাংকের শরিয়াহ কাউন্সিলে আমি বিশ হাজার টাকা বেতন নেইএটা মিথ্যা, ভিত্তিহীনআমি ইসলামী ব্যাংকের বেতনভূক্ত কোন সদস্য বা কর্মচারি নইব্যাংকের অনারারি কাউন্সিলার হিসাবে অধিবেশনে যাতায়াত বাবত এক হাজার বিশ টাকা ভাতা পাইএখন আমরা যদি ব্যাংকের দিক থেকে চিন্তা করি, ইসলামী ব্যাংক খতিবকে দেখিয়ে কত টাকা ব্যবসা করলো আর তাঁকে কত টাকা সম্মানি দিলো, তবে নিশ্চয় এক হাজার বিশ টাকা খুবই হাস্যকরআর যদি খতিবের দিক থেকে চিন্তা করি তবে তিনি হয়তো মানুষকে সূদমুক্ত ব্যাংকিং-এর দিকে উৎসাহিত করতে দ্বীনি দায়িত্ব আদায় করেছেনআর যারা অপপ্রচার করলো তারা হয়তো শত্রতা বশত কিংবা অজ্ঞতা বশত অন্ধ ছিলোসন্তানদের সাধারণ শিক্ষার ব্যাপারে তিনি বলেছিলেন-কাল্পনিক প্রশ্নআমার এক ছেলেও ইসলামী শিক্ষার বাইরে পড়ালেখা করেনিখতিব সাহেবের পরিবারকে আমরা যারা জানি সবাই এক বাক্যে বলতে পারি সত্যই তাঁর এক ছেলেও ইসলামি শিক্ষার বাইরে লেখাপড়া করেনি-তাঁর বড় ছেলে মাওলানা সাউদুল হক, দ্বিতীয় ছেলে মাওলানা আতাউল হক, তৃতীয় ছেলে মাওলানা শহিদুল হক, চতুর্থ ছেলে হাফেজ একরামুল হক মাদ্রাসারই ছাত্রএমন কি তাঁর ভাই-ভাতিজা এবং ভাগিনারাও ইসলামি শিক্ষায় শিক্ষিতআমরা ইতোমধ্যে তাঁর পিতা মাওলানা জহরুল হকের আলোচনায় আমরা দেখেছি তাঁর গ্রামে অধিকাংশ মানুষ মাদ্রাসা শিক্ষায় শিক্ষিততৃতীয় বিয়ের ব্যাপারে তাঁর পাল্টা প্রশ্ন ছিলো-তৃতীয় স্ত্রী পাইলেন কৈ যে ছাড়াছাড়ি হইবো? কিশোরগঞ্জের স্ত্রী আপনাকে চা বানাইয়া দিলো, নুডুল্স বানাইয়া খাওয়াইলো, এরপর কি কইবেন ছাড়াছাড়ি হইয়া গেছে?’ খতিব সাহেবের পরিবারের সাথে যারা সরাসরি জড়িত, তারা সাক্ষি দিয়ে বলতে পারি-তিনি দুটি বিয়ে করেছেনতাঁর কোন স্ত্রী ছাড়াছাড়ির প্রশ্নই উঠতে পারে নাএমনকি তিনি যে দুই স্ত্রীকে নিয়ে জীবন কাটিয়েছেন ওদের দুজনের ভেতর আছে সুমধুর সম্পর্কএমন কি এই পর্যন্ত কেউ বলতে পারবেন না, খতিব সাহেবের দুপরে সন্তানদের মধ্যে কোন মতানৈক্য হয়েছেকমপে আমরা শুনি নাইখতিব সাহেবের বিরুদ্ধে আরেকটি অভিযোগ ছিলো, তিনি সরকারি চাকুরি করে জুমার নামাজে সরকার বিরোধী বক্তব্য রাখতেনতিনি এই অভিযোগের উত্তরে বলেছিলেন-কোনদিন সরকার বিরোধী বক্তব্য রাখিনিতবে শরিয়তের মাসআলা নিয়ে কথা বলেছিতা কারো বিরুদ্ধে চলে গেলে আমার করার কি আছে? যেমন শেখ মুজিবুর রহমানের ছবির প্রতি সম্মান প্রদর্শনের বিষয়ে শরিয়তের মাসআলা অনুযায়ি কথা বলেছিহাসিনা-খালিদার মধ্যে কে নেতৃত্বে যোগ্য জানতে চাইলে তিনি বলেন-নাউযুবিল্লাহ, আমি রাজনীতি করি না
৩) আওয়ামীলীগ সরকার মতায় আসার পর ১৯৯৭/৯৮ খ্রিস্টাব্দে মাওলানা উবায়দুল হককে খতিবের পদ থেকে সরানোর উদ্যোগ নিয়েছিলোকিন্তু সারাদেশের মুসল্লি এবং আলেম সমাজের তীব্র প্রতিবাদ-আন্দোলনের কারণে শেষ পর্যন্ত সরকার তার সিদ্ধান্ত পরিবর্তনে বাধ্য হয়সেই সময় ইসলামিক ফাউণ্ডেশন আয়োজিত বায়তুল মোকাররম চত্বরে মাহে রবিউল আউয়ালের উদ্ভোধনী অনুষ্ঠানে তৎকালিন ফাউন্ডেশনের আওয়ামী সমর্থক পরিচালক মাওলানা আব্দুল আউয়াল কর্তৃক খতিব সাহেবকে দাওয়াত না দিলে মুসল্লিরা ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেনএই ক্ষুব্ধতার ফলে ঘটে কিছু অপ্রীতিকর ঘটনাতৎকালিন ইসলামিক ফাউন্ডেশন কর্তৃপ ইচ্ছেকৃত এই ঘটনার জন্য খতিব সাহেবের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনেতবে তদন্তের পর কোন সংস্থাই তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ করতে পারেনি
৪) ইসলামিক ফাউন্ডেশন ষড়যন্ত্র মামলায় পরাজিত হয়ে আওয়ামীলীগ সরকার খতিব সাহেবের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন ব্যুরোর মাধ্যমে মামলা করেএই মামলায়ও সরকার পরাজিত হয়তদন্তের পর একটি টাকারও দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণ করতে পারেনি
৫) আওয়ামীলীগ সরকার যখন মামলা-অভিযোগের ষড়যন্ত্রে বার বার ব্যর্থ হলো খতিব সাহেবকে বায়তুল মোকররমের খতিবের পদ থেকে সরাতে তখন হাস্যকর ৭৩ বয়েসের অভিযোগে তাঁকে ২০০১ খ্রিস্টাব্দের ২২ এপ্রিল খতিব পদ থেকে অব্যাহতি দেয়ার চিঠি দেয়শেষ পর্যন্ত বিচারপতি এম এ আজিজ ও বিচারপতি শামসুল হুদার সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের ডিভিশন ব্রাঞ্চ সরকারের এই সিদ্ধান্তকে অবৈধ ঘোষণা করে
৬) অনেকে অপপ্রচার করতেন যে খতিব মাওলানা উবায়দুল হক জামাতে ইসলামির লোকএই বিশ্বাস কারো কারো আরো দৃঢ় হয় যখন তিনি দাওয়াতুল ইসলাম ইউকের খতমে নাবুওয়াত সম্মেলনে ইংল্যান্ড যানএ বিষয়ে আমাকে অনেকে ব্যক্তিগতভাবে প্রশ্নও করেছেনআমি খতিব সাহেবের দেওয়া উত্তরকেই সাবার কাছে উপস্থাপনের চেষ্টা করেছিউল্লেখ্য যে, দাওয়াতুল ইসলাম ইউকে এক সময় জামাতে ইসলামী বাংলাদেশের বৃটেনিয় সংস্করণ ছিলোপরে ইষ্ট লণ্ডন মসজিদের কর্তৃত্বকে কেন্দ্র করে এই সংগঠনের ভেতর সংঘাত শুরু হয়ে যায়এই সংঘাতের এক পর্যায়ে অধ্যাপক গোলাম আযম, মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী, মাওলানা দেলওয়ার হোসেন সাঈদি প্রমূখ শীর্ষস্থানীয় জামাত নেতারা ইষ্ট লন্ডন মসজিদের ননসিলেটী নেতাদের প নিলে সিলেটের মাওলানা আবু সাঈদ, আব্দুস সালাম, হাফেজ মাওলানা লুৎফুর রহমান, মাওলানা শরিফ মুহাম্মদ আব্দুল কাদের প্রমূখরা বাংলাদেশ জামাতে ইসলামীর সাথে বিদ্রোহ করেনদাওয়াতুল ইসলাম এবং ইষ্ট লন্ডন মসজিদ নিয়ে এরপর দীর্ঘদিন মামলা চলে বৃটেনের আদালতে দুই গ্রুপের মধ্যেশেষ পর্যন্ত মাওলানা আবু সাঈদ এবং আব্দুস সালাম গ্রপ মামলায় জিতে দাওয়াতুল ইসলামপেয়ে গেলেও ইষ্ট লন্ডন মসজিদ হারিয়ে ফেলেনএই থেকে শুরু হয় দাওয়াতুল ইসলামের সাথে কেন্দ্রীয় জামাতে ইসলামির সংঘাতসেখানে জামাতে ইসলামির নতুন সংগঠন হিসেবে আত্মপ্রকাশ ঘটে ইসলামিক ফোরাম ইউকেকেন্দ্রের অসহযোগিতার ফলে দাওয়াতুল ইসলামের সাংগঠনিক অবস্থা দূর্বল হয়ে পড়লে তারা বাংলাদেশ থেকে অধ্যাপক ফরিদ আহমদ রেজাকে অফিস সেক্রেটারীর চাকুরি দিয়ে ইংল্যান্ড নিয়ে যানউল্লেখ্য যে, অধ্যাপক ফরিদ আহমদ রেজা এক সময় ইসলামী ছাত্র শিবিরের কেন্দ্রীয় সেক্রেটারী জেনারেল ছিলেনএই সময় আহমদ আব্দুল কাদের (যিনি তৎকালিন সময় আব্দুল কাদের বাচ্চু নামে পরিচিত ছিলেন) ছিলেন কেন্দ্রীয় সভাপতিএক পর্যায়ে এসে অধ্যাপক গোলাম আযম ও মাওলানা মতিউর রহমান নিজামি প্রমূখ জামাত নেতাদের সাথে শিবির নেতাদের মতানৈক্য হলে শিবির জামাত থেকে বেরিয়ে আসার ঘোষণা করে এবং পুরাতন সাথীদেরকে নিয়ে গঠন করে ইসলামি যুব শিবিরএই ইসলামি যুব শিবির এবং ইসলামী ছাত্র শিবির প্রথমে হযরত হাফেজ্জী হুজুর (র.) এর সাথে খেলাফত সংগ্রাম পরিষদে যোগ দেয়এক সময় হাফেজ্জী হুজুরের সাথে শায়খুল হাদিসের মতানৈক্য হয় এবং শায়খুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হকের খেলাফত আন্দোলনের সাথে ইসলামী যুব শিবির মিলে হয়ে যায় বাংলাদেশ খেলাফত মজলিশএই খেলাফত মজলিশের প্রতিষ্ঠাকালিন কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য অধ্যাপক ফরিদ আহমদ রেজা এক সময় দাওয়াতুল ইসলামের অফিসে চাকুরি নিয়ে ইংল্যান্ড চলে গেলেনসাংগঠনিক ধারাবাহিকতায় তিনি পরবর্তিতে দাওয়াতুল ইসলামের কেন্দ্রীয় আমীর নির্বাচিত হনঅধ্যাপক ফরিদ আহমদ রেজা দাওয়াতুল ইসলামের কেন্দ্রীয় আমীর নির্বাচিত হয়ে তিনি গোটা ইংল্যান্ডে দাওয়াতুল ইসলামের উদ্যোগে খতমে নাবুওয়াত সম্মেলনের আয়োজন করেনএই সম্মেলনে আন্তর্জাতিক তাহাফফুজে খতমে নাবুওয়াত বাংলাদেশের সভাপতি হিসাবে খতিব মাওলানা উবায়দুল হককে দাওয়াত করা হলে তিনি তাঁর বক্তব্য নিয়ে এই সম্মেলন গুলোতে অংশগ্রহণ করেনতখন বৃটেনে কোন কোন লোক খতিব সাহেবের বিরুদ্ধে অপপ্রচার শুরু করেন জামাতে চলে গেছেন বলেকেউ কেউ বিষয়টি নিয়ে খতিব সাহেবের সাথে বসার আগ্রহী হয়ে উঠলে তিনি তাদেরকে সময় দিলেনসেদিনের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তরে খতিব সাহেব স্পষ্ট বলেছিলেনÑ‘হযরত রাসুল (স.)তো আবু জেহেলের বাড়িতেও যেতেন, আর ওরাতো কমপে মুসলমানআমিতো মন্দির, গির্জা যেখান থেকে দাওয়াত পাই সেখানে যাই আমার কথা বলার জন্যআপনারা কি শায়খুল ইসলাম মাওলানা সাইয়েদ হোসেন আহমদ মাদানি(র.) থেকে বেশি দেওবন্দি হয়ে গেলেনআমি দেওবন্দে, বাঁশকান্দিতে হযরতের সংস্পর্শে দীর্ঘদিন ছিলামতিনি মাওলানা মওদুদী সাহেব কিংবা জামাতে ইসলামির বিরোধীতা করেছেন, কিন্তু তিনি এটাকে মিশন বানিয়ে নেননিমতানৈক্য থাকতে পারে, কিন্তু শত্রতা নয়বিশ্বব্যাপি মুসলিম উম্মাহ এখন বিশাল বিপদের মুখোমুখি, এই প্রোপটে আমাদের ঐক্য হতে পারে কিছু মৌলিক বিষয়ের উপরজামাতে ইসলামির সাথে আমাদের ইখতিলাফ আছে, কিন্তু তাদের কাছে যাওয়া যাবে না, বসা যাবে না, কথা বলা যাবে না, এমনতো নয়শুধু জামাতে ইসলামী নয়, অন্যান্য ইসলামী গ্রুপগুলোর সাথেও আমাদের সু-সম্পর্ক গড়তে হবে ইখতেলাফের বিষয় ইখতেলাফে রেখেএটা আমাদের আকাবির উলামাদের উসূলআরে ভাই, মদিনার মসনদেতো ইহুদিদের সাথেও রাজনৈতিক, সামাজিক চুক্তির নিদর্শন রয়েছেখতিব সাহেবের এইসব উদার বক্তব্যকে কেন্দ্র করে অনেকে তাঁকে জামাতের সাথে একাকার করে ফেলেনআসলে তিনি কোন রাজনীতিই করতেন নামৃত্যুর কয়েকদিন আগে আমি এবং সাংবাদিক সেলিম আউয়াল তাঁর সাাৎকার গ্রহণে গেলে সেলিম ভাই যখন জানতে চাইলেনÑমতিউর রহমান নিজামীর দলের সাথে আপনার কোন সম্পর্ক আছে কি না? তখন খতিব সাহেব স্পষ্ট করে বলে দেনÑনাইতবে এই সাাৎকারের অন্য একটি প্রশ্নে সেলিম ভাই যখন জানতে চাইলেনÑজামাতে ইসলামির বর্তমান আমীর মাওলানা নিজামী কি আপনার ছাত্র ছিলেন? তখন খতিব সাহেব স্পষ্ট ভাষায় নিজামী সাহেবের কিছু প্রশংসা করে হাঁবলেনমোট কথা খতিব মাওলানা উবায়দুল হক সাদাকে সাদা এবং কালোকে কালো বলতে কারো চোখ কিংবা মনের দিকে চেয়ে কথা বলতেন নাতবে উম্মতের প্রতি তাঁর ভেতরে প্রচুর দরদ ছিলো বলে তিনি চাইতেন আজকের এই সংকটময় মূহূর্তে গোটা মুসলিম উম্মাহ এক প্লাটফরমে এসে দাঁড়িয়ে যাক
