খতিব মাওলানা উবায়দুল হকের জীবন ও কর্ম
খতিব উবায়দুল হক : জীবন ও কর্ম
লিখেছেন মাওলানা
মুফতি ওসমান আল-হুমাম
প্রকাশনায়:খতমে নবুওয়াত প্রকাশনী
প্রকাশনায়:খতমে নবুওয়াত প্রকাশনী
-------------------------------------------------------------------------------------------------
মৃত্যু সংবাদ
অন্য মনস্ক ছিলাম তখন, একেবারে অন্য মনস্ক। দৈনিক সিলেটের ডাক অফিস থেকে মোবাইলে যখন জানতে চাওয়া হলো, খতিব সাহেবের কোন খবর জানি কি না? তখন আমি অন্য মনস্ক ছিলাম। না, আমার কোন খবর জানা নেই। মৃত্যু সংবাদ হুট করে দিতে নেই ভেবে হয়তো সিলেটের ডাকের নুর আহমদ আমাকে কোন খবর দিলো না, শুধু বললো বিশেষ সূত্রে তারা জেনেছে-খতিব সাহেব খুব অসুস্থ। আমি যেনো একটু খবর নিয়ে তাদেরকে জানাই। নুর আহমদের এতটুকু কথাই আমার অনুভূতির অর্ধেক নাড়িয়ে যায়। আমি বুঝতে পারি কিছু একটা ঘটে গেছে। দ্রুত সুবিদবাজারে ফোন করে জানতে পারি খতিব সাহেব আর বেঁচে নেই। ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। তখন ঘড়িতে রাত সাড়ে এগারোটা কিংবা বারোটা। তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন রাত সোয়া এগারোটায়। সেদিন ছিলো শনিবার, ৬ অক্টোবর ২০০৭। ২১ আশ্বিন ১৪১৪ বাংলা। ২৩ রমজান ১৪২৮ হিজরি। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স ছিলো ৭৯ বছর ৫ মাস।
অন্য মনস্ক ছিলাম তখন, একেবারে অন্য মনস্ক। দৈনিক সিলেটের ডাক অফিস থেকে মোবাইলে যখন জানতে চাওয়া হলো, খতিব সাহেবের কোন খবর জানি কি না? তখন আমি অন্য মনস্ক ছিলাম। না, আমার কোন খবর জানা নেই। মৃত্যু সংবাদ হুট করে দিতে নেই ভেবে হয়তো সিলেটের ডাকের নুর আহমদ আমাকে কোন খবর দিলো না, শুধু বললো বিশেষ সূত্রে তারা জেনেছে-খতিব সাহেব খুব অসুস্থ। আমি যেনো একটু খবর নিয়ে তাদেরকে জানাই। নুর আহমদের এতটুকু কথাই আমার অনুভূতির অর্ধেক নাড়িয়ে যায়। আমি বুঝতে পারি কিছু একটা ঘটে গেছে। দ্রুত সুবিদবাজারে ফোন করে জানতে পারি খতিব সাহেব আর বেঁচে নেই। ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। তখন ঘড়িতে রাত সাড়ে এগারোটা কিংবা বারোটা। তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন রাত সোয়া এগারোটায়। সেদিন ছিলো শনিবার, ৬ অক্টোবর ২০০৭। ২১ আশ্বিন ১৪১৪ বাংলা। ২৩ রমজান ১৪২৮ হিজরি। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স ছিলো ৭৯ বছর ৫ মাস।
জন্ম, পরিবার, গ্রাম
সিলেট শহর থেকে প্রায় ৭৪ কিলোমিটার দূরে বাংলাদেশের সর্ব
উত্তর-পূর্বাংশের যে ভূমিতে ভারতের কাছাড় এবং বদরপুর ভেদ করে বরাক নদী উত্তরে
সুরমা আর দেিণ কুশিয়ারা নামে খ্যাতি লাভ করেছে, সেই সবুজে ঢাকা
গর্ব করার মতো ঐতিহ্যবাহী গ্রাম- বারঠাকুরিতে ১৩৩৫ বাংলার ১৪ বৈশাখ মোতাবেক ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দের
২ মে শুক্রবার উপমহাদেশের প্রখ্যাত আলেমে দ্বীন, জাতীয়
মসজিদ বায়তুল মোকাররমের খতিব মাওলানা উবায়দুল হকের জন্ম। ‘বারঠাকুরী’ নাম থেকেই বুঝা যায় এই গ্রামের ধর্মিয়
ঐতিহ্য প্রাচীন সময়ের। ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে ভরাট হয়ে যাওয়া
স্থানীয় গায়বি দীঘির উত্তর পশ্চিম কোণে মসজিদ নির্মাণের জন্য মাটি খনন কালে আট ফুট
প্রস্থ নকশি ইটের তৈরি একটি দেয়াল এবং ৩ ফুট লম্বা ও ১ ফুট প্রস্থ একটি শিলালিপি
পাওয়া যায়,
যার এক দিকে আরবি ক্যালিওগ্রাফিতে মসজিদ সংক্রান্ত হাদিস
এবং অন্য দিকে গৌতম বুদ্ধের মূর্তি রয়েছে। শিলালিপিটি সিলেট কেন্দ্রিয় মুসলিম সাহিত্য সংসদে সংরতি
রয়েছে। আবিষ্কৃত দেয়াল, হাজার বছরের
পুরাতন বৌদ্ধ সভ্যতার নিদর্শন। আর
শিলালিপিতে মসজিদ সংক্রান্ত হাদিস আর গৌতম বুদ্ধের মূর্তি পাশাপাশি থাকা থেকে
গবেষকরা মনে করেন এই অঞ্চলে মুসলমানদের আগমনপূর্ব সময়ে বৌদ্ধদের প্রভাব ছিলো এবং
মুসলমানদের আগমনের পরও দীর্ঘদিন তারা একত্রে বাস করেছেন। হিন্দু পুরোহিতদের মতো বৌদ্ধরাও ধর্মগুরুদেরকে ‘ঠাকুর’ বলে থাকেন। ‘বারঠাকুরী’ নামকরণ যে বৌদ্ধ ঠাকুর থেকে, তার প্রমাণ হিসেবে গবেষকরা গায়বি দীঘিতে প্রাপ্ত শিলালিপির
কথা বলে থাকেন। এই গ্রামের গায়বি দীঘির প্রচুর
কেরামতি এখনও স্থানিয় মুরব্বিদের মুখে শোনা যায়। মিথলজি বলেন আর সত্য, সবই নিজেদের
বিশ্বাসের ব্যাপার। যেমন, বারঠাকুরী
গ্রামে এখনো অনেকে বিশ্বাস করেন, ‘অনেক আগে গ্রামের দরিদ্র মানুষদের কোন
অনুষ্ঠানাদি উপলে হাড়ি-পাতিল প্রয়োজন হলে গায়বি দীঘি থেকে পাওয়া যেতো। অনুষ্ঠান শেষে তা দীঘির পাড়ে রেখে দিলে আবার চলে যেতো। একবার কেউ একজন একটি থালা ফেরৎ না দেওয়ায় এই দীঘির অলৌকিক
ঘটনা বন্ধ হয়ে যায়।’ সে যাই হোক, এই গ্রামে এক সময় হিন্দু কিংবা বৌদ্ধ বারোজন ঠাকুরের বসতি
ছিলো এবং ওদের থেকেই এই গ্রামের নাম বারঠাকুরী। ‘জকিগঞ্জের ইতিহাস ও ঐতিহ্য’ গ্রন্থের
তথ্যানুসারে ইসলাম প্রচারের প্রথম দিকে এই অঞ্চলের বারোজন বৌদ্ধ ঠাকুর এক সাথে
ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে ছিলেন বলে এই গ্রামের নাম বারঠাকুরী।(কিংবদন্তী এবং নামকরণ, পৃষ্টা-৩৩৫)। বর্তমানে সিলেট জেলার সবচেয়ে বেশি আলেম অধ্যুষিত এলাকা
জকিগঞ্জ-কানাইঘাট। বলা হয়ে থাকে, এই অঞ্চলের আলেমরা যাকে নির্বাচনে সমর্থন করেন তিনিই
নির্বাচনে সফল হয়ে থাকেন। গ্রাম ভিত্তিক আলেমের সংখ্যা হিসেব
করলে বারঠাকুরী গ্রামে এখনও অধিকাংশই আলেম। খতিব মাওলানা উবায়দুল হকের পূর্বেও এই গ্রামের ইতিহাসে আমরা