প্রকাশিত গ্রন্থসমূহখতিব মাওলানা উবায়দুল হক (র.) প্রকাশিত বেশ কিছু গ্রন্থ রয়েছেতন্মধ্যে উলেখযোগ্য-
১) তরিখে ইসলাম, দুই খণ্ড, এই গ্রন্থে একজন পাঠক পাবেন জাহিলিয়াত ও ইসলামের শুরু থেকে বাংলাদেশ পর্যন্ত ইতিহাসের অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়মূলগ্রন্থ উর্দু
২) সিরাতে মোস্তফা, মূলগ্রন্থ উর্দু, এটা নবী হযরত মুহাম্মদ (স.)এর জীবন ও চরিত্র নিয়ে রচিত
৩) তাসহীলুল কাফিয়াকাফিয়ার উর্দু শরাহএটা মূলত মাদ্রাসার শিক্ষক-ছাত্রদের জন্য পাঠ-উপযোগি করে লেখা
৪) আযহারুর আযহারনূরুল আনওয়ারের দ্বিতীয় অংশের উর্দু শরাহএটাও মূলত মাদ্রাসার ছাত্র-শিকদের পাঠ্য বই
৫) নসরুল ফাওয়ায়িদ (শরাহ ও নোট শরহে আক্বায়িদ, উর্দু)
৬) আস সেক্বায়াশরহে ওয়াক্বেয়া দ্বিতীয় খণ্ডের উর্দু অনুবাদ
৭) শিয়া সুন্নী এখতেলাফ, মূলগ্রন্থ উর্দু, শিয়া সুন্নি বিরোধ নামে তা বাংলায় অনুবাদ হয়েছে
৮) শরহে শিকওয়া ও জওয়াবে শিকওয়া
৯) কুরআন বুঝিবার পথ (বাংলা)
১০) কুরআনে হাকীম আওর হামারী যিন্দেগীরেডিও পাকিস্তানে পঠিত উর্দু কথিকা সমগ্রএটা বাংলা অনুবাদ হয়েছে
খতিব সাহেবের আরবি ভাষায় পাণ্ডিত্য খতিব সাহেব পৃথিবীর অন্য যে কোন ভাষা থেকে আরবি ভাষায় ছিলেন দসাহিত্যের দিকে তিনি নিজের মাতৃভাষা বাংলা থেকেও আরবিতে ছিলেন বেশি পারদর্শিযার বাস্তব প্রমাণÑতিনি ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দের আগষ্ট ও ১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দের মে মাসে দুবার আরবি বক্তৃতা প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে প্রতিবারই প্রথম স্থান লাভের গৌরব অর্জন করে ছিলেনএ প্রতিযোগিতা মাদরাসা-ই আলিয়া ঢাকার প্রিন্সিপাল শায়খ শরফুদ্দীন(র.)এর পৃষ্ঠপোষকতায় পাকিস্তান জমিয়তে লিসানুল কুরআন-এর তত্ত্বাবধানে অনুষ্ঠিত হয়েছিলো
খতমে নবুওয়ত আন্দোলনের নেতৃত্বে খতিব সাহেব হযরত মুহাম্মদ (স.) সর্বশেষ নবী এবং রাসুলএই কথা হলো খতমে নবুওয়াতের দাবিঈমান এবং আকায়েদের দিকে খতমে নাবুওয়াতএর প্রতি বিশ্বাস রাখা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কেউ যদি এই বিশ্বাস না রাখে তবে সে মুসলমান থাকবে নাভারতের কাদিয়ান শহরের মির্জা গোলাম আহমদ বৃটিশ শাসন যুগে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় নিজকে নবী দাবি করে বসে(নাউযুবিল্লাহ)সে তার এই দাবির পে বিভিন্ন কৌশলি প্রচার চালিয়ে এবং ইসলামের শত্রদের সহযোগিতায় কিছু মানুষকে বিভ্রান্ত করতে থাকেবাংলাদেশেও ইসলাম সম্পর্কে মূর্খ কিছু লোককে বিভিন্নভাবে তার পে তৈরি করে ফেলেএই বিভ্রান্তি থেকে মানুষকে বাঁচানোর জন্য বিশ্বব্যাপি খতমে নাবুওয়াত আন্দোলনের প্রয়োজন দেখা দেয়বাংলাদেশও এই প্রয়োজন থেকে খালি নয়উলামায়ে কেরাম শুরু করেন বাংলাদেশে খতমে নাবুওয়াত আন্দোলনএই আন্দোলন এক পর্যায়ে সাংগঠনিক রূপ নেয় আন্তর্জাতিক মজলিশে তাহাফফুজে খতমে নবুওয়াত বাংলাদেশনামেখতিব সাহেব এই সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি না হলেও তাঁর নেতৃত্বে তা প্রাঞ্জল হয়ে দেশ-বিদেশের বাংগালী মুসলমানদের ভেতর জাগরণ সৃষ্টি করেছেতাঁর নেতৃত্বে কাদিয়ানী স¤প্রদায়ের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী আন্দোলনের ফলে ২০০৪ খ্রিস্টাব্দে সরকার কাদিয়ানী স¤প্রদায়ের সকল প্রকাশনা মুদ্রণ ও বিতরণ নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে বাধ্য হয়মাওলানা উবায়দুল হকের ডাকে এবং তাঁর সভাপতিত্বে ঢাকায় প্রতি বছর মজলিসে তাহাফফুজে খতমে নাবুওয়তের বিশাল আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হতোতিনি সভাপতি থাকাকালিন সময়ে এই আন্দোলন কোন রাজনীতিক দলের সাথে সম্পৃক্ত হয়নিফলে দেখা গেছে খতমে নবুওয়াত আন্দোলনে দল-মত নির্বিশেষে এদেশের সকল শ্রেণীর তাওহিদী জনতা অংশ গ্রহণ করতেনখতিব সাহেবের রাজনৈতিক জীবন নেজামে ইসলাম পার্টির নেতা মাওলানা আতহার আলী (র.) খতিব মাওলানা উবায়দুল হককে মুফতি শফি (র.)এর দারুল উলূম করাচি থেকে ঢাকায় নিয়ে এসেছিলেন মূলত নেজামে ইসলাম পার্টির প্রচার ও প্রকাশনা বিভাগের দায়িত্ব সোপর্দ করতেসোপর্দ করেছিলেনওতবে তিনির দায়িত্ব লাভের অল্পদিন পর কেন্দ্রীয় সরকার পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক সরকার ভেঙ্গে সকল রাজনৈতিক দল বেআইনী ঘোষণা দিয়ে যাবতীয় কার্যকলাপ বন্ধ করে দেয়যার ফলে নেজাম ইসলাম পার্টির সকল তৎপরতা বন্ধ হয়ে যায়এরপর তিনি ঢাকা আলিয়া মাদ্রাসায় শিকতা শুরু করলে আর কোনদিন সক্রিয় দলীয় রাজনীতিতে আসেননিতিনি রাজনীতিতে সক্রিয় না হলেও বিভিন্ন সময় জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের কর্যকরি কমিটি তাঁকে সদস্য রেখেছেখতিব মাওলানা উবায়দুল হকের রাজনৈতিক জীবন বলা যেতে পারে ছোটবেলা থেকেইকিন্তু সক্রিয় রাজনীতিতে তিনি খুবই অল্পদিন ছিলেন৪৭ পূর্ব ভারতের রাজনীতিতে তিনি জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের সাথে ছিলেনজমিয়তে উলামায়ে হিন্দের সাথে নয়তৎকালিন সময় জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম আর জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের মধ্যে ব্যবধান ছিলোশায়খুল ইসলাম হযরত মাওলানা সাইয়েদ হোসেন আহমদ মাদানি (র.)এর নেতৃত্বাধীন জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ ছিলো যুক্ত ভারতের পে আর শায়খুল ইসলাম মাওলানা শিব্বির আহমদ উসমানি (র.) ছিলেন মুসলমানদের জন্য পৃথক স্বাধীন ভূমি পাকিস্তান তৈরির পক্ষে পাকিস্তান হওয়ার পরও বিশেষ করে সিলেট অঞ্চলে জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের বিশাল প্রভাব রয়ে গিয়েছিলোহযরত মাদানি (র.)এর খলিফা হাফেজ মাওলানা আব্দুল করিম শায়খে কৌড়িয়া (র.) ছিলেন জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের নেতা, আর জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের নেতৃত্বে ছিলেন হাকিমুল উম্মাত হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানবি (র.)এর খলিফাদ্বয় হযরত মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরি ও হযরত মাওলানা আতহার আলী (র.) প্রমূখকেন্দ্রীয়ভাবে স্বয়ং হাকিমুল উম্মাত মাওলানা আশরাফ আলী থানবি (র.)ও ছিলেন জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের পক্ষেআমরা জানি যে, খতিব সাহেবের বাবা ছিলেন হযরত থানবি (র.)এর খলিফাতাই এটাই বাস্তবতা যে, খতিব সাহেব চিন্তাগতদিকে জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের পক্ষে থাকবেন, কারণ তখনও পিতা থেকে রাজনৈতিক ভিন্নমত করার মতো তাঁর বয়স হয়নিআর অন্যদিকে ছোটবেলা খতিব সাহেব ঘুংগাদিতে হযরত মাওলানা আতহার আলী সাহেবের মাদ্রাসার ছাত্র ছিলেনএই সব বিভিন্ন কারণে খতিব সাহেব ছোটবেলা থেকেই জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের পে কাজ করেছেন, জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের পে যাননিএক সময় জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বিভিন্ন ইসলামী দলের সাথে মিলে খতিবে আজম মাওলানা সিদ্দিক আহমদ (র.)এর নেতৃত্বে নেজামে ইসলাম হয়ে যায়হযরত খতিব সাহেব (র.) নিজে আমাদেরকে বলেছেন- তবে তখনও নেজামে ইসলাম পার্টির নামকরণ হয় নাই, তখন নাম ছিলো জমিয়তে উলামায়ে ইসলামতখন আমি বাচ্চা মানুষ ছিলাম, তবে তাদের সাথে সহযোগী ছিলামমাওলানা আতহার আলী সাহেব ছিলেন জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের সভাপতিএরপর আমরা যখন জানতে চাইলাম-জমিয়তের প্রচার সম্পাদকের দায়িত্বে কোন সময় ছিলেন? তখন তিনি বলেন-যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনের সময়, অর্থৎ ৫১ থেকে ৫৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্তআবার যখন জানতে চাইলাম-তা হলে আপনি যুক্তফ্রন্টের পক্ষে নির্বাচনী প্রচারে অংশ নিয়ে ছিলেন? তখন খতিব সাহেব বলেন- না, আমি অংশ নিতে পারি নাই, তখন আমি করাচিতে ছিলামতবে ঐখান থেকে তাদের পে বয়ান পত্র-পত্রিকায় প্রচার করে কিছুটা অংশ নিয়েছিপরবর্তীতে আপনি জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের আর কোন দায়িত্ব পালন করেছেন কি না জানতে চাওয়া হলে খতিব সাহেব বলেন- না, কোন দায়িত্ব ছিলো নাআমি এমনি অনারারি সদস্য ছিলাম জমিয়তে উলামায়ে ইসলামেরতবে নথিতে আমাকে আর সদস্য হিসেবেও লিপিবদ্ধ করা হয়নিতা হলে রাজনীতির সাথে সক্রিয় কখনো জড়িত ছিলেন না? জিজ্ঞাস করা হলে খতিব সাহেব বলেন-জি নাতা হলে আমরা খতিব মাওলানা উবায়দুল হকের নিজের ভাষ্য থেকেই জানলাম- তিনি কোনদিন দলীয় রাজনীতির মাঠে সক্রিয় ছিলেন নাকিন্তু আমরা যারা তাকে জানি তারা কি অস্বীকার করতে পারবো যে, তিনি আজীবন দেশ, জাতি এবং ইসলামের শত্রদের সকল ষড়যন্ত্র উদঘাটিত করতে, সাধারণ মানুষকে এ ব্যাপারে সতর্ক ও সচেতন করতে ময়দানে সর্বদা অগ্রণী ভূমিকা রাখেননি? নিশ্চয় পারবো নাজাতির প্রতিটি সংকটে তাঁর সাহসী ভূমিকা ইতিহাসে স্বর্ণারে লেখা থাকবেএই ভূমিকার নাম কি রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের দৃষ্টিতে বুদ্ধিভিত্তিক রাজনীতি নয়? আবশ্যই এগুলো রাজনীতি, কিন্তু তা দলীয় সংকীর্ণতায় আবদ্ধ নয়স্বাধীনচেতা মাওলানা উবায়দুল হক জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমে জুমআর বক্তৃতায় সর্বদা ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক নতুন-পুরাতন সকল নীতির জোর প্রতিবাদ করতেনতিনি তাঁর উদার ভালোবাসানীতি দিয়ে ইসলামী রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক সকল দল ও সংগঠনসমূহের পারস্পরিক দূরত্ব কমিয়ে আনার চেষ্টা করতেনযে কোন দ্বীনি সংগঠন কিংবা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ও মতবিরোধ দূর করার কাজে তিনি সর্বদা প্রাণ খুলে নিরপেভাবে কাজ করতেনফলে উলামায়ে কেরাম থেকে সাধারণ সমাজ পর্যন্ত সবার কাছে তিনি ছিলেন একজন নিরপে ন্যায়বিচারক ব্যক্তি হিসেবে খ্যাতবিভিন্ন শ্রেণীর মানুষ নিজেদের সমস্যা, অভাব-অভিযোগ নিয়ে সর্বদা তাঁর কাছে ছুটে যেতেনজাতীয় পর্যায় থেকে শুরু করে গ্রাম পর্যায় পর্যন্ত মানুষ তাঁর কাছে ছুটে যেতো সমস্যা সমাধানের জন্যতিনি একজন বাস্তবতাবাদি পরিপূর্ণ মানুষ ছিলেন
দৈনিক প্রথম আলো সম্পাদকের তাওবাহ প্রসঙ্গখতিব মাওলানা উবায়দুল হকের ইন্তেকালের মাত্র কয়েকদিন পূর্বের ঘটনাদৈনিক প্রথম আলো পত্রিকার আলপিনে ইসলাম ধর্মকে কটা করে কার্টুন প্রকাশিত হলে তাওহিদী জনতার বিবেকী কণ্ঠ খতিব মাওলানা উবায়দুল হক এবং সারাদেশের তাওহিদী জনতা গর্জে উঠেন এক সাথেদৈনিক প্রথম আলো কর্তৃপ বুঝতে পারে তারা কি ভুলটা করেছেতাদের চলার পথ প্রায় অন্ধকারতারা এখন নিজেদের ভুলের জন্য জাতির কাছে মা চেয়ে ভুল সংশোধন করতে চায়প্রথমে জাতীয় পত্রিকার সম্পাদকদ্বয় বসেন এই সমস্যা নিরসনের পথ খুঁজতেতাঁরা তাদের বৈঠক থেকে তিন সদস্য বিশিষ্ট একটি টিম প্রেরণ করেন খতিব সাহেবের কাছেএই টিমের একজন সদস্য ছিলেন দৈনিক যুগান্তরের সিনিয়র রিপোর্টার বন্ধুবর সেলিম জাহিদসেলিম জাহিদ তাঁর ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণ একজন রিপোর্টার এবং খতিব উবায়দুল হকশীর্ষক লেখায় লিখেছেন-খতিব মাওলানা উবায়দুল হকের সাথে আমার শেষ দেখাটি হয়েছিলো তাঁর আজিমপুরের বাসায়মৃত্যুর ১৮দিন আগে গত ১৮ সেপ্টেম্বর, ৫ রমজান রাতেশীর্ষ স্থানীয় বাংলা দৈনিক প্রথম আলোর বিতর্কিত কার্টুন নিয়ে হইচই শুরুর দিনমধ্যস্থতার অনুরোধ পেয়ে তিন সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল নিয়ে ওই রাতে হুজুরের বাসায় যাই।(বিষয়টি এমন নয় যে, আমি খতিবের ওপর প্রভাব বিস্তার করার মতো কোন ব্যক্তি বা আমার মধ্যস্থতায় কোন সমাধান হয়েছে)খুব দরদ দিয়ে নিজ হাতে আপ্যায়ন করালেনএকজন সংবাদকর্মীর সঙ্গে দেশের একজন শীর্ষ আলেমের এমন দরদ ছিল অকল্পনীয়সেদিনের ওই বৈঠকের কথা এখনও কানে বাজে১৮ সেপ্টেম্বরের প্রথম আলো হাতে খতিব বলেন- অপরাধ করলেন এত বড়, আর মা চাইলেন দেড় ইঞ্চির-আলেম সমাজ এই মা মানে নাশেষ কথাটি ছিল- অন্তর দিয়ে মা চাইলে পত্রিকায় এর প্রভাব পড়বে’ (পত্রিকায় প্রকাশের পূর্বেই সেলিম জাহিদ আমাকে এই স্মৃতিচারণ দিয়েছিলেন পড়ার জন্যআমার এই লেখা তৈরির পূর্ব পর্যন্ত তা কোন পত্রিকায় প্রকাশ পায়নি)এই তিন সদস্যের আলোচনার ভিত্তিতেই পরবর্তিতে ২০ সেপ্টেম্বর ০৭, শুক্রবার দুপুরে প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান কয়েকটি জাতীয় পত্রিকার সম্পাদককে সাথে নিয়ে আইন উপদেষ্টা ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন এবং ধর্ম উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) ডা. মতিউর রহমানের সাথে বৈঠক করেনবৈঠকে প্রথম আলো সম্পাদক সরকারের যে কোন শর্ত মেনে নেওয়ার কথা জানানবিকেলে প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমানকে নিয়ে আইন উপদেষ্টা, ধর্ম উপদেষ্টা, দৈনিক যুগান্তর সম্পাদক গোলাম সারোয়ার, ইন্ডিপেন্ডেন্ট সম্পাদক মাহবুবুল আলম, আমাদের সময় সম্পাদক মাঈনুল ইসলাম খান, মানব জমিন সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী জাতীয় মসজিদ বায়তুল মুকাররমের খতিব মাওলানা উবায়দুল হকের সাথে দেখা করেনইসলামিক ফান্ডেশনের ইফতার মাহফিল এবং মাগরিবের নামাজ শেষে দেশের শীর্ষস্থানীয় এই ব্যক্তিবর্গের বৈঠক বসে খতিব সাহেবের সাথেএই বৈঠকে অন্যন্যের মধ্যে আরো উপস্থিত ছিলেন-বায়তুল মোকাররম মসজিদের পেশ ইমাম মুফতি মাওলানা নুরউদ্দিন, তামিরুল মিল্লাত কামিল মাদ্রাসার অধ্য মাওলানা যইনুল আবেদিন, ইসলামিক ফান্ডেশনের মহা পরিচালক মুহাম্মদ ফজলুর রহমান, খেলাফত মজলিস নেতা মাওলানা মাসুম বিল্লাহ, আহলে হাদিস যুব সংঘের আবদুল ওয়াদুদ সহ আরো কিছু ইসলামী দলের নেতাএই বৈঠকে আলোচনার মাধ্যমে প্রথমে দৈনিক প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান অঙ্গিকারনামা পেশ করেন যে, ‘ভবিষ্যতে আলপিন ম্যাগাজিন আর প্রকাশ করা হবে না এবং প্রথম আলোতে ভবিষ্যতে পবিত্র ইসলাম ধর্ম নিয়ে কুৎসামূলক কোন বক্তব্য-বিবৃতি ছাপানো হবে নাপ্রথম আলো সম্পাদক এই অঙ্গিকারনামা পেশ করলে খতিব সাহেব সম্পাদক সাহেবকে উদ্দেশ্য করে বলেন-আপনার পত্রিকা শুরু থেকেই ইসলাম ও ইসলামী মূল্যবোধের বিরুদ্ধে বিভিন্ন লেখালেখি করে আসছেদেশের শতকরা ৮৫ভাগ মানুষের অনুভূতিতে আঘাত দেয়ার অধিকার আপনাকে কেউ দেয়নিমুসলমানরা মহানবী (স.)কে নিজের জীবনের চেয়ে বেশি ভালোবাসেআপনারা কার্টুন ছাপিয়ে মুসলমানদের মনে যে আঘাত দিয়েছেন তা কোন অবস্থায়ই মার যোগ্য নয়তারপরেও ভবিষ্যতে আর এ ধরনে ঘটনা ঘটবে না এবং ইসলাম ও মুসলমানদের স্বার্থবিরোধী কোনো সংবাদ ও লেখা প্রকাশ করবেন না বলে আল্লাহর কাছে আপনার অপরাধের জন্য তওবাহ করা উচিৎখতিবের বক্তব্যের পর প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান খতিব মাওলানা উবায়দুল হকের হাত ধরে তওবা করেন এবং দোয়া চানএরপর খতিব মাওলানা উবায়দুল হক উপস্থিতদের উদ্দেশ্যে যে বক্তব্য দিয়েছেন তা দৈনিক আমার দেশের ভাষ্যমতে এইÑ‘ মহান আল্লাহ তাআলা মাশীলতিনি মাকে পছন্দ করেনপ্রথম আলো সম্পাদক তার পত্রিকার মাধ্যমে মহানবী (স.)-কে অবমাননার মাধ্যমে যে অপরাধ করেছেন, তার জন্য তিনি এখন অনুতপ্ততিনি আল্লাহর কাছে তওবা করেছেন, বিষয়টি ব্যক্তিগতভাবে আমাদের সাথে সম্পৃক্ত নয়এটি সমগ্র মুসলিম জাতির আবেগ-অনুভূতির সাথে সংশ্লিষ্টতবে তিনি যেহেতু মা চেয়েছেন, তওবা করেছেন, কাজেই তার মার বিষয়টি আল্লাহ পাকই জানেনআপনারা অনেক বিজ্ঞজন এখানে এসেছেন এবং অনুরোধ করেছেনএ বিষয়ে আমার প থেকে আর কোনো ােভ নেইতবে রাষ্ট্রিয় আইনে কোন অপরাধ হলে সে বিষয়ে রাষ্ট্রই বুঝবে’ (দৈনিক আমার দেশ, ২১ সেপ্টেম্বর,২০০৭, পৃষ্টা ২)দৈনিক প্রথম আলোর ভাষ্য মতে খতিব বলেন - যেহেতু প্রথম আলো সম্পাদক উপস্থিত হয়ে বলেছেন তাদের ত্রটি হয়েছেতাঁরা দুঃখিত, জনগণের কাছে মা চেয়েছেনএরপরও আদালতে গিয়ে মা চাইতেও তারা প্রস্তুত আছেনএ অবস্থায় আমরা মনে করি এটা নিয়ে আন্দোলন করা, এটা ঠিক নাকারণ আন্তরিকভাবে মা চাওয়ার পর আমাদের নবী করিম (স.)-এর উসওয়া এবং সুন্নত হলো এটাকে মাফ করে দেওয়াআমরা আশা করি জনগণও মাফ করে দেবেভবিষ্যতে এই পত্রিকা ধর্মীয় বিষয়ে কোনো রকম সমালোচনা, বিদ্রুপে লিপ্ত হবে নাএরপর ওলামায়ে কেরাম সকলেই বলেছেন, এটা মাফ করে দেওয়া সমুচিতএতে আমারও একই মত।(দৈনিক প্রথম আলো, ২১ সেপ্টেম্বর০৭, প্রথম পৃষ্টা)এখানেই ঘটনা শেষ নয়দৈনিক প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান লিখিতভাবে ২১ সেপ্টেম্বরে নিজ পত্রিকার প্রথম পৃষ্টার লিড নিউজে আমরা দুঃখিত ও মাপ্রার্থীশিরোনামে তিন কলামে তাঁর অঙ্গিকারনামা জাতির সামনে পেশ করেছেনএই অঙ্গিকারনামায় প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান স্পষ্ট ভাষায় বলেছেনÑ‘গত ১৭ সেপ্টেম্বর প্রথম আলোর সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন আলপিন’-এ প্রকাশিত একটা অনাকাঙ্খিত, অগ্রহণযোগ্য কার্টুন-কাহিনী প্রকাশের জন্য আবারও দুঃখপ্রকাশ ও মা প্রার্থনা করছিপাশাপাশি বিষয়টিকে ভুল হিসেবে মাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখার জন্য সবার প্রতি আবেদন জানাচ্ছিওই কার্টুন-কাহিনীসংবলিত আলপিনসহ ১৭ সেপ্টেম্বরের পত্রিকা বাজারে চলে যাওয়ার পর ধরা পড়ে যে, একটা বড় অনাকাঙ্খিত ভুল হয়ে গেছেএ এমন একটা ভুল, যার পে কোনো যুক্তি যথেষ্ট নয়প্রথম আলো সব সময়ই ইসলাম ধর্ম ও ধর্মীয় আবেগের প্রতি শ্রদ্ধাশীলপাঠক ও ধর্মপ্রাণ মুসল্লিদের আবেগ ও অনুভূতিতে যাতে আঘাত না লাগে, সে ব্যাপরে আমরা সব সময় সচেতন এবং তা রায় সর্বদা সচেষ্টস্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন আসে, এত সতর্কতা, এত চেষ্টার ভেতরও কী করে এ রকম একটা সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য কার্টুন ছাপা হয়ে গেলো? বিষয়টি জানার সাথে সাথে প্রথম আলো ঘটনার কারণ অনুসন্ধান এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে শুরু করেসিদ্ধান্ত নেয়, নিঃশর্তভাবে মা চাওয়া হবে এবং সংশ্লিষ্ট দায়িত্বপ্রাপ্ত যে