দেখেছি সিলেটী নাগরী ভাষার কবি সুফি মাওলানা মোহাম্মদ সেলিম ওরফে শিতালংশাহ (র.) এবং
হাকিমুল উম্মত মাওলানা আশরাফ আলী থানবি (র.)এর আধ্যাত্মিক খলিফা ও উপমহাদেশের
খ্যাতনামা শায়খুল হাদিস আল্লামা আনওয়ার শাহ কাশ্মিরী (র.)এর হাদিসের শিষ্য মাওলানা
জহরুল হক(র.) সহ এমন অনেক খ্যাতনামা আলেমের জন্ম এখানে। তবে খতিব মাওলানা উবায়দুল হকের মতো অন্য কেউ দেশ-বিদেশে এতো
সাড়া জাগাতে পারেননি। অবশ্য দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আজও
এই গ্রামে সাহিত্য প্রেমিক শেকড় সন্ধানি আর ভক্তবৃন্দ আসেন শিতালংশাহের মাজারে। মাওলানা জহরুল হক হলেন খতিব মাওলানা উবায়দুল হকের পিতা। তিনি ১৩৩৫ হিজরিতে দারুল উলুম দেওবন্দ থেকে হাদিসের
সর্বোচ্চ ডিগ্রি অর্জন করে ১৩৩৬ হিজরিতে হাকিমুল উম্মাত মাওলানা আশরাফ আলী থানবী (র.)এর
কাছ থেকে খেলাফতি লাভ করেছিলেন। খতিব
মাওলানা উবায়দুল হকের পিতা ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল এবং বাংলাদেশে ‘জহরুল হক’ নামে পরিচিত হলেও নিজ এলাকা জকিগঞ্জের
লোকেরা তাঁকে জানতেন ‘উরফিজ আলী মৌলভী’ নামে। স্থানীয়
মুরুব্বীদের সাথে আলাপ করে জানা যায় ‘উরফিজ আলী মৌলভী’ তাঁর সময়ে অনেক কিংবদন্তির জনক এবং বড় আলেম ছিলেন। এখনও গ্রামের প্রবীণদের কাছে তাঁর অনেক কেরামতির কথা শোনা
যায়। মাওলানা জহরুল হক ওরফে উরফিজ আলী মৌলভী সম্পর্কে মাওলানা
তাজুল ইসলাম আউয়াল মহল লিখেছেন-‘তিনি এতোই তাক্বওয়া সম্পন্ন বুজুর্গ
ছিলেন যে নিজ খরচে যাতায়াত ও খানা সাথে নিয়ে বিভিন্ন স্থানে ওয়াজ-নসিহত করে সমাজে
এক বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। যা যুগ
যুগ ধরে আগত বংশধরদের প্রেরণা যোগাবে। এ আল্লাহর
ওলী আত্মপ্রচার বিমূখ রাহেলিল্লাহের এক নিবেদিত প্রাণ ব্যক্তিত্ব। তিনি ছিলেন সমসাময়িক কালের এক যুগ সংস্কারক।’(ইসলামী রেনেসাঁয় অনন্য যাঁরা, পৃষ্টা-১০১)। ১৩৬৪ হিজরিতে মাওলানা জহরুল হক (র.) ইন্তেকাল করেন। গায়বি দীঘি আর ত্রি-নদীর মিলন কেন্দ্রের মধ্যখানে একটি জাম
গাছের নীচে তাঁর কবর রয়েছে। মাওলানা
জহরুল হকের পিতা ছিলেন মুন্সী উমীদ রেযা এবং দাদা আদেল রেযা। বিশেষ সূত্রে প্রাপ্ত তথ্যানুসারে আমরা বলতে পারি, খতিব মাওলানা উবায়দুল হকের মা মুসাম্মাৎ আয়েশা বেগম একজন
অত্যন্ত পরহেজগার, কর্তৃত্বশীলা, পর্দানশীলা এবং সুন্দরী মহিলা ছিলেন। তিন ভাইয়ের মধ্যে খতিব সাহেব ছিলেন দ্বিতীয়, প্রথম ছিলেন মাওলানা আহমদুল হক ছিলেন একজন প্রবীণ গ্রন্থ
ব্যবসায়ী। সিলেট শহরের জিন্দাবাজারে
স্বাধীনতাপূর্ব সময়ে দীর্ঘদিন আশরাফিয়া কুতুবখানা নামে তাঁর একটি বইয়ের দোকান ছিলো। তৃতীয় ছেলে মাওলানা আব্দুল হক। তিনি দীর্ঘদিন ঢাকা আলিয়া মাদ্রাসার সিনিয়র শিকের দায়িত্ব
পালন করে অবসর নেওয়ার পর বর্তমানে একটি কওমী মাদ্রাসায় হাদিসের শিক্ষকের দায়িত্বে
আছেন। মুসাম্মাৎ আমাতুল্লাহ, মুসাম্মাৎ সাঈদা, মুসাম্মাৎ আবিদা এবং মুসাম্মাৎ হামিদা এই তাঁর মোট চার বোন।সিলেট থেকে জকিগঞ্জ যাওয়ার পথে মূল রাস্তার ডান দিকে শিতালং
শাহের মাজার এবং বাম দিকে খতিব মাওলানা উবায়দুল হকের জন্ম ভূমি বারঠাকুরী গ্রাম। এই গ্রামের নামেই বর্তমানে গোটা ইউনিয়নের নাম ৭ নং
বারঠাকুরী ইউনিয়ন।
খতিব সাহেবের শিক্ষা জীবন খতিব মাওলানা উবায়দুল হকের পিতা মাওলানা জহরুল হক দেওবন্দ থেকে দেশে ফিরে প্রথম কয়েকদিন ঢাকায় মাওলানা মুফতি দীন মুহাম্মদ (র.) এর প্রতিষ্ঠিত বেগম বাজার মসজিদ সংলগ্ন ক্বাসিমুল উলূম মাদ্রাসায় শিকতা করেন। পরে মুফতি দীন মুহাম্মদ বার্মায় চলে গেলে মাদ্রাসায় কিছু অনিয়ম দেখা দিলো। তখন খতিব সাহেবের বাবা গ্রামের বাড়ি জকিগঞ্জের বারঠাকুরীতে চলে আসেন। এই সময় কিছু ছাত্রও তিনির কাছে আসেন প্রাইভেট পড়ার জন্য। তিনি গ্রামের মসজিদের বারান্দায় ওদেরকে পড়াতে শুরু করেন। পরবর্তিতে তা মাদ্রাসায় রূপান্তরিত হয়। অতঃপর তিনি মসজিদের দণি পাশে একটা ছন-বাঁশের ঘর তৈরি করেছিলেন বাইরের ছাত্রদের থাকার জন্য। খতিব সাহেবের নিজের ভাষ্যমতেÑ‘ঐ সময় আমরার কিছু সুদবুদ হইছে, ওনিই পড়াইছেন আমাদেরকে। ঐ মসজিদে থাকিয়াই আমরা কোরআন শরিফ পড়ছি। এরপরে উর্দু, ফার্সি প্রাথমিক কিতাবাদি কিছু পড়ছি। একবার আমাকে পাঠশালা স্কুল, বাবুর বাড়ি, নিজ গ্রাম, বারঠাকুরী সংলগ্ন, ওখানে পাঠাইলেন এবং বললেন যে, তুমি স্কুলে কিছু পড়, প্রাথমিক শিা লাভ করো। আমি ঐখানে গেলাম। বাবুর বাড়ির স্কুল, মাষ্টার-শিক তারা খুবই মেধাবি এবং যোগ্য কিন্তু তাদের আচরণ ছিলো হিন্দুয়ানী। যেমন, সালামের জায়গায় আদাব, মাথা নত করা ইত্যাদি আমার পছন্দ লাগলো না। আসিয়া আব্বাকে বললাম যে, ঐখানেতো সালাম-সুলামের নিয়ম নাই, শুধু আদাব-উদাব এইসব কথা-বার্তা। আমারতো ইচ্ছা করে না যাইতে। তিনি বললেন-তবে আর যাইয়ো না। ঐ শেষ আমার স্কুলের পড়া। দু-একদিন মনে হয় গেছিলাম, এরপরে আর না। আরো কিছু আব্বার কাছে পড়ার পর বয়স যখন আট-দশ কিংবা এগারো বছর হয়েছে তখন আমাকে পাঠাইদিলেন ঘুংগাদি, মাওলানা আতহার আলী সাহেবের বাড়িতে মাদ্রাসায়।’ মোটকথা খতিব মাওলানা উবায়দুল হকের প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় নিজ বাড়িতে পিতার কাছে। এরপর তিনি সিলেটের বিয়ানিবাজার থানার অন্তর্গত ঘুংগাদি গ্রামে হাকিমুল উম্মত মাওলানা আশরাফ আলী থানবি (র.)