সহসম্পাদকের বিবেচনায় এই ভুল ধরা পড়েনি, তাঁকেও অপসারণ করা হবেপ্রথম আলো পাঠকদের অনেকেই ফোন করে জানিয়েছেন, এই কার্টুন তাঁদের আহত করেছেআমরা তাদের সমব্যথীপ্রথম আলোর সম্পাদকীয় নীতির একটি হলো-ভুল যাতে না হয় সে জন্য চেষ্টা করাতারপরও ভুল হয়ে গেলে তা বুঝার বা জানার সঙ্গে সঙ্গে সংশোধনী ছাপানো ও দুঃখ প্রকাশ করাকারণ যে পত্রিকাটি ২৫ লাখ মানুষের কাছে প্রতিদিন যায়, তাতে একটা ভুল হলে তার নেতিবাচক প্রভাবও হয় ব্যাপকঅনেক এজন্য তিগ্রস্ত হতে পারেন,অনেকে মানসিকভাবে আহত হতে পারেনএই নীতি অনুসরণ করে গত ১৮ সেপ্টেম্বর পত্রিকার মাধ্যমে প্রথম আলো এই কার্টুক-কাহিনী প্রত্যাহার করে নেয়১৯ সেপ্টেম্বর ওই প্রদায়ক কার্টুনিস্টের আর কোনো লেখা বা কার্টুন পত্রিকায় না ছাপার সিদ্ধান্ত নেয়একই সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সহসম্পাদককে অপসারণের সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে দেয় পাঠকদেরকেপ্রথম আলো পর পর দুই দিন সবার কাছে আন্তরিক দুঃখ প্রকাশ ও নিঃশর্ত মা প্রার্থনা করেপ্রথম আলোর প্রথম পৃষ্টায় এই আবেদন প্রকাশিত হয়২০ সেপ্টেম্বর প্রথম আলোর সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে-ধর্মীয় অনুভূতির প্রতি আমরা শ্রদ্ধাশীলঅনিচ্ছাকৃত ভুলটি মাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখুনসরকার গত বুধবার আলপিনের ১৭ সেপ্টেম্বরের সব কপি বাজেয়াপ্ত করে এবং প্রদায়ক কার্টুনিস্ট আরিফুর রহমানকে গ্রেফতার করেএ রকম একটা অনাকাঙ্খিত কার্টুন প্রকাশিত হওয়ার জন্য আজও প্রথম আলো দুঃখপ্রকাশ ও মা প্রার্থনা করছে আন্তরিকভাবেকারণ এই ভুলটি একেবারে অনিচ্ছাকৃত ও অসাবধানতাবশতভবিষ্যতে এ ধরণের ভুলের পুনরাবৃত্তি না করার ব্যাপারে সতর্ক থাকার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে এই পত্রিকাএকই সঙ্গে ১৩জন সম্পাদকের গতকালকের বক্তব্যের সঙ্গে আমরা একমতপ্রথম আলো আশা করে সবাই বিষয়টা মা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন’ ( দৈনিক প্রথম আলো, ২১ সেপ্টেম্বর০৭, প্রথম পৃষ্ঠা)প্রথম আলো সম্পাদক তার মাধ্যমে দেশবাসীর কাছে মা চাইলে তিনি দেশবাসীকে সহিষ্ণুতা বজায় রাখার আহবান জানানযদিও না বুঝে কেউ কেউ তখন খতিব সাহেবের এই ভূমিকার জন্য অসস্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন, কিন্তু চিন্তার পর যখন দেখেছে-এর ফলে দেশ এক ভয়াবহ রক্তয়ী সংঘর্ষ থেকে রা পেয়েছেতখন প্রায় সবাই নিরবতা প্রদর্শন করেছেনখতিব মাওলানা উবায়দুল হকের এই ভূমিকা সত্যই দেশের সর্বস্তরের মানুষের কাছে প্রসংশিত হয়েছেযারা বলেন, খতিব সাহেব এ সব সরকারের ছাপে করেছেন, তারা মূলত খতিব সাহেবকে জানেন না
সম্মান ও মূল্যায়নকর্মঠ এবং যোগ্য মানুষের কাছে প্রাপ্তিতে তৃপ্তি নেই, কর্মে তৃপ্তিখতিব মাওলানা উবায়দুল হক একজন কর্মে বিশ্বাসী আলেম ছিলেনযারা তাঁকে কাছ থেকে দেখেছেন তারা সবাই স্বীকার করবেন, তিনি কর্মের ফল দুনিয়াতে পাওয়ার বিশ্বাসী ছিলেন নাএই সব গুণের কারণেই তিনি বাংলাদেশের উলামায়ে কেরাম ও সর্বসাধারণের নিকট একজন জনপ্রিয় ও অতি সম্মানিত ব্যক্তি হয়েছেনশুধু বাংলাদেশে নয়, বিদেশেও তাঁর খ্যাতি আছেতিনি অর্ধ শতাব্দীর কর্মমুখর সফল জীবনে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা ও প্রতিষ্ঠান দ্বারা বিশেষ বিশেষ সম্মানে ভূষিত হয়েছেনসৌদি আরবের রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ মতাসম্পন্ন তত্ত্বাবধায়ক প্রতিষ্ঠান মজলিসে শুরা তাঁকে আমন্ত্রণ জানিয়ে স্বর্ণপদক প্রদান করেছেজাতীয় সীরাত কমিটি বাংলাদেশ তাঁকে ২০০৪ খ্রিস্টাব্দে বছরের সেরা ইসলামী ব্যক্তিত্ব নির্বাচিত করে স্বর্ণপদক প্রদান করেছেপবিত্র কুরআন ও হাদীসের শিকতায় বিশেষ অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ তাঁকে কোরআন শিক্ষা সোসাইটি ২০০৫ খ্রিস্টাব্দে নগদ পঞ্চাশ হাজার টাকা ও বিশেষ এ্যাওয়ার্ড প্রদান করেহোফফাজুল কুরআন ফাউণ্ডেশন বাংলাদেশ জাতীয় পর্যায়ে বিভিন্ন বিষয়ে অবদানের স্বীকৃতি হিসাবে বিশেষ পদকে ভূষিত করেএছাড়া তিনি আরো অনেক দেশী ও বিদেশী সংস্থা থেকে সম্মানজনক সনদ, ক্রেস্ট, পদক ও খেতাব লাভ করেছিলেন
বায়তুল মোকাররমে খতিব সাহেবের জীবনের শেষ খুতবাবায়তুল মোকাররমে খতিব মাওলানা উবায়দুল হক শেষ জুম্মার খুতবা দিলেন ৫ অক্টোবর ০৭কিন্তু সেদিন কে জানতো এটা তাঁর জীবনের শেষ খুতবা? অথচ সেদিন তিনি তাঁর খুতবায় বার বার বলেছ-আমার মনে হচ্ছে আজ জুম্মাতুল বিদাকিন্তু আগামী জুম্মা হচ্ছে জুম্মাতুল বিদাখতিব মাওলানা উবায়দুল হক তাঁর জীবনের শেষ খুতবায় আরো বলেন- ব্যাংকে টাকা রেখে সুদ গ্রহণ করা হারামআর সুদ খাওয়া ব্যবিচারের চেয়েও বড় অপরাধহারাম উপার্জনে গঠিত রক্ত-মাংসের জন্য জাহান্নাম অবধারিততাদের জাকাত, ফিতরা, হজ্ব সহ কোন ইবাদতই কবুল হবে নাব্যাংকের সুদ গ্রহণ এবং হারাম উপার্জন থেকে বেঁচে থাকার জন্য তিনি সকলের প্রতি আহ্বান জানানখতিব আরো বলেন- জুম্মা হলো সপ্তাহের প্রধান দিবসএ দিবসে আল্লাহ দোয়া কবুল করে থাকেনআর জুম্মার দিনে হযরত রাসুল (স.)এর উপর দুরূদ পাঠ করলে সত্তর গুণ বেশি সোয়াব হয়ে থাকেতাই জুম্মার দিন বেশি বেশি ইবাদত করা দরকারআর রমজান মাসে এমন একটি রাত রয়েছে যা হাজার মাস তথা ৮৬ বছর ৪ মাসের চেয়েও উত্তমভাগ্য নির্ধারণ করা হয় বলে এ রাতকে লাইলাতুল ক্বদর বলা হয়এ রাতে ইবাদত করলে হাজার বছর তথা ৮৬ বছর চার মাস ইবাদত করার চেয়েও বেশি সোয়াব হবেলাইলাতুল ক্বদর নির্দ্দিষ্ট করে বলা হয়নি বিধায় হযরত রাসুল (স.) রমজানের শেষ দশদিন ইতেকাফের মাধ্যমে লাইলাতুল ক্বদর তালাশ করতেনতিনি আরো বলেছেনÑ ‘সদকাতুল ফিতরা ও সম্পদের যাকাত আদায় করা জরুরীযারা সম্পদের যাকাত আদায় করে না, এই সম্পদ কিয়ামতের দিন আগুন হয়ে তাদেরকে শাস্তি দেবেআর যারা নামাজ পড়ে, হজ্ব পালন করে, আবার সুদও খায় তাদের ইবাদত আল্লাহ কবুল করবেন নাসুদ ব্যভিচারের চেয়ে বড় অপরাধআর হারাম খাদ্য দ্বারা গঠিত রক্ত-মাংস বেহেশতে যাবে নাতাই হারাম উপার্জন থেকে বেঁচে থাকা সকলের জন্য জরুরী’ ( দৈনিক সংগ্রাম, শনিবার, ৬ অক্টোবর ০৭)
খতিব সাহেবের সাথে আমার শেষ কথা-বার্তা
প্রায় বছর দিন থেকে বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা (বাসস)-এর সিলেট প্রতিনিধি গল্পকার সেলিম আউয়াল আমাকে বলছেন খতিব সাহেবের একটি সাক্ষাৎ গ্রহণের জন্যখতিব সাহেব থাকেন ঢাকায় আর আমরা থাকি সিলেটেতিনি সিলেট এলে মাঝে মধ্যে আমার সাথে দেখা হলেও সেলিম ভাইয়ের সমন্বয়ে আমি আর তিনির মুখোমুখি হতে পারছিলাম নাএভাবে সময় চলে যায় বছর দিন১৩ আগস্ট২০০৭ তিনি যখন সিলেট দরগাহ মাদ্রাসার খতমে বোখারী উপলে সিলেট আসেন, তখন এই সন্ধায় সেলিম ভাইকে নিয়ে হাজির হই সিলেট শহরস্থ তাঁর মিতালী রোডের দশ নম্বার বাসায়তাঁর সাথে অতীতে আমার অনেক কথা হয়েছে পারিবারিক থেকে সামাজিক, রাজনৈতিক, মাসআলাগত, আলেমদের ঐক্য-অনৈক্য ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়েকোনদিন তিনি আমার প্রতি ক্ষুব্ধতা প্রকাশ করেননিএমনকী তাঁর অনেক ক্ষুব্ধ সময়ে আমি মুখোমুখি হয়ে দেখেছি তিনি আমার কাছে ক্ষুব্ধতার কারণ ব্যাখ্যা দিয়ে শান্ত হওয়ার অভিনয় করেছেনকিন্তু আজকের সাক্ষাৎকারের বিষয় তাঁর আত্মজীবনী শুনে প্রথমে ক্ষুব্ধ হয়ে বললেন- আমি আত্মপ্রচার চাই নারাখেন এই সব ফাইজলামিসেলিম ভাই রিতিমতো কেঁপে উঠলেনআমি খতিব সাহেবকে ভালো রকম জানিকি ভাবে তাঁকে কাবুতে আনতে হবে সেই কৌশলও কিছুটা আমার আয়ত্বে আছেআমার একটা দৃঢ় বিশ্বাস তিনি আমাকে খুব করেন, স্নেহ করেন, ভালোবাসেনআমি এই সম্বল নিয়ে মুখের উপর বলে বসলাম- আপনাকে আত্ম প্রচার করতে আমরা বলছি না, কিন্তু আপনার অভিজ্ঞতার ভেতর এমন কিছু ঘটনাও যে আছে যা দেশ-জাতি এবং আগামি প্রজন্মের জন্য জানা খুবই জরুরীএই স্বার্থে উচিৎ ছিলো আপনার নিজের আত্মজীবনী লিখে যাওয়াকিন্তু তাতো করবেন নাএখন আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি আপনি সিলেট আসলেই আমরা এসে হাজির হবো এবং প্রশ্ন করে করে ভেতর থেকে কথা বের করে রেকর্ড করবোআপনি সময় না দিলেও আমরা সময় আদায় করে নেবোতিনি হাসলেন আমার কথা শোনেহাসলাম আমি এবং সেলিম ভাইওঅনুমতি পেয়ে আমি টি টেবিলটা টেনে একেবারে তাঁর মুখোমুখি হাটুতে হাটু লাগিয়ে টেপরেকর্ডার নিয়ে বসে প্রশ্ন শুরু করি-আপনি কওমী মাদ্রাসায় পড়তে গেলেন কি ভাবে, আপনার লেখা-পড়ার উদ্দেশ্য কি ছিলো? খতিব সাহেব-আমার পিতা হলেন দারুল উলূম দেওবন্দের ছাত্রতিনি দেশে পড়ছেন বিভিন্ন মাদ্রাসায়ঢাকার পরসিদ্ধ মাদ্রাসা ছিলো ভিক্টোরিয়া পার্কের ইখানে, পরে এইটার নাম হইছে ইসলামিক ইন্টারমেইটেড কলেজ, কিন্তু আগে নাম ছিলো তার অন্যপরথমে এই মাদ্রাসা পাশ করছেন পরে তিনি দেওবন্দ গেছেনতিনি সাহরানপুরও কিছু পড়ছেনতবে দেওবন্দ পড়ছেন দওরায়ে হাদিসউপমহাদেশের পরসিদ্ধ মুহাদ্দিস সৈয়দ আনোয়ার শাহ কাশ্মিরী (র.) তিনির বিশেষ উস্তাদএর পরে সেখান থেকে তিনি থানাবন যানওখানে হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানবী (র.)-এর খেদমতে থাকেন, বয়আত হন, এরপরে দেশে ফিরিয়া আসেনফিরিয়া আসিয়া (আমরা শোনছি, আমাদের জন্মের আগেরই কথা হইবে) তিনি ঢাকা ক্বাসিমুল উলূম নামী মাদ্রাসা, মাওলানা মুফতি দীন মুহাম্মদ সাহেব যেটা পরতিষ্টিত করেছিলেন বেগম বাজার মসজিদ সংলগ্ন, ঐটায় কিছুদিন পড়াইছেনএরপরে মুফতি দীন মুহাম্মদ সাহেব গেলেনগি বরমায়, মাদ্রাসায় কিছু অনিয়ম দেখা দিলোতখন বাড়িতে আসিয়া পড়লেনএই সময় কিছু ছাত্রও উনার কাছে আসিয়া ভিড়লো পড়বার জন্যতাদেরে পেরাইভেট পড়াইতেন গ্রামের মসজিদের বারান্দায়এই ছিলো পরথম উনার মাদরাসাএরপরে মসজিদের দণি পাশে একটা ছন-বাঁশের ঘর তৈয়ার করলেন, বাইরের ছাত্ররা থাকার জন্যঐ সময় আমরার কিছু সুদবুদ হইছে, ওনিই পড়াইছেন আমাদেরকেঐ মসজিদে থাকিয়াই আমরা কোরআন শরিফ পড়ছিএরপরে উর্দু, ফার্সি পারথমিক কিতাবাদি কিছু পড়ছিএকবার আমাকে পাঠশালা ইস্কুল, বাবুর বাড়ি, নিজ গ্রাম, বারঠাকুরী সংলগ্ন, ওখানে পাঠাইলেন এবং বললেন যে, তুমি ইস্কুলে কিছু পড়, পারথমিক শিা লাভ করোআমি ঐখানে গেলামবাবুর বাড়ির ইস্কুল, মাষ্টার-শিক তারা খুবই মেধাবি এবং যোগ্য কিন্তু তাদের আচরণ ছিলো হিন্দুয়ানীযেমন, সালামের জায়গায় আদাব, মাথা নত করা ইত্যাদি আমার পছন্দ লাগলো নাআসিয়া আব্বাকে বললাম যে, ঐখানেতো সালাম-সুলামের নিয়ম নাই, শুধু আদাব-উদাব এইসব কথা-বার্তাআমারতো ইচ্ছা করে না যাইতেতিনি বললেন-তবে আর যাইয়ো নাঐ শেষ আমার ইস্কুলের পড়াদু-একদিন মনে হয় গেছিলাম, এরপরে আর নাআরো কিছু আব্বার কাছে পড়ার পর বয়স যখন আট-দশ কিংবা এগারো বছর হয়েছে তখন আমাকে পাঠাইদিলেন ঘুংগাদি, মাওলানা আতহার আলী সাহেবের বাড়িতে একটি মাদ্রাসা ছিলোমবনু- এটা কোথায়? খতিব-ঘুংগাদি হইলো বিয়ানিবাজারঐখানে বড় ভালো শিক একজন ছিলেন শাহবাগের মাওলানা শামসুল হক (র.)উনার কাছে ফার্সি, মিজান-মনশাইব পারথমিক কিতাব কিছু পড়লামপড়ে আবার গেলামগি বাড়িতেসেখানে আর আসা-যাওয়া দীর্ঘায়িত হইলো নাএক-দু বছর হয়তো ছিলামবাড়িতে গিয়া কিছু পারথমিক (সরকারি মাদরাসা নয়, প্রাইভেট পড়াইছেন) অর্থাৎ দরজায়ে ছুওম পর্যন্ত আব্বার কাছে পড়লামপরে পড়ার প্রতি অমনযোগি হইয়া পড়লামশুধু অনুপস্থিত, আর এদিকে সেদিকে চলাফেরাপড়ার দিকে অমনযোগীআব্বা অন্য মাধ্যমে জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কি করতে চাও, কারবার করলে দোকান করে দিয়া দেই, আর তে-কৃষি করলে হাল খরিদ করে দিয়া দেই, আর পড়বার হইলে পড়ো- একটা কিছু করোতো? আমি তখন আব্বার পরতিনিধির কাছে উত্তর দিলাম-পড়তে চাই, কিন্তু দেশে পড়বো নাদেওবন্দ যাইতে চাইতখন আব্বা রাজি হইলেন এবং গঙ্গাজলের জনাব মাওলানা আব্দুর রজাক সাব(ওনি মারা গেছেন)-এর সাথে আমাকে দেওবন্দ পাঠাইয়া দিলেনঐ সময় আমাদের গ্রামের একজন ছিলেন মাওলানা আব্দুর রকিব সাব (ওনি জীবিত আছেন এখনও, বর্তমানে আছে তিনি ঢাকা মীরপুরে) ওনি পড়তেন দেওবন্দে উপরের কাসেউনার তত্ত্ববধান কিংবা নেগরানিতে আমাকে দেওবন্দ থাকতে বলিয়া দিলেনমবনুÑতখন আপনি কোন কাসে পড়েন?খতিবÑ ঐ কাস ছুওম থাকি গেলাম পড়িয়াপরীা দিয়া ঐখানে এই জামাতে আবার ভর্তি হইলামমবনুÑনা, আমি বলছিলাম কি, অনেকে লিখেছেন কাফিয়ার জামাতের কথা?খতিবÑ হইছে, এই কাস ছুওমকেই কাফিয়া বলা হয়কাফিয়া গিয়া পরীা দিলাম, আবার ঐ জামাতে পড়তে হইলো আমারপ্রমোশন পাইলাম না পরথম ভর্তি পরিায়গেছি আমি মনে হয় ৪২/ ৪৩ সনেএরপর ধারাবাহিক লেখা-পড়া করে দাওরা হাদিস এবং এরপর আরো কিছু অতিরিক্ত লেখা-পড়া করিয়া ১৯৫০-এ আমি ঢাকা বড়কাটরা মাদ্রাসায় ফিরিয়া আসি শিকতার জন্যএই হইলো আমার পড়ার জিন্দেগীআমি কেনো পড়লাম এইটাতো আপনারা বুঝলেনইমবনুÑআপনার ছাত্র জীবনে দারুল ঊলূম দেওবন্দে মাওলানা সৈয়দ হোসেন আহমদ মাদানি সহ এমন আরো কিছু শিক ছিলেন যারা ভারতবর্ষের রাজনীতিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছেনখতিব-হাঁসেলিম আউয়াল-আচ্ছা, একটা প্রশ্ন হলো-এই যে মাদ্রাসার পরিবেশ, ঐ সময়ে দারুল ঊলূম দেওবন্দের যে পারিপার্শ্বিকতা ইত্যাদি জানতে পারলে ভালো হতোখতিব- পারিপার্শ্বিকতা কি বলবো? যে পারিপার্শ্বিকতা সাধারণত...সেলিম আউয়াল- যেমন আলীগর বিশ্ববিদ্যালয় এবং দারুল ঊলূম দেওবন্দের অবস্থা? মবনু-সেলিম ভাই বলতে চাচ্ছেন, আলীগড়, দেওবন্দ এবং নাদওয়ার মধ্যে পরিবেশগত ভিন্নতা কিংবা অভিন্নতার কথা?খতিবÑ আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয় হলো সাধারণ শিক্ষার প্রধান্যতার মাধ্যমে একটা উচ্চশিক্ষার পরতিষ্ঠানআর দারুল উলূম দেওবন্দে সাধারণ শিক্ষার কোন স্থান ছিলো নাএইখানে শুধু ইসলামি শিক্ষার, আরবি শিক্ষার, হাদিস ও কোরআনের শিক্ষা ইংরেজি বা সাধারণ বিষয়ের কোন সাবজেক্ট দারুল উলূম দেওবন্দে ছিলো নাআর নদওয়া হলো ভিন্ন ধরনের একটা পরতিষ্ঠানএইটার সঙ্গে দারুল উলূম দেওবন্দের আলেম, শিক্ষক, পরিচালকদের বন্ধুত্বমূলক একটা সম্পর্ক ছিলোকিন্তু শিক্ষানীতি ছিলো ভিন্ননদওয়ার শিক্ষানীতি ছিলো সাধারণ শিক্ষা আর আরবি শিক্ষার মধ্যে সমন্বয় করে একসাথে চালিয়ে যাওয়াএই জন্য তাদের শিক্ষার পদ্ধতি দেওবন্দের শিক্ষা পদ্ধতির তুলনায় ভিন্নদেওবন্দের শিক্ষা ছিলো খাটি কোরআন-হাদিস-ফেকাহ এবং আনুষাঙ্গিক বিষয়াদিমবনু- কোলকাতা আলিয়া মাদ্রাসা আর নদওয়ার মধ্যে ব্যবধান কি?খতিব-কলকাতা আলিয়া মাদরাসাতো বহু আগে কায়েম হইছে। (কিছুণ চিন্তা করেন) মনে হয় ১৭৮১ সালে আর দারুল উলূম দেওবন্দ ১৮ শতকের শেষদিকে, প্রায় একশ বছরের ব্যবধান আর নদওয়া হলো এর আরো পঞ্চাশ বছর পরেকলকাতা আলিয়া মাদরাসার মধ্যে বহু পরিবর্তন-পরিবর্ধন হয়েছে বিভিন্ন সময়পরথম অবস্থায় ঐ মাদরাসায় কোরআন-হাদিসের পরধান্যতা ছিলোআর শিক্ষক ছিলেন দারুল উলূম দেওবন্দের শিকদের সূত্র যে দিকে অর্থাৎ শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী (র.) একজন শাগরিদ মুল্লা মদন (র.), যার কিছু ভক্ত কলকাতায় ছিলেন, তারা তাঁকে এখানে নিয়ে আসলোএরপর উনার নামে কিছু ভক্-ছাত্র জমা হইলোপ্রাইভেট, সেখানে থাকতেন এবং পড়াইতেনকিছুদিনের মধ্যে সাড়া পড়ে গেলো কলকাতা শহরের বড় বড় ব্যবসায়ি এবং ইসলামিক চিন্তাবিদদের মধ্যেতারা ভাবতে লাগলেন-আমাদের এত বড় শহর, রাজধানী, (তখন কলকাতা ছিলো ইংরেজদের রাজধানী শহর) অথচ একটা দ্বীনি পরতিষ্ঠান নাইআমরা একটা পরতিষ্ঠান করিয়া লইবো মুল্লা মদনকে সামনে রাখিয়া এবং আরো কিছু শিক নিয়াএটা নিজের থেকে একাকি করার সাহস না পেয়ে তারা ইংরেজ গভর্ণরের কাছে একটা পরতিনিধি দল গিয়ে বলল-আমরা এই রকম একটা শিক্ষা পরতিষ্ঠান করতে চাই, আপনারা কি সহযোগিতা করবেন? গভর্ণরকে তারা বিভিন্ন যুক্তি দেখাইলেন, গভর্ণর তাদের যুক্তিতে আকৃষ্ট হইয়া বললো-ঠিক আছে করেনসে প্রাইভেট একটা জায়গা দিয়ে দিলো, তার কোন এক বিল্ডিং এ, এবং বললো-এইখানে পড়ানোর ব্যবস্থা করেন আর আমি মাসিক এত টাকা দিয়ে সাহায্য করবো, বাকি আপনারা যোগাড় করেনএই চালু হইয়া গেলো মাদরাসাএটা লেখা আছে তারিখে মাদরাসায়ে আলিয়াএটা সিলেট আলিয়া মাদরাসাতেও পাইবেন, উর্দুও আছে, বাংলাও হয়ে গেছেউর্দুটা লিখছেন মাওলানা আব্দুস সত্তারতিনি আলিয়া মাদরাসার একজন লেকচারার ছিলেন, খুব ভালো মানুষ ছিলেনএতটুকু আলোচনার পরই ভেতরের ঘর থেকে কিছুণ আগে তাঁর ছোট্ট নাতিনের দিয়ে যাওয়া চা-নাস্তার দিকে ইশারা করে বললেন-এখন রাখো তোমার এই সব, আগে খাও, তারপর কথাআমি আর সেলিম ভাই কথা না এগিয়ে খেতে শুরু করিতিনি নিজ হাতে আমাদের দিকে চা-নাস্তা এগিয়ে দিতে থাকেনতাঁর মেহমানদারিতে নিরহংকার একজন মানুষের প্রতিচ্ছবি বারংবার প্রস্ফূটিত হয়ে উঠছিলোনাস্তা পর্ব শেষে সেলিম ভাই আবার কথা শুরু করেন. আমি বলছিলাম কি-সেই সময় শিক্ষার যে পরিবেশটা ছিলো, যেমন আমরা জানি হিন্দুদের ঠুল ছিলো, স্কুলের শিক্ষার একটা পরিবেশ ছিলো, বৌদ্ধদের বিহারের একটা পরিবেশ ছিলো, নিশ্চয় এসব থেকে দেওবন্দের পৃথক একটা পরিবেশ ছিলো, অনেক মানুষের জানার আগ্রহ রয়েছে দেওবন্দের পরিবেশ সম্পর্কে, যেমন ছাত্ররা বসতেন কী ভাবে, ছাত্র-শিকের সম্পর্ক কেমন ছিলো, আজকের ছাত্র-শিকের সম্পর্কের সাথে দেওবন্দের ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্কের মধ্যে ব্যবধান কতটুকু, ইত্যাদি আমরা একটু জানতে চেয়েছি? মবনু-এই জিনিষটাই আমি আগে বলেছিলাম, আপনার সময়ে যারা দেওবন্দের শিক ছিলেন তারা ভারতবর্ষের রাজনীতিতে খুব প্রভাবশালী ছিলেন, সেই সময়ের পরিবেশ?খতিব-এই ধারণাটা ভুল, যা তুমি বলতেছোদারুল ঊলূম দেওবন্দের শিকগণ সাধারণভাবে রাজনীতি করতেন নারাজনীতিতে ছিলেন আমাদের সময়ে কিংবা পরে মাওলানা হোসেন আহমদ মাদানি, ওনি ছিলেন সদরে মুদাররিস (প্রধান শিক্ষক) এবং আধ্যাত্মিক তরিকতের শেখ, একজন বড় মুসলেহএই জন্য অন্যান্য ছাত্র-শিকরা উনার খুব ভক্ত ছিলেনআর ওনি কোনদিন ছাত্র-শিক্ষকদেরকে রাজনীতিতে যাওয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করতেন নাবরং অনেক সময় বলতেন আমিতো আমার উস্তাদের কারণে অর্থাৎ শায়খুল হিন্দ হযরত মাওলানা মাহমুদুল হাসান দেওবন্দি (র.) এর সঙ্গে থাকিয়া অঙ্গিকারবদ্ধ হয়ে গেছি যে হিন্দুস্তানের মুসলমানদের মুক্তির পথে রাজনীতি করবোতবে তোমরা আগে পড়া-লেখা করো, এরপর যার যে দিকে ইচ্ছা রাজনীতিতে যাইবাতিনি প্রায়ই এই কথা বলতেনকিন্তু ভক্তি করে সাধারণ ছাত্র এবং অধিকাংশ শিক উনার অনুসারি ছিলেনকিন্তু তবু তারা সরাসরি রাজনীতিতে অংশ গ্রহণ করতেন নাআমিতো আট বছরের মতো রয়েছি দেওবন্দজমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, যেটার সদর (সভাপতি বা আমীর) ছিলেন মাওলানা হোসেন আহমদ মাদানি (র.), এইটার বড় বড় মিটিং হইলে দিল্লি, সাহরানপুর কিংবা অন্য স্থানে, ছাত্ররা নিজ ইচ্ছায় গিয়া সামিল হইতোতিনি কোনদিন বলতেন না যে, তোমরা যাইওআমরাও গিয়েছি স্বইচ্ছায়আর অন্যান্য শিকেরা রাজনীতির কোন চিহ্নিত দায়িত্ব গ্রহণ করেন নাইভক্তি হিসাবে মাওলানা হোসেন আহমদ মাদানির সংস্পর্শে যাইতেন, বসতেন, কথা-বার্তা শোনতেনদারুল উলূম দেওবন্দ রাজনীতিতে পরসিদ্ধ হয়েছে একতো মাওলানা মাহমুদুল হাসান (র.)