এর খলিফা মাওলানা আতহার আলী (র.) প্রতিষ্ঠিত মাদ্রাসায় চলে যান। উল্লেখ্য যে, মাওলানা আতহার আলী(র.) কিশোরগঞ্জি বলে ইতিহাসে পরিচিতি লাভ করলেও মূলত তাঁর বাড়ি সিলেটের বিয়ানিবাজারের ঘুংগাদি গ্রামে। ঘুংগাদি মাদ্রাসায় তখন একজন শিক ছিলেন জকিগঞ্জের মাওলানা শামসুল হক (র.) শাহবাগি। খতিব সাহেব তিনির কাছে ফার্সি, মিজান-মনশাইব ইত্যাদি প্রাথমিক কিছু কিতাব পড়েন। দুই বছর ছিলেন তিনি ঘুংগাদিতে। এরপর তিনি হবিগঞ্জে গিয়ে মাওলানা মুদ্দাস্সির আহমদ ও মাওলানা মুসির আলী (র.)এর কাছে কিছুদিন লেখা-পড়া করেন। ওরা দুজনই ছিলেন দারুল উলূম দেওবন্দ থেকে ডিগ্রিপ্রাপ্ত বড় আলেম। অতঃপর ফিরে আসেন নিজ বাড়িতে এবং ভর্তি হোন পিতার প্রতিষ্ঠিত মুন্সিবাজার সংলগ্ন আয়ারগাঁও মাদ্রাসায়। কিছুদিন এখানে পড়ার পর ১৩৬২ হিজরি মোতাবেক ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে তিনি উচ্চ শিক্ষার জন্য চলে যান ভারতের উত্তর প্রদেশে অবস্থিত বিশ্ববিখ্যাত ইসলামি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দারুল উলূম দেওবন্দে। খতিব সাহেব সেখানে ১৩৬২ হিজরি মোতাবেক ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে কাফিয়ার কাসে (বর্তমান বাংলাদেশের কওমি মাদ্রাসাগুলোর হিসেবে দশম শ্রেণী) ভর্তি হয়েছিলেন। খতিব সাহেবের নিজের ভাষ্যানুসারে তিনি কাস ছুওম পড়ে গিয়ে এই কাসেই আবার ভর্তি হয়েছেন। দু বছর পর ১৩৬৪ হিজরিতে তিনি তাঁর পিতার অসুস্ততার সংবাদ শুনে বাড়িতে আসেন। আনুমানিক দশ বার দিন পর তাঁর পিতা মাওলানা জহরুল হকের ইন্তেকাল হয়। (ইন্নালিল্লাহি....রাজুন)। পিতার ইন্তেকালের পর এক সপ্তাহের মধ্যে তিনি পুনরায় দেওবন্দ চলে যান। তিনি হিজরি ১৩৬৬/৬৭ মোতাবেক ১৯৪৭/৪৮ খ্রিস্টাব্দ শিক্ষাবর্ষে দাওরায়ে হাদিস, হিজরি ১৩৬৭-৬৮ মোতাবেক ১৯৪৮/৪৯ শিক্ষাবর্ষে দাওরায়ে তাফসির এবং হিজরি ১৩৬৮-৬৯ মোতাবেক ১৯৪৯/ ৫০ খ্রিস্টাব্দ শিক্ষাবর্ষে ফনূনাতের কিতাবসমূহ পড়েন এবং খোশকতের মশ্ক করেন।উল্লেখ্য যে, তিনি দাওরায়ে হাদিসের বার্ষিক পরীক্ষায় প্রতি বিষয়ে সমস্ত প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রেকর্ড পরিমাণ নম্বর লাভ করে দারুল উলূম দেওবন্দের ইতিহাসে বাংগালি ছাত্রদের মুখ উজ্জল করেছিলেন।
দারুল উলূম দেওবন্দে যারা তাঁর শিক ছিলেনদারুল উলূম দেওবন্দে খতিব মাওলানা উবায়দুল হক (র.) পরিপূর্ণ বোখারি শরিফ এবং তিরমিযি শরিফ প্রথম খণ্ড পড়েন শায়খুল ইসলাম মাওলানা সাইয়েদ হোসাইন আহমদ মাদানি (র.)এর নিকট, পূর্ণাঙ্গ মুসলিম শরিফ পড়েন মাওলানা ইবরাহিম বলিয়াবি (র.)এর নিকট, পরিপূর্ণ আবু দাউদ শরিফ, তিরমিযি শরিফ দ্বিতীয় খণ্ড, শামায়েলে তিরমিযি ও হেদায়া আখেরাইন পড়েন মাওলানা এযায আলী আমরুহি (র.) নিকট, তাফসিরে বায়যাবি ও তাফসিরে ইবনে কাসির পড়েন মাওলানা ইদরিস কান্দলবি(র.) নিকট (উল্লেখ্য যে, মাওলানা ইদরিস কান্দলবি (র.) দেওবন্দের ছাত্রজীবনে তাঁর পিতা মাওলানা জহরুল হক(র.)এর সহপাঠী ছিলেন), নাসায়ী শরীফ পড়েন মাওলানা ফখরুল হাসান (র.) এর নিকট, ইবনে মাজা শরীফ পড়েন মাওলানা আবদুশ শুকুর দেওবন্দি (র.) এর নিকট, হুজ্জাতুল্লাহিল বালেগা পড়েন মাওলানা কারী মুহাম্মদ তৈয়্যব (র.)এর নিকট, তাফসিরে জালালাইন শরিফ পড়েন হাফেজ মাওলানা মুহাম্মদ আব্দুল জলিল (র.)এর নিকট। খতিব মাওলানা উবায়দুল হক দারুল উলূম দেওবন্দে এছাড়াও আরো যাদের কাছে বিভিন্ন কিতাব পড়েছেন বলে জানা যায়, তাঁরা হলে-মাওলানা আবদুস সামী, মাওলানা আবদুল আহাদ, মাওলানা বশীর আহমদ, মাওলানা মিয়াজী মুহাম্মদ সাঈদ গঙ্গোহী, মাওলানা কারী মুহাম্মদ মিয়া, মাওলানা ইশতিয়াক আহমদ ও মাওলানা হাবীবুল্লাহ বিহারী (র.) প্রমুখ।
খতিব সাহেবের শিক্ষা জীবন খতিব মাওলানা উবায়দুল হকের পিতা মাওলানা জহরুল হক দেওবন্দ থেকে দেশে ফিরে প্রথম কয়েকদিন ঢাকায় মাওলানা মুফতি দীন মুহাম্মদ (র.) এর প্রতিষ্ঠিত বেগম বাজার মসজিদ সংলগ্ন ক্বাসিমুল উলূম মাদ্রাসায় শিকতা করেন। পরে মুফতি দীন মুহাম্মদ বার্মায় চলে গেলে মাদ্রাসায় কিছু অনিয়ম দেখা দিলো। তখন খতিব সাহেবের বাবা গ্রামের বাড়ি জকিগঞ্জের বারঠাকুরীতে চলে আসেন। এই সময় কিছু ছাত্রও তিনির কাছে আসেন প্রাইভেট পড়ার জন্য। তিনি গ্রামের মসজিদের বারান্দায় ওদেরকে পড়াতে শুরু করেন। পরবর্তিতে তা মাদ্রাসায় রূপান্তরিত হয়। অতঃপর তিনি মসজিদের দণি পাশে একটা ছন-বাঁশের ঘর তৈরি করেছিলেন বাইরের ছাত্রদের থাকার জন্য। খতিব সাহেবের নিজের ভাষ্যমতেÑ‘ঐ সময় আমরার কিছু সুদবুদ হইছে, ওনিই পড়াইছেন আমাদেরকে। ঐ মসজিদে থাকিয়াই আমরা কোরআন শরিফ পড়ছি। এরপরে উর্দু, ফার্সি প্রাথমিক কিতাবাদি কিছু পড়ছি। একবার আমাকে পাঠশালা স্কুল, বাবুর বাড়ি, নিজ গ্রাম, বারঠাকুরী সংলগ্ন, ওখানে পাঠাইলেন এবং বললেন যে, তুমি স্কুলে কিছু পড়, প্রাথমিক শিা লাভ করো। আমি ঐখানে গেলাম। বাবুর বাড়ির স্কুল, মাষ্টার-শিক তারা খুবই মেধাবি এবং যোগ্য কিন্তু তাদের আচরণ ছিলো হিন্দুয়ানী। যেমন, সালামের জায়গায় আদাব, মাথা নত করা ইত্যাদি আমার পছন্দ লাগলো না। আসিয়া আব্বাকে বললাম যে, ঐখানেতো সালাম-সুলামের নিয়ম নাই, শুধু আদাব-উদাব এইসব কথা-বার্তা। আমারতো ইচ্ছা করে না যাইতে। তিনি বললেন-তবে আর যাইয়ো না। ঐ শেষ আমার স্কুলের পড়া। দু-একদিন মনে হয় গেছিলাম, এরপরে আর না। আরো কিছু আব্বার কাছে পড়ার পর বয়স যখন আট-দশ কিংবা এগারো বছর হয়েছে তখন আমাকে পাঠাইদিলেন ঘুংগাদি, মাওলানা আতহার আলী সাহেবের বাড়িতে মাদ্রাসায়।’ মোটকথা খতিব মাওলানা উবায়দুল হকের প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় নিজ বাড়িতে পিতার কাছে। এরপর তিনি সিলেটের বিয়ানিবাজার থানার অন্তর্গত ঘুংগাদি গ্রামে হাকিমুল উম্মত মাওলানা আশরাফ আলী থানবি (র.)এর খলিফা মাওলানা আতহার আলী (র.) প্রতিষ্ঠিত মাদ্রাসায় চলে যান। উল্লেখ্য যে, মাওলানা আতহার আলী(র.) কিশোরগঞ্জি বলে ইতিহাসে পরিচিতি লাভ করলেও মূলত তাঁর বাড়ি সিলেটের বিয়ানিবাজারের ঘুংগাদি গ্রামে। ঘুংগাদি মাদ্রাসায় তখন একজন শিক ছিলেন জকিগঞ্জের মাওলানা শামসুল হক (র.) শাহবাগি। খতিব সাহেব তিনির কাছে ফার্সি, মিজান-মনশাইব ইত্যাদি প্রাথমিক কিছু কিতাব পড়েন। দুই বছর ছিলেন তিনি ঘুংগাদিতে। এরপর তিনি হবিগঞ্জে গিয়ে মাওলানা মুদ্দাস্সির আহমদ ও মাওলানা মুসির আলী (র.)এর কাছে কিছুদিন লেখা-পড়া করেন। ওরা দুজনই ছিলেন দারুল উলূম দেওবন্দ থেকে ডিগ্রিপ্রাপ্ত বড় আলেম। অতঃপর ফিরে আসেন নিজ বাড়িতে এবং ভর্তি হোন পিতার প্রতিষ্ঠিত মুন্সিবাজার সংলগ্ন আয়ারগাঁও মাদ্রাসায়। কিছুদিন এখানে পড়ার পর ১৩৬২ হিজরি মোতাবেক ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে তিনি উচ্চ শিক্ষার জন্য চলে যান ভারতের উত্তর প্রদেশে অবস্থিত বিশ্ববিখ্যাত ইসলামি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দারুল উলূম দেওবন্দে। খতিব সাহেব সেখানে ১৩৬২ হিজরি মোতাবেক ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে কাফিয়ার কাসে (বর্তমান বাংলাদেশের কওমি মাদ্রাসাগুলোর হিসেবে দশম শ্রেণী) ভর্তি হয়েছিলেন। খতিব সাহেবের নিজের ভাষ্যানুসারে তিনি কাস ছুওম পড়ে গিয়ে এই কাসেই আবার ভর্তি হয়েছেন। দু বছর পর ১৩৬৪ হিজরিতে তিনি তাঁর পিতার অসুস্ততার সংবাদ শুনে বাড়িতে আসেন। আনুমানিক দশ বার দিন পর তাঁর পিতা মাওলানা জহরুল হকের ইন্তেকাল হয়। (ইন্নালিল্লাহি....রাজুন)। পিতার ইন্তেকালের পর এক সপ্তাহের মধ্যে তিনি পুনরায় দেওবন্দ চলে যান। তিনি হিজরি ১৩৬৬/৬৭ মোতাবেক ১৯৪৭/৪৮ খ্রিস্টাব্দ শিক্ষাবর্ষে দাওরায়ে হাদিস, হিজরি ১৩৬৭-৬৮ মোতাবেক ১৯৪৮/৪৯ শিক্ষাবর্ষে দাওরায়ে তাফসির এবং হিজরি ১৩৬৮-৬৯ মোতাবেক ১৯৪৯/ ৫০ খ্রিস্টাব্দ শিক্ষাবর্ষে ফনূনাতের কিতাবসমূহ পড়েন এবং খোশকতের মশ্ক করেন।উল্লেখ্য যে, তিনি দাওরায়ে হাদিসের বার্ষিক পরীক্ষায় প্রতি বিষয়ে সমস্ত প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রেকর্ড পরিমাণ নম্বর লাভ করে দারুল উলূম দেওবন্দের ইতিহাসে বাংগালি ছাত্রদের মুখ উজ্জল করেছিলেন।
দারুল উলূম দেওবন্দে যারা তাঁর শিক ছিলেনদারুল উলূম দেওবন্দে খতিব মাওলানা উবায়দুল হক (র.) পরিপূর্ণ বোখারি শরিফ এবং তিরমিযি শরিফ প্রথম খণ্ড পড়েন শায়খুল ইসলাম মাওলানা সাইয়েদ হোসাইন আহমদ মাদানি (র.)এর নিকট, পূর্ণাঙ্গ মুসলিম শরিফ পড়েন মাওলানা ইবরাহিম বলিয়াবি (র.)এর নিকট, পরিপূর্ণ আবু দাউদ শরিফ, তিরমিযি শরিফ দ্বিতীয় খণ্ড, শামায়েলে তিরমিযি ও হেদায়া আখেরাইন পড়েন মাওলানা এযায আলী আমরুহি (র.) নিকট, তাফসিরে বায়যাবি ও তাফসিরে ইবনে কাসির পড়েন মাওলানা ইদরিস কান্দলবি(র.) নিকট (উল্লেখ্য যে, মাওলানা ইদরিস কান্দলবি (র.) দেওবন্দের ছাত্রজীবনে তাঁর পিতা মাওলানা জহরুল হক(র.)এর সহপাঠী ছিলেন), নাসায়ী শরীফ পড়েন মাওলানা ফখরুল হাসান (র.) এর নিকট, ইবনে মাজা শরীফ পড়েন মাওলানা আবদুশ শুকুর দেওবন্দি (র.) এর নিকট, হুজ্জাতুল্লাহিল বালেগা পড়েন মাওলানা কারী মুহাম্মদ তৈয়্যব (র.)এর নিকট, তাফসিরে জালালাইন শরিফ পড়েন হাফেজ মাওলানা মুহাম্মদ আব্দুল জলিল (র.)এর নিকট। খতিব মাওলানা উবায়দুল হক দারুল উলূম দেওবন্দে এছাড়াও আরো যাদের কাছে বিভিন্ন কিতাব পড়েছেন বলে জানা যায়, তাঁরা হলে-মাওলানা আবদুস সামী, মাওলানা আবদুল আহাদ, মাওলানা বশীর আহমদ, মাওলানা মিয়াজী মুহাম্মদ সাঈদ গঙ্গোহী, মাওলানা কারী মুহাম্মদ মিয়া, মাওলানা ইশতিয়াক আহমদ ও মাওলানা হাবীবুল্লাহ বিহারী (র.) প্রমুখ।
কর্ম জীবন
হযরত মাওলানা উবায়দুল হকের কর্মজীবন শুরু হয় শিকতা দিয়ে। দারুল উলূম দেওবন্দে পড়াশুনার শেষ বছর ঢাকাস্থ বড় কাটারা
হোসাইনিয়া আশরাফূল উলূম মাদ্রাসার মুহতামিম হযরত মাওলানা আবদুল ওহাব পীরজী হুযুর(র.)এর
আগ্রহে এবং দারুল উলূম দেওবন্দের সম্মানিত শিকদের পরামর্শে খতিব সাহেব বড় কাটারা
মাদ্রাসায় শিক হিসেবে যোগ দেন। এই
মাদ্রাসায় তিনি হিজরি ১৩৬৯ থেকে ১৩৭২ সন পর্যন্ত বুখারি শরিফ, তিরমিযি শরিফ, আবু দাউদ শরিফ ও
বায়যাবি শরিফ প্রভৃতি পড়ান। তিনি
শিকতার চতুর্থ বছর হজ্জের উদ্দেশ্যে বোম্বাই গিয়ে বিভিন্ন কারণে আর যেতে পারেননি। অবশেষে হযরত মাওলানা সাইয়েদ হোসাইন আহমদ মাদানি ও মাওলানা
এযায আলীসহ অন্যান্য শিকদের সাথে দেখা করার উদ্দেশ্যে বোম্বাই থেকে দেওবন্দ চলে
গেলেন। সেখান থেকে মাওলানা এযায আলী (র.) তাঁকে উত্তর প্রদেশস্থ
শাহজাহানপুরের এক মাদ্রাসায় শিকতার জন্য পাঠিয়ে দেন। সেখানে কিছুদিন শিকতা করার পর মাওলানা এযায আলী তাঁকে নিয়ে
আসেন এবং পাকিস্তানের করাচি শহরে অবস্থিত হযরত মুফতী শফী (র.)র দারুল উলূম
মাদ্রাসায় শিকতার জন্য পাঠিয়ে দেন। তিনি
সেখানে শিক্ষাবর্ষ ১৩৭৩ হিজরি মোতাবেক ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দে আবু দাউদ শরিফ ও হেদায়া
আখেরাইন ইত্যাদি কিতাবের পাঠদান করেন। অতঃপর
হাকীমুল উম্মত মাওলানা আশরাফ আলী থানবী(র.)এর খলীফা এবং পাকিস্তান নেজামে ইসলাম
পার্টির শীর্ষ নেতা হযরত মাওলানা আতহার আলী (র.) মুফতী শফী (র.)এর অনুমতিক্রমে
মাওলানা উবায়দুল হককে ঢাকায় নিয়ে এসে নেজামে ইসলাম পার্টির রচনা ও প্রকাশনা
বিভাগের দায়িত্ব দেন। তবে অল্পদিন পর পাকিস্তানের কেন্দ্রীয়