এর কারণে, এরপরে উনার শাগরিদ মাওলানা হোসেন আহমদ মাদানি (র.)এর কারণেমাওলানা হোসেন মাদানি (র.)এর ইন্তেকালের পর আর কোন নেতা নাই দারুল উলূম দেওবন্দেশিকদের মধ্যে কোন নেতা অগ্রগামি হয়নাই যে রাজনীতি করবেনভালোবাসা ভিন্ন কথা, বিভিন্ন শিকেরা কিংবা প্রায় সকল শিক জমিয়তে উলামায়ে হিন্দকে ভালোবাসতেন, কিন্তু সক্রিয় রাজনীতিতে কেউ ছিলেন নাতাবে মাওলানা হোসেন আহমদ মাদানির সাহেবজাদা মাওলানা আসআদ মাদানি, যার ইন্তেকাল গত বছর হয়েছে, তিনি রাজনীতি করতেনওনি পরথম জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের সহ-সভাপতি, তারপরে আজীবন সভাপতি ছিলেনতিনিও বাপের নীতি অনুসরণ করে মাদরাসার ছাত্র শিকদেরকে রাজনীতি করার প্রতি উদ্বুদ্ধ করেননিতবে ভক্তি, শ্রদ্ধা, মতের মিল হিসেবে ছাত্রÑশিকরা সামিল হইলে হইছেমবনু-তা হলে দারুল উলূম দেওবন্দ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যটা কি ছিলো? খতিবÑ পরতিষ্ঠার মূল উদ্দেশ্যতো ছিলো কোরআন-হাদিসের শিক্ষকেরা করা১৮৫৭-এর বিপ্লবের পর বৃটিশ যখন গোটা ইন্ডিয়াকে দখলে নিয়ে নিলো তখন তারা পরিকল্পনা গ্রহণ করলো এই দেশের ছেলে-মেয়েদেরকে পশ্চিমা শিায় শিতি করে খ্রিস্টান বানানোরএই পরিকল্পনা যখন মুসলমানদের মধ্যে জানাজানি হয় তখনই ১৮৫৭এর যুদ্ধের নয় বৎসর পর মাওলানা কাসেম নানতুবি এবং তাঁর সঙ্গি-সাথিরা কয়েকজনে মিলে দেওবন্দে দারুল উলূম পরতিষ্ঠা করেনপরথম উদ্দেশ্য হলো ইংরেজরা যে এইখানে ইসলাম এবং ইসলামি শিক্ষা মিটাতে চায় এইটার প্রতিরোধ কায়েম করাআর দ্বিতীয় উদ্দেশ্য ছিলো-এই প্রতিরোধ কায়েম করার মাধ্যমে ভারত উপমহাদেশের মুসলমানদের মধ্যে আবার এমন একটি জাগরণ সৃষ্টি করা যা দিয়ে এই দেশ থেকে বৃটিশকে তাড়িয়ে স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা করা যায়সেলিম আউয়াল-আমি জানতে পেরেছিলাম যে, আপনি মিশরের আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখা-পড়া করেছেন? খতিব-একদিনও নাতবে বেড়াইতে গেছি, দেখতে গেছিসেলিম আউয়াল-৫৪এর যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনের সময় আপনি জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের সাথে ছিলেন না নেজামে ইসলামীর সাথে ছিলেন? খতিব-নেজামে ইসলাম পার্টির সাথে ছিলাম, তবে তখনও নেজামে ইসলাম পার্টির আসল নামকরণ হয় নাই, তখন নাম ছিলো জমিয়তে উলামায়ে ইসলামতখন আমি বাচ্চা মানুষ ছিলাম, তবে তাদের সাথে সহযোগী ছিলামমাওলানা আতহার আলী সাহেব ছিলেন জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের সেলিম আউয়াল-সিলেটের আতহার আলী সাহেব কি? খতিব- হাঁ, সিলেটেরতবে থাকতেন তিনি কিশোরগঞ্জেতিনি ছিলেন জমিয়তে উলামায়ে উসলামের সভাপতিমবনুÑআপনি জমিয়তের প্রচার সম্পাদকের দায়িত্বে ছিলেন কোন সময়ে? খতিব-এই সময়ে, অর্থাৎ ৫১ থেকে ৫৪ সনসেলিম আউয়াল-যুক্তফ্রন্টের সময় মাওলানা আতহার আলী সাহেব মন্ত্রীসভায় ছিলেন কি না? খতিব- না, না, তিনি মন্ত্রি হন নাইতবে তিনি প্রভাবশালী নেতা ছিলেন, মন্ত্রী বানিয়েছেন কয়েকজনকেযেমন, আশরাফুদ্দিন চৌধুরী, চট্টগ্রামের মশহুর পাল্টামেন্টিসিয়ান ফরিদ উদ্দিন এবং নুরুল হক চৌধুরী প্রমুখদেরকে মন্ত্রী বানিয়েছেন তিনিতবে নিজে মন্ত্রি হন নাইসেলিম আউয়াল-তা হলে আপনি যুক্তফ্রন্টের পক্ষে নির্বচনী প্রচারে অংশ নিয়েছিলেন? খতিব- না, আমি অংশ নিতে পারি নাই, তখন আমি করাচিতে ছিলামতবে ঐখান থেকে তাদের পে বয়ান পত্র-পত্রিকায় প্রচার করে কিছুটা অংশ নিয়েছিসেলিম আউয়াল-পরবর্তিতে আপনি জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের আর কোন দায়িত্ব পালন করেছেন কি না? খতিব- না, কোন দায়িত্ব ছিলো নাআমি এমনি অনারারি সদস্য ছিলাম জমিয়তে উলামায়ে ইসলামেরতবে নথিতে আমাকে আর সদস্য হিসেবেও লিপিবদ্ধ করা হয়নিমবনু-তা হলে রাজনীতির সাথে সক্রিয় কখনো জড়িত ছিলেন না? খতিব- জি নাসেলিম আউয়াল- আপনি বায়তুল মোকাররমের খতিব কখন থেকে? খতিব- (কিছুটা মুচকি হেসে ধমক দিয়ে) সবতা আমারে জিগাইতায়নি, কিছুটা নিজেরা পড়িয়া সংগ্রহ করেন কোনদিন থাকি হইছিএইটা জিগাইয়া নিবেন ইসলামিক ফান্ডেশনের ডিজি বা ডাইরেক্টর সাহেবকেআমি এতসব প্রচার করতে পারবো নাসেলিম আউয়াল-ঠিক আছে, আমরা অন্য বিষয়ে চলে যাই, আমি জানতে চেয়েছিলাম হযরত হাফেজ্জী হুজুর সম্পর্কে? মবনু-শুনেছি, হযরত হাফেজ্জী হুজুর আপনার পির সাহেব ছিলেন? খতিব- পির সাহেব নয়, আবার পির সাহেবওউনাকে আমি ভক্তি করতাম, কারণ আমার আব্বা এবং হাফেজ্জী হুজুর ছিলেন হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানবী (র.) মুরিদ এবং খলিফাউনাদের সম্পর্ক ছিলো সেই থানাবন থেকেইএই হিসেবে উনাকে মুরুব্বী মানতামযেমন মাওলানা আতহার আলী সাহেবকে মুরুব্বী মানতাম, তেমনি হাফেজ্জী হুজুরকেমাওলানা আতহার আলী সাহেব ইন্তেকাল করে ফেললেন বাংলাদেশ হওয়ার তিনÑচার বছর পরপরে হাফেজ্জী হুজুর ছিলেনহাফেজ্জী হুজুরের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত খুবই ঘষ্টি সম্পর্ক ছিলোতিনিও মহব্বত করতেন, আমিও উনার মজলিশে যাইতামবিভিন্ন ব্যাপারে উনি আমার কাছে মাতমত চাইতেন মশওয়ারা হিসাবেআমি মতামত দিতামকোন সময় উনার মতের পে আমার মত হইতো, আর কোন সময় আমি শক্তভাবে বিরোধীতা করেছিএই বিরোধীতার পরও তিনি এই কথা মানতেন না, অন্যান্য লোকের কথায় চলতেন কিন্তু তবু মূল্যায়ন করতেনযেমন ইরানের দাওয়াত গ্রহণ করা আর যাওয়াআমি খুব প্রতিবাদ করছি, নিষেধ করছি যে, যাইয়েন না, গেলে আপনি বদনামি হইবেন, আপনার দল বদনামি হইবো, সবকিছু লণ্ড-ভণ্ড হইযাইবোকিন্তু উনারে বুঝাইছে অন্যরা যে আপনি যাইবেন একজন বিচারক হিসাবে, দুই দেশের মধ্যে যে লড়াই হচ্ছে এই লড়াই বন্ধ করার চেষ্টা করাতো ইসলামের দৃষ্টিতে জরুরীআপনি ছাড়া পৃথিবীতে আর কোন ব্যক্তি নাই যে এই দুই শক্তির মধ্যকার যুদ্ধ থামাতে মধ্যস্ততা করতে পারেআপনি মধ্যস্ততা করুনএই যুক্তি দিয়া তারা উনাকে ইরানে যাওয়ার জন্য উদ্ভুদ্ধ করছে বেশিআমি উনাকে বলছি যে এই যুক্তি ঠিক নয় এই জন্য যে তারা আপনাকে সমঝোতাকারি হিসাবে দাওয়াত করেনি যে আপনি গিয়ে সমঝোতা করেনআর নিজের থেকে বললে এই কথার কোন মূল্য হয় নাওনির যাওয়াটায় তি হইছে, ফায়দা হয়নিউনার খেলাফত আন্দোলন এই কারণে ভেঙে গেছেএই রকমের বিভিন্ন ব্যাপারে আমার সঙ্গে আলোচনা হইতো, আমিও করতামএরপর তিনি কী ভাবে দেশে আন্দোলন চালাইয়া যাইবেন, এই ব্যাপারেও আলোচনা করতেনউনাকে জিজ্ঞাসা করা হইতোÑআপনি প্রেসিডেন্ট হইলে কি করবেন? তিনি বলতেনÑ৬৪ হাজার গ্রামে ৬৪ হাজারটি কোরআনিক মক্তব কায়েম করবোআমি বলতাম এইটা খুব ভালো আপনার পরিকল্পনাএইটা নিয়ে তিনি অনেকদিন আলোচনা, সমালোচনা, গবেষণা করছেন এবং ভাবছেন যে, মতায় আসতে পারলে এই কাজটা করবেনএই রকমের বিভিন্ন চিন্তা ছিলো তাঁর ভেতরেহাফেজ্জী হুজুর আগে পলিটিক্স করতেন নাহঠাৎ করিয়া তিনি ৭৫ সালের পরে আস্তে আস্তে সিয়াসতে (রাজনীতিতে) যোগদান করতে শুরু করলেনলোকে তাঁকে জিজ্ঞাস করতোÑহুজুর আপনিতো রাজনীতি করতেন না, বরং এইটাকে নাপছন্দ করতেনহঠাৎ করে রাজনীতিতে আসলেন কেনো? আমরা জানতামÑআপনি রাজনীতিকে না জায়েয মনে করেন? তখন তিনি বললেনÑতুমরা ভুল বুঝেছোকরছি না রাজনীতি এইটা ঠিক, কিন্তু রাজনীতিকে আমি নাজায়েয কিংবা নাপছন্দ করতাম এইটা ভুলতখন রাজনীতির মাঠে ছিলেন মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরী (র.), মাওলানা মুফতি দীন মুহাম্মদ, মাওলানা আতহার আলী, মাওলানা সিদ্দিক আহমদ প্রমুখ বড় বড় লোক, তারা আমার সঙ্গি, তাঁরা আমাকে মহ্বত করতেন, আমিও তাদেরকে মহ্বত করি, তারা ছিলো যোগ্য আর মাঠে কাজ করতে ছিলো, আমি দেখছি আমার আর দরকার নেই মাঠে যাওয়ার, আমি মাদ্রাসা নিয়া থাকলেই চলবেউনারা রাজনীতি করুক মাঠে-ময়দানেএই হিসাবে আমি দূরে রইছিকিন্তু এখন উনাদের মধ্যে কেউ নাই, সব চলিয়া গেছে, মারা গেছে, এখন আমিও যদি মাঠে থেকে দূরে থাকি তবে ইসলামি আন্দোলনের চেরাগ নিভিয়া যাইবেকোন সাড়া-শব্দ থাকবে নাএই জন্য আমি চিন্ত-ভাবনা করিয়া মাঠে আসছিহাফেজ্জী হুজুর এই যুক্তি দিতেন এবং এইটা আমাদের কাছেও বড় যুক্তি সম্মত মনে হইতোসেলিম আউয়াল-জামাতে ইসলামি বাংলাদেশের বর্তমান আমীর মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী আপনার ছাত্র ছিলেন?খতিব সাহেব- হাঁ, আলিয়া মাদ্রাসার শত শত, হাজার হাজার ছাত্রের মধ্যে তিনিও একজন ছাত্রতিনি লজিং না কোথায় থাকতেন, মাঝে-মধ্যে এসে দেখা করতেন, তবে ব্যক্তিগত তিনির সাথে আমার কোন সম্পর্ক ছিলো নাতবে সাধারণ ছাত্র হিসাবে পরিচিত ছিলোআমি যতটুকু জানি এবং তিনি নিজেও পরবর্তিতে বলেছে-তিনি একজন আমরা আরবিতে বলি মুয়াজ্জব, বা-সালাহিয়ত, মানুষের সঙ্গে সৎ ব্যবহারের একটা আখলাক বা চরিত্র তাঁর মধ্যে ছিলো, উগ্রপন্থী ছিলো নাসেলিম আউয়াল-মতিউর রহমান নিজামীর দলের সাথে আপনার কোন সম্পর্ক আছে কি না? খতিব সাহেব- দল কি? তার দলতো জামাতে ইসলামজামাতে ইসলামীতে অতীতে আমরা কখনো ছিলাম না এবং আগামীতে কখনো যাওয়ারও সম্ভবনা নেইমবনু-বেশ কিছু দিন থেকে আমার ভেতরে একটি বিষয়ে খেলা করছে, আমি ইংল্যান্ড, আরব বিশ্ব কিংবা ঢাকা বায়তুল মোকাররম মসজিদে দেখেছি মহিলাদের জন্য নামাজের ব্যবস্থা রয়েছে, কিন্তু বাংলাদেশের অন্য কোথাও ব্যাপকভাবে মসজিদগুলোতে মহিলাদের যাওয়ার কোন সুযোগ নেইবরং ঘটনাচক্রে কোন মসজিদে মহিলারা নামাজের জন্য গেলে সবাই হাউমাউ শুরু করে দেনÑএই মহিলা মসজিদে প্রবেশ করেছে, মহিলা মসজিদে প্রবেশ করেছেমনে হয় যেনো মহিলা নয় কোন চোর প্রবেশ করেছেআমরার দেশে কেনো অন্যান্য দেশের মতো কিংবা বায়তুল মোকাররমের মতো মসজিদগুলোতে কোন ব্যবস্থা করা হয় না?