সরকার পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক সরকার ভেঙ্গে সকল রাজনৈতিক দল বেআইনি ঘোষণা
দিয়ে যাবতীয় রাজনৈতিক কার্যকলাপ বন্ধ করে দেয়। যার ফলে নেজামে ইসলাম পার্টির সকল তৎপরতা বন্ধ হয়ে যায়। অন্যদিকে এই সময় মাদ্রাসা-ই আলিয়া ঢাকায় সিনিয়র শিকের একটি
পদ শূন্য হলে মাওলানা উবায়দুল হককে এ পদে যোগদানের জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়। ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি তাঁর শিক হযরত মাওলানা সাইয়েদ
হোসাইন আহমদ মাদানী (র.)এর অনুমতিক্রমে মাদ্রাসা-ই-আলিয়া ঢাকায় যোগ দেন। মাদ্রাসায়ে আলিয়া ঢাকায় তিনি ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দ
পর্যন্ত সহকারী শিক, ১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দ
পর্যন্ত হাদিস বিভাগের লেকচারার, ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দ
পর্যন্ত তাফসির বিভাগে এসিস্ট্যান্ট প্রফেসর, ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দ
থেকে ১৯৭৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এডিশনাল হেড মাওলানা এবং ১৯৮০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯৮৫
খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত হেড মাওলানা পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। ১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দের ২ মে খতিব মাওলানা উবায়দুল হক সরকারি
আলিয়া মাদ্রাসা থেকে অবসর গ্রহণ করেন। মাদ্রাসা-ই
আলিয়া ঢাকায় চাকুরীরত অবস্থায় দেশের কওমী মাদ্রাসাসমূহের সঙ্গেও তাঁর সুগভীর
সম্পর্ক ছিলো। ফলে দেখা গেলো তিনি আলিয়া মাদ্রাসা
থেকে অবসর গ্রহণের পর বিভিন্ন মাদ্রাসা কর্তৃপরে অনুরোধে বিভিন্ন দায়িত্ব পালন
করতে বাধ্য হলেন। যেমন, ১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দ
থেকে বেশ কয়েক বছর ফরিদাবাদ এমদাদুল উলূম মাদ্রাসায়, ১৯৮৬ এবং ৮৭
খ্রিস্টাব্দ এই দুই বছর চট্টগ্রামের পটিয়া মাদ্রাসায়, এবং ১৯৮৭ খ্রিস্টাব্দ থেকে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত সিলেট
কাসিমূল উলূম দরগাহে হযরত শাহজালাল (র.) মাদ্রাসায় শায়খুল হাদিসের দায়িত্বে ছিলেন।তা ছাড়া ১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে কয়েক বছর তিনি ঢাকার
ইসলামপুর ইসলামিয়া মাদ্রাসায় মুহতামিমের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে মৃত্যুণ পর্যন্ত তিনি ঢাকা আজিমপুরের
ফয়জুল উলূম মাদ্রাসার শায়খুল হাদীস ও মুহতামিমের দায়িত্বে ছিলেন। এ ছাড়াও খতিব মাওলানা উবায়দুল হক জামেয়া এমদাদিয়া কিশোরগঞ্জ
এবং কুমিল্লা কাসিমুল উলূম মাদ্রাসার মজলিসে শুরার সভাপতি, সিলেট জামিআ সিদ্দিকিয়ার উপদেষ্টা পরিষদের প্রধান, মঈনুল উলূম হাটহাজারী, পটিয়া মাদ্রাসা
এবং সিলেট জামেয়া কাসিমুল উলূম দরগাহ মাদ্রাসাসহ আরো অনেক ইসলামি শিক্ষা
প্রতিষ্ঠানের মজলিসে শুরার গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলেন। ঢাকা আলিয়া মাদ্রাসার হেড মাওলানার দায়িত্বে থাকাকালিন সময়ে
তিনি ১৯৮৪ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশের জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের খতিবের দায়িত্ব
প্রাপ্ত হয়ে ছিলেন এবং ২০০৭ খ্রিস্টাব্দের ৬ অক্টোবর মৃত্যুণ পর্যন্ত তিনি এই
দায়িত্বে ছিলেন।
ইসলামী ব্যাংকিং ও ইসলামী বীমায় খতিব সাহেবের ভূমিকা
বাংলাদেশ ইসলামী ব্যাংকের শরিয়াহ বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন
খতিব মাওলানা উবায়দুল হক। এ ছাড়া তিনি ছিলেন ইসলামী
ব্যাংকসমূহের শরিয়া কাউন্সিলের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান। বিভিন্ন ইসলামী ব্যাংক, ইসলামী
ইন্স্যুরেন্স ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহের শরিয়াহ বোর্ডের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন
করেছেন তিনি। প্রচলিত বিশ্ব ব্যাংকের পূঁজিবাদি
পদ্ধতি আর নীতির ভেতরে থেকে ইসলামী ব্যাংক নিজস্ব সীমাবদ্ধতা নিয়ে কতটুকু সুদ
মুক্ত? এই প্রশ্ন সামনে রেখে অনেক আলেম খতিব সাহেবের সমালোচনা
করতেন। আমরা দীর্ঘ আলোচনায় না গিয়ে বলবো-নাই মামা থেকে কানা মামা
ভালো’ নীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন খতিব সাহেব। তিনি জাতীয় শরিয়াহ কাউন্সিলের চেয়ারম্যানের দায়িত্বেও ছিলেন। সুদমুক্ত ব্যাংকিং ব্যবস্থা চালুর স্বপ্নে তিনি আজীবন
নিঃস্বার্থ কাজ করেছেন। এমন কি তাঁর জীবনের শেষ খুতবাতেও
সুদের বিরুদ্ধে তীব্র ঘৃণা প্রকাশ করে গেছেন।
খতিব সাহেবের আধ্যাত্মিক জীবন আমরা ইতোমধ্যে জেনেছি যে, খতিব মাওলানা উবায়দুল হক বোখারি শরিফ পড়েছেন হযরত মাওলানা সাইয়েদ হোসেন আহমদ মাদানি (র.) এর কাছে। মাওলানা সাইয়েদ হোসাইন আহমদ মাদানী (র.) তাঁর প্রথম মুর্শিদও ছিলেন। তিনি দারুল উলূম দেওবন্দে তাফসীর কাসে পড়াকালে মাওলানা মাদানির আধ্যাত্মিক শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। হযরত মাদানি (র.) এর ওফাতের পর খতিব সাহেব হাকীমুল উম্মত মাওলানা আশরাফ আলী থানবী (র.)এর খলীফা হযরত মাওলানা আতহার আলী (র.) এবং তাঁর মৃত্যুর পর হযরত থানবি (র.)এর অন্য খলিফা হযরত মাওলানা মুহাম্মদ উল্লাহ হাফেজ্জী হুজুর (র.) থেকে আধ্যাত্মিক ফয়েয হাসিল করেন বলে শোনা যায়। খতিব সাহেবের জীবনী লেখকদের অনেকে লিখেছেন হযরত হাফেজ্জী হুজুর(র.) তাঁকে বায়আত ও খিলাফতি প্রদান করেছেন। হযরত হাফেজ্জী হুজুর (র.) তাঁর পির বা মুর্শিদ ছিলেন কি না তা জানতে চাইলে হযরত খতিব সাহেব মরহুম আমাকে বলেন-আমার পির সাহেব নয়, আবার পির সাহেবও। উনাকে আমি ভক্তি করতাম, কারণ আমার আব্বা এবং হাফেজ্জী হুজুর ছিলেন হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানবী (র.) মুরিদ এবং খলিফা। উনাদের সম্পর্ক ছিলো সেই থানাবন থেকেই। এই হিসেবে উনাকে মুরুব্বী মানতাম। যেমন মাওলানা আতহার আলী সাহেবকে মুরুব্বী মানতাম, তেমনি হাফেজ্জী হুজুরকে।’ এই কথা খতিব সাহেব বেশ কয়েকবার আমাকে বলেছেন। তবে তিনি যে হযরত হাফেজ্জী হুজুরের খলিফা ছিলেন তাতে কোন সন্দেহ নেই। তিনি ইচ্ছেকৃত এই বিষয়টি সর্বদা এড়িয়ে যেতেন। কারণ কি তা তো আমরা স্পষ্ট বলতে পারবো না। তবে আমার ধারণা তিনি কাউকে মুরিদ করতে চাইতেন না বলে এই আত্মগোপনের পথ অবলম্বন করে ছিলেন। ইংল্যান্ডে একবার এই রকমের একটা ঘটনাও ঘটেছিলো। ফেনির মাওলানা নুরুল্লাহ সাহেব বার্মিংহামে থাকেন। তিনি তাঁর বাসায় খতিব সাহেবকে দাওয়াত করে নিয়ে নিজে মুরিদ হতে চাইলে খতিব সাহেব খুব রেগে গিয়ে বললেন-‘আমি পির হইলাম কবে?’ মাওলানা নুরুল্লাহ সাহেব বললেন-‘আপনারতো হযরত হাফেজ্জী হুজুর (র.) এর এজাজত আছে। আমি দীর্ঘ দিন ঢাকায় হযরত হাফেজ্জী হুজুরের কামরাঙিরচর মাদ্রাসায় শিক ছিলাম এবং সেখানে যেনেছি।’ খতিব সাহেব সেদিন মাওলানা নুরুল্লাহ সাহেবকে মুরিদ না করলেও তাঁর এই কথার কোন প্রতিবাদ করেননি। এই হিসেবে আমরা বলতে পারি খতিব সাহেব হাফেজ্জী হুজুরের খলিফা ছিলেন। হযরত হাফেজ্জী হুজুর (র.)এর ইন্তেকালের পর খতিব সাহেব হযরত থানবীর সর্বকনিষ্ঠ খলিফা ভারতের মাওলানা আববারুল হক সাহেবের সঙ্গে আধ্যাত্মিক সম্পর্ক স্থাপন করে ছিলেন।
খতিব সাহেবের আধ্যাত্মিক জীবন আমরা ইতোমধ্যে জেনেছি যে, খতিব মাওলানা উবায়দুল হক বোখারি শরিফ পড়েছেন হযরত মাওলানা সাইয়েদ হোসেন আহমদ মাদানি (র.) এর কাছে। মাওলানা সাইয়েদ হোসাইন আহমদ মাদানী (র.) তাঁর প্রথম মুর্শিদও ছিলেন। তিনি দারুল উলূম দেওবন্দে তাফসীর কাসে পড়াকালে মাওলানা মাদানির আধ্যাত্মিক শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। হযরত মাদানি (র.) এর ওফাতের পর খতিব সাহেব হাকীমুল উম্মত মাওলানা আশরাফ আলী থানবী (র.)এর খলীফা হযরত মাওলানা আতহার আলী (র.) এবং তাঁর মৃত্যুর পর হযরত থানবি (র.)এর অন্য খলিফা হযরত মাওলানা মুহাম্মদ উল্লাহ হাফেজ্জী হুজুর (র.) থেকে আধ্যাত্মিক ফয়েয হাসিল করেন বলে শোনা যায়। খতিব সাহেবের জীবনী লেখকদের অনেকে লিখেছেন হযরত হাফেজ্জী হুজুর(র.) তাঁকে বায়আত ও খিলাফতি প্রদান করেছেন। হযরত হাফেজ্জী হুজুর (র.) তাঁর পির বা মুর্শিদ ছিলেন কি না তা জানতে চাইলে হযরত খতিব সাহেব মরহুম আমাকে বলেন-আমার পির সাহেব নয়, আবার পির সাহেবও। উনাকে আমি ভক্তি করতাম, কারণ আমার আব্বা এবং হাফেজ্জী হুজুর ছিলেন হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানবী (র.) মুরিদ এবং খলিফা। উনাদের সম্পর্ক ছিলো সেই থানাবন থেকেই। এই হিসেবে উনাকে মুরুব্বী মানতাম। যেমন মাওলানা আতহার আলী সাহেবকে মুরুব্বী মানতাম, তেমনি হাফেজ্জী হুজুরকে।’ এই কথা খতিব সাহেব বেশ কয়েকবার আমাকে বলেছেন। তবে তিনি যে হযরত হাফেজ্জী হুজুরের খলিফা ছিলেন তাতে কোন সন্দেহ নেই। তিনি ইচ্ছেকৃত এই বিষয়টি সর্বদা এড়িয়ে যেতেন। কারণ কি তা তো আমরা স্পষ্ট বলতে পারবো না। তবে আমার ধারণা তিনি কাউকে মুরিদ করতে চাইতেন না বলে এই আত্মগোপনের পথ অবলম্বন করে ছিলেন। ইংল্যান্ডে একবার এই রকমের একটা ঘটনাও ঘটেছিলো। ফেনির মাওলানা নুরুল্লাহ সাহেব বার্মিংহামে থাকেন। তিনি তাঁর বাসায় খতিব সাহেবকে দাওয়াত করে নিয়ে নিজে মুরিদ হতে চাইলে খতিব সাহেব খুব রেগে গিয়ে বললেন-‘আমি পির হইলাম কবে?’ মাওলানা নুরুল্লাহ সাহেব বললেন-‘আপনারতো হযরত হাফেজ্জী হুজুর (র.) এর এজাজত আছে। আমি দীর্ঘ দিন ঢাকায় হযরত হাফেজ্জী হুজুরের কামরাঙিরচর মাদ্রাসায় শিক ছিলাম এবং সেখানে যেনেছি।’ খতিব সাহেব সেদিন মাওলানা নুরুল্লাহ সাহেবকে মুরিদ না করলেও তাঁর এই কথার কোন প্রতিবাদ করেননি। এই হিসেবে আমরা বলতে পারি খতিব সাহেব হাফেজ্জী হুজুরের খলিফা ছিলেন। হযরত হাফেজ্জী হুজুর (র.)এর ইন্তেকালের পর খতিব সাহেব হযরত থানবীর সর্বকনিষ্ঠ খলিফা ভারতের মাওলানা আববারুল হক সাহেবের সঙ্গে আধ্যাত্মিক সম্পর্ক স্থাপন করে ছিলেন।
বিদেশ সফর
খতিব মাওলানা উবায়দুল হক সরকারী ও বেসরকারী উদ্যোগে বিভিন্ন
ইসলামী অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণে সৌদী আরব, মিসর, ইরাক, ইরান, কুয়েত, মরক্কো, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, সিঙ্গাপুর, ভারত, পাকিস্তান, আমেরিকা, রাশিয়া, বৃটেন ও
দণি আফ্রিকা সফর করেন। খতিব সাহেব বেশ কয়েকবার ইংল্যান্ড
সফরে যান বিভিন্ন ইসলামী সংগঠনের দাওয়াতে। আমার জানা মতে তিনি প্রথম ইংল্যান্ড গিয়েছিলেন দাওয়াতে
ইসলামী ইউকের উদ্যোগে আয়োজিত খতমে নাবুওয়াত সম্মেলনে এবং সর্বশেষ গিয়েছিলেন লন্ডন
ইব্রাহিম কলেজের উদ্যোগে আয়োজিত এক শিা সম্মেলনে। মধ্যখানে আরো দু’একবার গিয়েছেন। প্রতিবারই সেখানে কিছু সময় আমি তাঁর খেদমতে থাকার চেষ্টা
করেছি। ইংল্যান্ড সফরে গেলেই তিনি আমাদের বসতি শহর বার্মিংহামে দু’একদিনের জন্য আসতেন এবং আমাদের ঘরে থাকতেন। অনেক আলেমকে আমরা ইংল্যান্ড সফরকালে দেখেছি পাগলের মতো