খতিব সাহেব আমাকে টেপরেকর্ড বন্ধ করতে বললেনএরপর তিনি তাঁর নিজের অভিজ্ঞতা থেকে একটা ঘটনা বর্ণনা করলেনকিছু কথা বললেন নিজের মনের কথাতবে একটি অভিজ্ঞতার কথা বলে দেওয়া যেতে পরেবেশ আগে একবার তিনি তাঁর বোনকে নিয়ে লামাকাজি যাচ্ছেনতখন আজকের মতো এতো গাড়ির পথ ছিলো নাতিনি হাঁটতে হাঁটতে কান্ত হয়ে তাঁর বোনকে নিয়ে এক মসজিদে গিয়ে বসলে গোটা গ্রামবাসী এমনভাবে তাড়িয়ে আসে যেনো খুন-খারাপি কিছু একটা ঘটে গেছেএসব মূলত মানুষের মূর্খতামহিলাদের মসজিদে যেতে কোন আপত্তি নেইবর্তমানে দেখা যায় অনেক পুরুষ মসজিদের সামনে নিজের স্ত্রীকে রিক্সায় কিংবা গাড়িতে দাঁড় করিয়ে নিজেরা নামাজ পড়তে যান, যদি মসজিদগুলোতে মহিলাদের জন্য সুব্যবস্থা থাকতো তা হলে এই সময় মহিলারাও নামাজ পড়ে নিতে পারতোতবে উলামায়ে কেরাম বিভিন্ন মুসলাহতে বলেছেন মহিলারা যেনো ঘরেই নামাজ পড়ে এবং এটাই আফজলএমনকি হজ্জের সময়ও তোয়াফ শেষে আর ধাক্কা-ধাক্কি না করে ঘরে এসে নামাজ পড়া উত্তমকিন্তু সেখানে মহিলারা গেলে মানে নাতারা ধাক্কাÑধাক্কি খেয়েও জামাতে যাইবেমবনু-ঈদের জামাত কি মহিলাদের জন্য ওয়াজিব?খতিব সাহেব-না, বিলকুল নাজামাতি নামাজ কোনটাই মহিলাদের জন্য ওয়াজিব নয়এতটুকু আলোচনার পর বিদ্যুৎ চলে যায়গরমের সময়খতিব সাহেব বললেন-এখন আর রাখো তোমার এই গুলাপরে আসলে আরেকদিন আরো কথা কইওআমরা উঠতে উঠতে তাঁকে জানিয়ে দিলাম- আগামীতে সিলেট আসলে প্রতিবার আমাদেরকে কমপে একঘন্টা সময় দিতে হবেতিনি রাজি হলেনআমার সাথে কিছু ব্যক্তিগত আলাপ হলোবিদায় নিয়ে বেরিয়ে আসলামআর তাঁর সাথে দেখা হলো নাতিনি মৃত্যুর মাত্র কয়েকদিন আগে ১৩ রমজান একদিনের জন্য সিলেট আসলেও আমার জানতে দেরি হয়ে যায়তিনি সাধারণত রমজান মাসে ঢাকা থেকে সিলেট আসতেন নাকিন্তু মৃত্যু হলো যে রমজানে সেই রমজানে সিলেট আসেন এবং পরিবার এবং আত্মীয়-স্বজন সবাইকে ইফতারের জন্য টাকা দিয়ে যান
খতিব সাহেবের জীবনের শেষদিনের কিছু কথাদুতিন দিন থেকেই তিনি শ্বাসকষ্টে ভুগছিলেনঅসুস্থ শরীর নিয়ে তিনি ৫ অক্টোবর শুক্রবারের জুম্মা পড়ানএই দিন তিনি খুতবা শুরুর পূর্বে পেশ ইমাম মুফতি নুরউদ্দিনকে বলেন- আপনি প্রস্তুত থাকেন, আমি না পারলে আপনি চালিয়ে যাবেন৬ অক্টোবর তিনি তাঁর শালাকে নিয়ে তাঁর নিজের ডাক্তারের কাছে যান এবং পরীা করানডাক্তার পরিক্ষা করে কিশোরদের হার্টের সাথে তাঁর হার্টের উপমা দিয়ে বললেন-চিন্তার কোন কারণ নেই, আপনি সুস্থ্যখতিব সাহেব ঘরে ফিরে এসে তাঁর স্ত্রীকে মজা করে ডাক্তারের এই উপমার কথা বলেনতখন তিনিও নাকি মজা করে বলেছেন- ডাক্তার তোমাকে সুস্থ্য বলেছে, আর তুমি এখন শুরু করো গরুর গোশত খাওয়াখতিব সাহেব বাসায় ইফতার করেনরাতে ছিলো তাঁর দাওয়াত ইরানি কালচারাল সেন্টারেসম্ভবত এই অনুষ্ঠান ছিলো ইরান থেকে বাংলাদেশে সফরে আসা ইরানের ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ শাহরুখীর সম্মানেকারণ, পত্রিকার মাধ্যমে আমরা জানতে পারি ৫ তারিখ শুক্রবার বাদ জুম্মা বায়তুল মুকাররমে এই নেতার সাথে ফার্সিতে খতিব সাহেবের দীর্ঘ আলোচনা হয়েছেরাতে তিনি ইরানি কালচারাল সেন্টারে যাওয়ার মুহূর্তে যখন তৈরি হচ্ছিলেন সে সময়ের কথা বলতে গিয়ে ছোট চাচী বলেন (খতিব সাহেবের ছোট স্ত্রী)-তিনি কাপড় পরছিলেন, আমি টেনে-টুনে ঠিক করে দিচ্ছিলাম, এরপর পানের বাটা ঠিক করে দিলাম, তিনি আতরের শিশি হাতে নিয়ে ব্যবহার করলেন, আর হাসতে হাসতে আমাকে বললেনÑঈদের দিনে আমি কোন শাড়ি পড়বোছেলের বৌকে (একরামুল হকের স্ত্রী) কে ডাকলেন- কী পাক করা হয়েছেজিজ্ঞাস করে বললে এখন তোমরা খেয়ে নিও, আমি সেহরির সময় আমি খাবোগাড়ি আসলে তিনি বেরিয়ে গেলেনআমি জানতাম না তিনি আর এই ঘরে ফিরে আসবেন নাআমাকে একা ফেলে চলে যাবেনইরান কালচারেল সেন্টারের অনুষ্ঠান শেষে তিনি তাঁর বুকে একটু ব্যথা অনুভব করলে আল্লাহু আকবার তিনবার বলে তিনি বুক চেপে ধরেনসাথে সাথে তাঁকে ল্যাব এইড হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পথে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।(ইন্নালিল্লাহি.....রাজিউন)
ছড়িয়ে পড়লো মৃত্যুর সংবাদজাতীয় মুরুব্বী, আলেম সমাজের শিকÑঅভিভাবক, জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের খতিব, ইসলামি আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তিত্ব খতিব মাওলানা উবায়দুল হকের মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লে রমজানের মধ্যরাতের নিস্তব্ধতা মুহূর্তে উধাও হয়ে যায়সংবাদপত্র অফিসে ও টিভি চ্যানেলগুলোর নিউজ ডেস্কে মুহূর্মুহু টেলিফোন আসতে থাকেসবখানেই একটা কালো নিস্তদ্ধতা ছড়িয়ে পড়ে এবং শোকের ছায়া নেমে আসেঅনেকেই মরহুমের লাশ দেখতে ল্যাব এইড হাসপাতালে ভিড় করেনগোটা দেশ যেনো এক সাথে শোকাভিভূত হয়ে পড়েঅনেকে আবার রাতেই ছুটে যান হাসপাতালে এবং কান্নায় ভেঙে পড়েনহাসপাতালে তাঁর সহকর্মী, শুভানুধ্যায়ী, ছাত্র ও অনুগামিদের ভিড় সামলাতে কর্তৃপকে হিমশিম খেতে হয়ঢাকার আজিমপুরের বাসায় এবং সিলেটের সুবিদবাজারের বাসায় মুহূর্তের মধ্যে জমে উঠে অসংখ্য মানুষের ভিড়লাশ সিলেট আসছে না শুনে সিলেটের অনেকেই মনে মনে কষ্ট অনুভব করেনকেউ কেউ নিজেদের সাধ্যানুসারে চেষ্টা করতে থাকেন সিলেটে আনার কোন ব্যবস্থা করা যায় কি নাঅনেকে রাতেই জানাজার জন্য যাত্রা শুরু করেন ঢাকার পথেগোটা দেশের প্রায় সকল মসজিদের মাইকে এলান হতে থাকে খতিব সাহেবের মৃত্যু সংবাদ এবং জানাজার স্থান ও সময়।(তথ্যসূত্র- দৈনিক ইনকিলাব ও দৈনিক নয়াদিগন্ত)
নামাজে জানাজা অশ্রসজল নয়নে লাখো মানুষ জামায়েত হলেন ঢাকার জাতীয় ঈদগাহ ময়দানে তাদের প্রাণপ্রিয় রাহবার খতিব মাওলানা উবায়দুল হককে শেষ বিদায় জানাতেআমরা যখন ঈদগাহ ময়দানে পৌঁছি তখন ঘড়িতে একটাজানাজা হবে তিনটায়সপ্তাহদিনের মধ্যে ঢাকায় বৃষ্টি নেইআগামী সপ্তাহদিনের মধ্যে বৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা নেই বলে আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছেরমজানের দিন, মাথার উপর মধ্যদুপুরের প্রচণ্ড রোদভয়ে ভয়ে মাঠে গিয়ে আমরা কেউ কেউ গাছ খুঁজতেছিলাম একটু ছায়ার জন্যএরমধ্যে নিরাপত্তাকর্মীদের উৎপাতসরকারের সর্বোচ্চ ব্যক্তিগণ আসছেন জানাজায়, তাই এসেছে সর্বোচ্চ নিরাপত্তাকর্মীরামাঠে আমার লেখক সত্ত্বা পরাধীনতায় কষ্টে ছিলোএরই মধ্যে নিরাপত্তাকর্মীরা বললেন সবাই মাঠ ছেড়ে যেতে হবে, পরিক্ষা করার পর একজন একজন করে প্রবেশ করানো হবেকথা শোনে অনেকটা হাসি পায়যদি দুচার হাজার মানুষের ব্যাপার হতো তবে এই কথার যুক্তি থাকতোলাখ-লাখ মানুষ যদি হয় তবে? না, সেনাবাহিনী প্রথমদিকে কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেও শেষ পর্যন্ত শুধু সামনের দুকাতার ছাড়া বাকিগুলো ছেড়ে দেয়আমরা যারা মঞ্চে তাদের পরিচয় জেনে নিলেন উপস্থিত আইন-শৃংখলা নিয়ন্ত্রকতাহাফফুজে খতমে নাবুওয়াত আন্দোলনের সেক্রেটারি মাওলানা নুরুল ইসলাম চট্টগ্রামীর পরিচালনায় জানাজাপূর্ব সময়ে খতিব সাহেবের বিভিন্ন কর্মের উপর বক্তব্য রাখতে গিয়ে ধর্ম উপদেষ্টা অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল ড. মতিউর রহমান বলেন-আল্লাহ সবার শ্রদ্ধেয় খতিব সাহেবকে রমজান মাসে তাঁর কাছে ডেকে নিয়ে গেছেনআল্লাহ তাআলা মানুষকে উদ্ভুদ্ধ করার জন্য, জাতীয় মসজিদের খতিব হিসাবে মানুষকে নেতৃত্ব দেওয়ার মতো সব যোগ্যতা দিয়েছিলেন তাঁকেতাঁর মতো ব্যক্তিত্ব বায়তুল মোকাররমের খতিব হওয়া আমাদের জাতির জন্য ছিলো সৌভাগ্যখেলাফত মজলিশের আমীর শায়খুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক তাঁর নিজের লেখা একটি আরবি কবিতা আবৃত্তি করে বলেন- মাওলানা উবায়দুল হক ছিলেন সেই ব্যক্তিত্ব, অসংখ্য ফুল ফুটিয়ে যিনি বিলীন হয়ে গেলেনজাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের পেশ ইমাম মুফতি মাওলানা নুরউদ্দিন বলেন- আমরা দীর্ঘদিন এক সাথে হুজুরের সাথে কাজ করেছি, তিনি আমাদেরকে কোনদিন কষ্ট দেননিজামাতে ইসলামীর আমীর মাওলানা মতিউর রহমান নেজামী বলেন-তাঁর ইন্তেকাল আমাদের জন্য এক দুঃখজনক ঘটনাতিনি ছিলেন এদেশের সব মানুষের অভিভাবকবিশেষ করে হুজুর আমার মতো অনেকেরই অভিভাবক ছিলেনখতিব সাহেবের জাতীয় অভিভাবকত্ব ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবেতাঁর মৃত্যুতে জাতি একজন অভিভাবক হারালো এবং একটি শূন্যতা সৃষ্টি হলো, আল্লাহ যেন তা পূরণ করে দেনতিনি জাতীয় সব সংকটের সময় জাতিকে সঠিক দিক নির্দেশনা দিয়েছেনইসলামি দলগুলোর মধ্যে ঐক্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিলো তাঁরইসলামী উম্মাহের বিরুদ্ধে বিভিন্ন যড়যন্ত্র নস্যাৎ করতে তিনি সর্বদাই সাহসী ভূমিকা রেখেছেনমাসিক মদিনার সম্পাদক মাওলানা মহিউদ্দিন খান বলেন-খতিব সাহেবের অনুপ্রেরণায় আমার মতো অনেক আলেম ইসলামী আন্দোলনে সাহসী ভূমিকা পালন করছেনইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান আবু নাসের মোহাম্মদ আবদুজ জাহের বলেন-সুদমুক্ত অর্থনৈতিক সমাজ প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের প্রাণপুরুষ বলা যেতে পারে প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন খতিব সাহেবইসলামী ব্যাংকে দেওয়া তাঁর বক্তব্যসমূহ রেকর্ড করা আছে, আমরা এগুলো প্রকাশ করবো ইনশাল্লাহএই আলোচনা চলাকালীন সময় আস্তে আস্তে আকাশের সূর্যও মেঘের ভেতর দুঃখেÑকষ্ঠে মুখ লুকাতে শুরু করেমুহুর্তের মধ্যে সমস্ত জাতীয় ঈদগাহ প্রায় অন্ধকার হয়ে পড়েবৃষ্টি আসছে আসছে অবস্থার মধ্যে মাঠে আসেন রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক ড. ইয়াজ উদ্দিন আহমেদ, প্রধান উপদেষ্টা ড. ফখরুদ্দিন আহমদ, ডেপুটি স্পীকার আখতার হামিদ সিদ্দিকী, তথ্য উপদেষ্টা ব্যরিস্টার মইনুল হোসেন, সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল মইন উদ্দিন আহমদ, নৌবাহিনী প্রধান ভাইস এডমিরাল সরোয়ার জাহান নিজাম, সেনাবাহিনীর প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার লে. জেনারেল মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী প্রমুখ সরকারি কর্মকতাএছাড়াও জানাজায় উপস্থিত হয়েছিলেনÑসাবেক প্রেসিডেন্ট জাতীয় পার্টি প্রধান হুসেন মোহাম্মদ এরশাদ, বিএনপির মহাসচিব খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন, জামাতে ইসলামীর সেক্রেটারী জেনারেল আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ, ইসলামী ঐক্যজোটের সাবেক এমপি মাওলানা ফজলুল হক আমিনী, মসজিদ মিশনের যয়নুল আবেদিন প্রমুখ আরো অসংখ্য বিশেষ ব্যক্তিবর্গজানাজা শুরু হয় একেবারে মেঘলা অন্ধকারেজানাজার নামাজ পড়ান খতিব সাহেবের দ্বিতীয় ছেলে সিলেট জামেয়া কাসিমুল উলূম দরগাহে হযরত শাহজালাল (র.) মাদ্রাসার মুহাদ্দিস মাওলানা আতাউল হকজানাজার নামাজের শেষে খতিব মাওলানা উবায়দুল হকের মুখ শেষবারের মতো একবার দেখতে যখন লাখো মানুষের মিছিল লাশের দিকে এগিয়ে আসছে তখনই আকাশ ভেঙে ঝড়Ñবৃষ্টি নামতে শুরু করেশুরু হয় উল্টো দিকে মানুষের দৌড়লাশ নিয়ে যাওয়া হয় আজিমপুর গোরস্থানে এবং বৃষ্টির মধ্যেই দাফন করা হয় বড়কাটারা মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা প্রিন্সিপাল মাওলানা আব্দুল ওয়াহাব পিরজী হুজুর (র.) এবং আজিমপুর ফয়জুল উলূম মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা প্রিন্সিপাল মাওলানা আব্দুল্লা (র.)এর কবরের কাছাকাছি একেবারে গোরস্থানের ভেতরের রাস্তা ঘেষে

হালাল ব্যবসার প্রতি খতিব মাওলানা উবায়দুল হকের গুরুত্বারোপ
খতিব মাওলানা উবায়দুল হক (র.) কে আমরা এই সময়ের একজন সংস্কারক বলতে পারিবাংগালী আলেমদের মধ্যে তাঁর পূর্বে যারা খ্যাতি অর্জন করেছেন রাজনৈতিক কিংবা সামাজিক সংস্কার কাজে, তাদের সবার প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলতে পারি খতিব উবায়দুল হকের মতো সর্বদিকে এতো ব্যাপক প্রভাব বিস্তারকারী তাঁর পূর্বে অন্য কাউকে আমরা হয়তো দেখতে পাবো নাএই তো তিনি মাত্র ইন্তোকাল করলেন ৬ অক্টোবর ০৭এখনো তাঁর জীবনের পূর্ণাঙ্গ কর্মগুলো আমাদের সামনে আসেনিতাঁর ৭৯ বছর জীবনের পূর্ণাঙ্গ কর্ম আমাদের সামনে আসতে আসতে হয়তো আরো দশ বছর চলে যাবেআমরা এই দশ বছরে যা লিখবো এগুলোকে অবশ্যই তাঁর পূর্ণাঙ্গ জীবনী বলা যাবে নাতবে আমাদের খণ্ড খণ্ড চিত্রাঙ্কণ হয়তো এক সময় বিশাল এক নদীর চিত্র জাতির সামনে নিয়ে আসবেঅতঃপর এই চিত্রগুলোর সমম্বয়ে যে বা যারা লিখবে, তাদের ঐ কর্মকে পূর্ণাঙ্গ কর্ম বলা যেতে পারেআর যখন খতিব মাওলানা উবায়দুল হকের পূর্ণাঙ্গ জীবন ও কর্ম আমাদের সামনে চলে আসবে, তখন আমরা বুঝতে পারবো তিনি কতো বিশাল ব্যক্তিত্ব ছিলেন২৯ অক্টোবর ০৭ খতিব মাওলানা উবায়দুল হকের জীবন ও কর্ম শীর্ষক আমার একটি দীর্ঘ লেখা গ্রন্থাকারে প্রকাশ করেছে ইসলামিক কালচারাল ফোর্সগ্রন্থটি প্রকাশের পর আমার বার বার মনে হলো সম্পূর্ণ অপূর্ণাঙ্গ থেকে গেলোএতো ছোট পরিসরে একটা বিশাল নদীকে ধারণ করা সত্যই অসম্ভবআন্তর্জাতিক কোরআন তেলাওয়াত পরিষদ, বাংলাদেশ ( সংপেÑইকরা) একটা স্মারক বের করছে খতিব সাহেবের জীবন ও কর্ম নিয়েআমাকে বলা হলো একটা লেখা দিতেআমি এই লেখাটা তৈরি করতে আমার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সিটি অফসেট প্রেসে বসে যখন খতিব সাহেবের বিভিন্ন দিক নিয়ে ভাবছিলাম, তখন বিস্মৃতির দেয়াল সরিয়ে কিছু স্মৃতি আমাকে নাড়িয়ে যাচ্ছিলো২০ মে ২০০২ খ্রিস্টাব্দে এই প্রেসের উদ্ভোধনী অনুষ্ঠানে আমরা অতিথী হিসেবে দাওয়াত করেছিলাম ভাষা সৈনিক অধ্য মাসউদ খান, ড. কবির চৌধুরী, হাফেজ মাওলানা মনছুরুল হাসান রায়পুরী, আলহাজ্ব সৈয়দ আতাউর রহমান, এম. এ. করিম চৌধুরী. কবি কিশওয়ার ইবনে দিলওয়ার প্রমূখকেএদিনের অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথী ছিলেন খতিব মাওলানা উবায়দুল হক (র.)সেই দিন খতিব সাহেব (র.) সুইচ টিপে যে ভঙ্গিতে মিশিন চালু করেছিলেন, আজ আমার স্মৃতিতে সেই চিত্র খুব বেশি খেলা করছে প্রেসের চেয়ারে বসেআর হালাল ব্যবসা এবং প্রেস ব্যবসা সম্পর্কিত খতিব সাহেবের বক্তব্য সেই সময়ে অনেকদিন আমাদের বন্ধু মহলে আলোচনার বিষয় ছিলোখতিব সাহেব সেদিন বলেছিলেন- আজ একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আমরা সমবেত হয়েছি, যাতে এ প্রতিষ্ঠানের উন্নতির জন্য দোয়াতে সামিল হই।.... যারা এই প্রেসের উদ্যোক্তা-পরিচালক তাদেরকে আমি বিশেষ কিছু কথা বলতে চাই; আপনারা স্মরণ রাখবেন-এই ব্যবসা শুধু দুনিয়া অর্জন বা জীবিকা হাসিলের জন্যই নয়এটা হল একটি ইবাদতনবী করিম (সা.) এক হাদিসে এরশাদ করেছেন কাসফুল হালাল ফরিজাতুন বাদাল ফরিজা অর্থাৎ হালাল রুজী অর্জন করা অন্যান্য ফরজের মতই একটি ফরজআমাদের জানা আছে ফরজ কাজ ইবাদতই হয়ে থাকে, তা আর অন্যান্য দুনিয়াবী কাজের মত থাকে নাআর এই ব্যবসায়ী ফরজ কাজ আদায় করতে গিয়ে এ পৃথিবীতে ইসলামের প্রচার এবং প্রসার ঘটেছেআমাদের নবী করিম (সা.) এর বড় বৈশিষ্ট্যগুলির একটি ছিলো তিনি একজন বড় ব্যবসায়ী ছিলেনতিনি বাল্যকাল থেকে ব্যবসা শুরু করে নবুওয়াত প্রাপ্তির পূর্ব পর্যন্ত ব্যবসা করেছেনতিনি সাহাবায়ে কেরামদেরকে ব্যবসার প্রতি উৎসাহিত করেছেনব্যবসায়ীদের মর্যাদা ঘোষণায় তিনি বলেছেনÑ‘ আততাজিরু ছাদিকুল আমীন, মাআন নাবীইয়িনা ওয়া সিদ্দিকিন, ওয়াশ শুহাদাÑই ইয়াওমাল কিয়ামাঅর্থাৎ যে ব্যবসায়ী সত্যবাদী হবে তার হাশর হবে নবী, সিদ্দিক এবং শহীদদের সাথেএর চেয়ে বড় মর্যাদা আর কি হতে পারে ? সিটি অফসেট প্রেসের পরিচালকেরা যদি সততার সাথে ব্যবসা করেন, তবে তা হবে ইবাদত, সাথে সাথে ব্যবসারও উন্নতি হবে, সাধারণ মানুষ উপকৃত হবে, নিজেদের লাভ হবেঅনেকে ব্যবসায় তিগ্রস্থ হয়ে বলেন পুঁজির অভাবে এমন হয়েছে কিন্তু আমাদের নবী করিম (সা.) বলেছেন-তোমরা যদি ব্যবসায় আসল পুঁজি রা কর তবে কখনও তিগ্রস্থ হবে নাআর সেই আসল পুঁজি হল দুটি জিনিষ-১) সত্যবাদীতা, ২) আমানতদারীআমানতদারীর ভেতর ওয়াদা রাও সামিলভারত উপমহাদেশের মুসলমানদের মধ্যে প্রথম প্রেসের ব্যবসা শুরু করেছিলেন আমাদের বুজুর্গ হযরত মাওলানা আহমদ আলী সাহারনপুরী (রহ.)সেই প্রেসে কাজ করেছেন দারুল উলুম দেওবন্দের প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা কাসিম নানুতবি (রহ.)এর পূর্বে ভারতবর্ষে ছাপাকৃত ইসলামিক কিতাবের প্রচলন ছিল নামাওলানা আহমদ আলী সাহারনপুরী ও মাওলানা কাসিম নানুতবি (রহ.)র অকান্ত প্রচেষ্টায় ছাপাকৃত কোরআন-হাদীস তাফসিরের ধারা প্রথম শুরু হয়আমরা দোয়া করি এই প্রেসের পরিচালকরা যেন সেই ধারাকে অব্যাহত রাখতে পারেনআসুন আমরা সবাই মিলে দোয়া করি -হে আলাহ, এই প্রেস ব্যবসা তোমার প্রিয় হাবিব হযরত মোহাম্মদ (সা.) এর সুন্নত অনুসারে শুরু করা হচ্ছেআপনি এই ব্যবসাকে কবুল করুনযেভাবে ব্যবসা করলে আপনি খুশি হবেন এই প্রেসের মালিকদেরকে সেভাবে ব্যবসা করার তৌফিক দিনএই প্রেস ব্যবসাকে দ্বীনের খেদমত ও প্রচারে অবদান রাখার তৌফিক দিনহে রাব্বুল আলামিন -এই প্রেসের পরিচালকদের ভেতর সততা, আমানতদারী, ওয়াদা রা ইত্যাদি ভাল দিকগুলিকে প্রতিষ্ঠিত করে দিনহে আল্লাহ-আমাদের সবাইকে কবুল করুনখতিব সাহেবের এই বক্তব্য সেদিন আমার ভেতর যে প্রভাব বিস্তার করেছিলো পরবর্তিতে প্রেস পরিচালনার ক্ষেত্র তা পালনের চেষ্টা করেছিপ্রেস চালুকালে অনেকে আমাকে বলেছিলেন ইংল্যান্ড থেকে এসে ব্যবসা করে বেশিদিন থাকতে পারবো নাকিন্তু খতিব সাহেবের এই বক্তব্যকে আদর্শ করে প্রেস পরিচালনার ক্ষেত্র চেষ্টা করেছি বলেই হয়তো এখনো দাঁড়িয়ে আছিশুধু দাঁড়িয়ে আছি বললে হয়তো ভুল হবে, পূর্ণাঙ্গরূপেই দাঁড়িয়ে আছিআমার বিশ্বাস এই বক্তব্যকে যদি সকল ব্যবসায়ীরা পূর্ণাঙ্গরূপে অনুসরণ করেন, তবে ব্যবসার ক্ষেত্রে উপকৃতই হবেনমহান আল্লাহ পাক আমাদের সবাইকে এই কথাগুলোর উপর আমলের তৌফিক দান করুন এবং এর সকল নেকি খতিব মাওলানা উবায়দুল হকের আমলানামায় লিখে দিনআমীন


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

ইসলামের দৃষ্টিতে বৃক্ষরোপণ ও সবুজ বনায়নের গুরুত্ব

ইসলামের দৃষ্টিতে বৃক্ষরোপণ ও সবুজ বনায়নের গুরুত্ব হাফেয মাওলানা মুফতি ওসমান আল-হুমাম উখিয়াভী সিনিয়র মুহাদ্দিস জামেয়া ইসলামিয়া বাইতুল ক...