চাঁদা উঠানোর কাজে ব্যস্ত থাকেন, অনেকে হালালÑহারামের দিকে তেমন একটা নজরই রাখেন না, মদের রেষ্টুরেন্টসমূহে গিয়েও চাঁদা উঠাতে লজ্জাবোধ করেন না। শুধু আলেমদের কথা বলবো কেনো? বিভিন্ন
দলের নেতা,
সামাজিক নেতা, কিংবা সাধারণ
ভিজিটার ইংল্যান্ড গেলেই পাউন্ডের হিসাবে টাকা গুণে প্রবাসিদের পকেট খালির চেষ্টায়
প্রায়ই ব্যস্ত থাকেন। আর বর্তমানেতো বিভিন্ন প্রজেক্ট, ফাট-বাড়ি ইত্যাদির নামে আছে কতো রঙের খেলা, সরকারি বড় বড় আমলারা পর্যন্ত এই খেলায় পিছিয়ে নেই। কিন্তু আমরা খতিব মাওলানা উবায়দুল হককে এই রকমের খেলায়
কিংবা কাজে কোনদিন ব্যস্ত হতে দেখিনি। তিনি এসব
চাঁদাবাজি অপছন্দ করতেন। অথচ আমরা জানি তিনি বাংলাদেশের
অনেকগুলো মাদ্রাসার পরিচালক ছিলেন। খতিবের
পদটা জাতীয়ভাবে সম্মানিত হলেও পারিবারিক জীবনে তাঁর খুব একটা অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা
ছিলো না। তবু তিনি যে কয়বার ইংল্যান্ড গিয়েছেন, একবারও টাকা দিয়ে পাউন্ড হিসাব করতে দেখিনি।
বার্মিংহামের রেডিও মিনারের মাধ্যমে আমি খতিব সাহেবের মুখোমুখি ইংল্যান্ডে বাংলাদেশীদের একটা বিরাট অংশ রেস্টুরেন্ট ব্যবসার নামে মদের ব্যবসার সাথে জড়িত। বেশির ভাগ আলেমরা চাঁদার উদ্দেশ্যে বৃটেন সফর করেন বলে এই ব্যাপারে কথা বলতে অনাগ্রহি। তাই আমি একবার রেডিও মিনারের প থেকে আয়োজন করেছিলাম এক বিতর্ক সভার। দুঃখজনক হলেও সত্য কেন আলেম এতে অংশগ্রহণে আগ্রহী হয়ে উঠেননি। শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে টেলিফোনে খতিব মাওলানা উবায়দুল হকের মুখোমুখি হয়ে ছিলাম এই প্রশ্ন নিয়েÑমদের ব্যবসা কোন ভাবে হালাল করা যায় কি ? উত্তরে তিনি বলেনÑআমার আশ্চর্য লাগে একজন মুমিন মুসলমান মদ হারাম জানার পর ও প্রশ্ন করে মদের ব্যবসা হালাল করা যায় ক্ ি? পবিত্র কোরআনে মদকে ‘রিজস’ বলে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে, যার অর্থ নজিস বা পায়খানা। পায়খানা ব্যবসা হালাল করার চেষ্টা একটি ঘৃণিত কাজ। পায়খানার ব্যবসা যে কোন মতে জায়েয হতে পারে না তা একজন সাধারন মুসলমানও বুঝে। বোখারী শরিফের হাদিসে এ সম্পর্কে স্পষ্ট রয়েছে। হযরত আয়েশা (রা.) বলেনÑ‘যখন মদের আয়াত অবতীর্ণ হয় তখন নবি করিম (স.) মসজিদে গিয়ে মদের ব্যবসা হারাম সম্পর্কে ঘোষণা দিলেন।’ তাছাড়া অন্য একটি হাদিস হয়রত আব্দুলাহ ইবনে ওমর (র.) থেকে বর্ণিত যে, মহানবি (স.) বলেছেনÑ‘মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন লানত দিয়েছেন মদের উপর, মদপানকারীর উপর, মদ যে অন্যকে পান করায় তার উপর , মদ যে ক্রয় করে তার উপর, মদ অন্যের মাধ্যমে বের করায় তার উপর, যে মদ বহন করে বা পরিবেশন করে (সার্ভিস করে) তার উপর, মদের সাথে সম্পর্কিত এই নয় শ্রেণীর লোকের উপর আলাহ পাকের লা’নত অর্থাৎ অভিশাপের কথা মহানবি (স.) ঘোষনা করেছেন। বোখারী শরিফে হয়রত জাবের ইবনে আব্দুলাহ (রা.) থেকে আরোকটি হাদিস বর্নিত রয়েছে যে, তিনি নিজে মক্কা বিজয়ের দিন মহা নবী (সা.) এর কাছ থেকে শুনেছেন-‘ ইন্নাল্লাহা হার-রামা বাই’য়াল খামরি ওয়াল মাইতাতি ওয়াল খিনজিরী ওয়াল আছনাম।’ অর্থাৎ ‘নিশ্চয় আলাহ তা’য়ালা মদ, মৃত পশু-পী, শুকর এবং মূর্তি বিক্রি ব্যবসা হারাম করে দিয়েছেন।’ এভাবে আরো অসংখ্য হাদিস রয়েছে- এই হাদিসগুলো স্পষ্ট করে দিয়েছে মদপান যেমন হারাম তেমনি মদের ব্যবসাও হারাম। অন্য একটি হাদিসে এসেছে ‘ ইজতানিবুল খারমা ফা’ইন্নাহা মিফতাহু কুলে শাররিন’ অর্থা-মদ থেকে তোমরা বেঁচে থাক, কারণ সকল অনিষ্টের চাবি হলো মদ। আরোকটি হাদিসে রয়েছে ‘ আল খামরু উম্মুল ফাওয়াহিশ ওয়া আকবারু কাবাইর।’ অর্থাৎ -‘মদ হলো সকল নাপাকিসমূহের মূল এবং কবিরা গোনাহ সমূহের মধ্যে বড় গোনাহ।’ হয়রত আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, মহানবি (স.) বলেছেন-‘যে ব্যক্তি মদ পান করে, এই মদ পান করা অবস্থায় তার ঈমান থাকে না।’ এই সমস্ত হাদিস পড়ে এবং উলামায়ে কিরাম স্পষ্ট ভাষায় বিস্তারিত বর্ণনা সত্ত্বেও কোন মুসলমানের অন্তরে মদের ব্যবসা হালাল হওয়ার ধারনা থাকতে পারে না। মহানবী (স.) বলেছেন-‘শবে কদরে মুমিনদের সকল গোনাহই মাফ হয় কিন্তু চার ব্যক্তির প্রতি আল্লাহ তা’য়ালা রহমতের দৃষ্টি দেন না। এর মধ্যে
বার্মিংহামের রেডিও মিনারের মাধ্যমে আমি খতিব সাহেবের মুখোমুখি ইংল্যান্ডে বাংলাদেশীদের একটা বিরাট অংশ রেস্টুরেন্ট ব্যবসার নামে মদের ব্যবসার সাথে জড়িত। বেশির ভাগ আলেমরা চাঁদার উদ্দেশ্যে বৃটেন সফর করেন বলে এই ব্যাপারে কথা বলতে অনাগ্রহি। তাই আমি একবার রেডিও মিনারের প থেকে আয়োজন করেছিলাম এক বিতর্ক সভার। দুঃখজনক হলেও সত্য কেন আলেম এতে অংশগ্রহণে আগ্রহী হয়ে উঠেননি। শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে টেলিফোনে খতিব মাওলানা উবায়দুল হকের মুখোমুখি হয়ে ছিলাম এই প্রশ্ন নিয়েÑমদের ব্যবসা কোন ভাবে হালাল করা যায় কি ? উত্তরে তিনি বলেনÑআমার আশ্চর্য লাগে একজন মুমিন মুসলমান মদ হারাম জানার পর ও প্রশ্ন করে মদের ব্যবসা হালাল করা যায় ক্ ি? পবিত্র কোরআনে মদকে ‘রিজস’ বলে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে, যার অর্থ নজিস বা পায়খানা। পায়খানা ব্যবসা হালাল করার চেষ্টা একটি ঘৃণিত কাজ। পায়খানার ব্যবসা যে কোন মতে জায়েয হতে পারে না তা একজন সাধারন মুসলমানও বুঝে। বোখারী শরিফের হাদিসে এ সম্পর্কে স্পষ্ট রয়েছে। হযরত আয়েশা (রা.) বলেনÑ‘যখন মদের আয়াত অবতীর্ণ হয় তখন নবি করিম (স.) মসজিদে গিয়ে মদের ব্যবসা হারাম সম্পর্কে ঘোষণা দিলেন।’ তাছাড়া অন্য একটি হাদিস হয়রত আব্দুলাহ ইবনে ওমর (র.) থেকে বর্ণিত যে, মহানবি (স.) বলেছেনÑ‘মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন লানত দিয়েছেন মদের উপর, মদপানকারীর উপর, মদ যে অন্যকে পান করায় তার উপর , মদ যে ক্রয় করে তার উপর, মদ অন্যের মাধ্যমে বের করায় তার উপর, যে মদ বহন করে বা পরিবেশন করে (সার্ভিস করে) তার উপর, মদের সাথে সম্পর্কিত এই নয় শ্রেণীর লোকের উপর আলাহ পাকের লা’নত অর্থাৎ অভিশাপের কথা মহানবি (স.) ঘোষনা করেছেন। বোখারী শরিফে হয়রত জাবের ইবনে আব্দুলাহ (রা.) থেকে আরোকটি হাদিস বর্নিত রয়েছে যে, তিনি নিজে মক্কা বিজয়ের দিন মহা নবী (সা.) এর কাছ থেকে শুনেছেন-‘ ইন্নাল্লাহা হার-রামা বাই’য়াল খামরি ওয়াল মাইতাতি ওয়াল খিনজিরী ওয়াল আছনাম।’ অর্থাৎ ‘নিশ্চয় আলাহ তা’য়ালা মদ, মৃত পশু-পী, শুকর এবং মূর্তি বিক্রি ব্যবসা হারাম করে দিয়েছেন।’ এভাবে আরো অসংখ্য হাদিস রয়েছে- এই হাদিসগুলো স্পষ্ট করে দিয়েছে মদপান যেমন হারাম তেমনি মদের ব্যবসাও হারাম। অন্য একটি হাদিসে এসেছে ‘ ইজতানিবুল খারমা ফা’ইন্নাহা মিফতাহু কুলে শাররিন’ অর্থা-মদ থেকে তোমরা বেঁচে থাক, কারণ সকল অনিষ্টের চাবি হলো মদ। আরোকটি হাদিসে রয়েছে ‘ আল খামরু উম্মুল ফাওয়াহিশ ওয়া আকবারু কাবাইর।’ অর্থাৎ -‘মদ হলো সকল নাপাকিসমূহের মূল এবং কবিরা গোনাহ সমূহের মধ্যে বড় গোনাহ।’ হয়রত আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, মহানবি (স.) বলেছেন-‘যে ব্যক্তি মদ পান করে, এই মদ পান করা অবস্থায় তার ঈমান থাকে না।’ এই সমস্ত হাদিস পড়ে এবং উলামায়ে কিরাম স্পষ্ট ভাষায় বিস্তারিত বর্ণনা সত্ত্বেও কোন মুসলমানের অন্তরে মদের ব্যবসা হালাল হওয়ার ধারনা থাকতে পারে না। মহানবী (স.) বলেছেন-‘শবে কদরে মুমিনদের সকল গোনাহই মাফ হয় কিন্তু চার ব্যক্তির প্রতি আল্লাহ তা’য়ালা রহমতের দৃষ্টি দেন না। এর মধ্যে
১) ঐ ব্যক্তি যার সাথে শরাবের সম্পর্ক রয়েছে।
২) যে পিতা-মাতা কে কষ্ট দেয়।
৩) যে আত্মীয়দের হক্ক আদায় করে না।
৪) যে অন্য কোন মুসলমানের সাথে হিংসা-বিদ্বেষ রাখে।
এতে বুঝা যায় মদ সকল গোনাহ থেকে বড় গোনাহ এবং তা অত্যন্ত
কঠিন শাস্তিযোগ্য অপরাধ। আমার বিশ্বাস এ সব কথা শোনার পর কোন
মুসলমান মদের ব্যবসার সাথে সম্পর্ক রাখতে পারে না। যারা এখনো মদের ব্যবসার সাথে সম্পর্কিত আমি আশা করবো তারা
এই গোনাহের কাজ বর্জন করবেন। আল্লাহ
পাক অর্থোপার্জনের অনেক রাস্তা মানুষের সামনে উন্মুক্ত করে রেখেছেন। যারা চুরি-ডাকাতি করে তাদের ধরণা এ সকল ছেড়ে দিলে পরিবারের
ভরণ - পোষণ অসম্ভব হয়ে যাবে। এ ভাবে
মদের ব্যবসায়ীদেরও ধারনা থাকতে পারে, অথচ আল্লাহ তা’য়ালা যেমন চুর-ডাকাতকে এই পথ ছেড়ে দিলে অর্থোপার্জনের
অন্যপথ করে দেন,
তেমনি সাহস করে মদের ব্যবসা ছেড়ে দিলে আল্লাহ পাক রিজিকের
অন্যপথ উন্মুক্ত করে দিবেন। আমি মনে
করি এতটুকু আলোচনাই মদের ব্যবসা হারাম হওয়া সম্পর্কে যথেষ্ট। একটি হাদিস উল্লেখ করে আমি আমার বক্তব্য শেষ করছি। হয়রত আব্দুলাযহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্নিত ‘মান কানা ইরিদু বিল্লাহী ইয়াল ইয়াওমীল আখেরী ফালা ইয়াস
তাতীর খামরা ওয়ামান কানা ইউমিনু বিল্লাহী ওয়াল ইয়াওমীল আখের, ফালা ইয়াজর্লিসু আলা মা’দাতি ইসরাবু
আলাইহাল খামরু।’ অর্থৎ ‘যে
ব্যক্তি আল্লাহ এবং কিয়ামতের উপর ঈমান রাখে সে কখনো শরাব পান করতে পারে না। আবার এরশাদ করেন-যে ব্যক্তি আল্লাহ ও কিয়ামতের উপর বিশ্বাস রাখে সে কখনো মদের ঐ
দস্তরখানার সাথে সম্পর্ক স্থাপন করতে পারে না, যেখানে নিজে বা
অন্যরা বসে মদ পান করে থাকে।’ মহান আলাহ পাক
আমাদের সর্বপ্রকার পাপ থেকে রা করুন এবং আমাদের যারা এখনো মদের মতো খারাপ জিনিষের
ব্যবসার সাথে সম্পর্কিত তাদের কে হালাল পথে অর্থোপার্জনের তৌৗফিক দিন। ওয়াখেরু দাওয়ানা আলহাদু লিল্লাহী রাব্বিল আ’লামীন। ইংল্যান্ড
সম্পর্কে খতিব উবায়দুল হকের একটি গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্যখতিব মাওলানা উবায়দুল হক
ইংল্যান্ড সফরে গেলে প্রায়ই বলতেন, কোরআন এবং হাদিসের ভাষ্য হলোÑমহান আল্লাহ পাক গোটা বিশ্বে ইসলামী হুকুমত প্রতিষ্ঠিত না
হওয়া পর্যন্ত কিয়ামত করবেন না। উসমানিয়া
খিলাফতের সময় স্পেন পর্যন্ত ইসলাম এসে থেমে গিয়েছিলো। বিভিন্ন কারণে তখন ইসলাম ইংলিশ চ্যানেল অতিক্রম করতে পারেনি। মনে হচ্ছে এখন ইসলাম ইংলিশ চ্যানেল অতিক্রম করে ইংল্যান্ডে
চলে আসবে। কিন্তু এক্ষেত্রে প্রবাসী মুসলমানদের
ভূমিকা রাখতে হবে খুব সচেতনভাবে। এখানের
প্রতিটি মুসলমানকে স্মরণ রাখতে হবে, বৃটেনের
অমুসলিমরা কোরআন-হাদিস পড়ে ইসলাম বুঝতে আসবে না, ওদেরকে
ইসলাম বুঝাতে হবে মুসলমানরা তাদের চরিত্র এবং ব্যবহার দিয়ে। এখানের প্রতিটি মুসলমানকে জীবন্ত কোরআনের ভূমিকা পালন করতে
হবে। যদি মুসলমানরা এখানে সঠিক দায়িত্ব পালন করতে পারেন তবে খুব
দ্রুত এখানে ইসলামি শাসন প্রতিষ্ঠা লাভ করবে। আর যদি মুসলমানরা নিজেদের দায়িত্ব আদায়ে গাফেল হয়ে পড়েন তবে
স্মরণ রাখবেন এর শাস্তি হিসেবে আপনাদের প্রজন্মগুলো নষ্ট হয়ে যাবে এবং অন্য
জাতিগুলোকে আল্লাহ হেদায়াতের আলোতে এনে এই কাজ উদ্ধার করে নিবেন।
ভিন্নমতের প্রতিও খতিব ছিলেন সহনশীল
খতিব মাওলানা উবায়দুল হক নিজে একটা নির্দিষ্ট আদর্শের
বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি ছিলেন আকাবিরে দেওবন্দের
পূর্ণাঙ্গ অনুসারি। কিন্তু তিনি তাসবির দানা হাতে নিয়ে
নিজেকে দেওবন্দি-দেওবন্দি বলে জপ করার পে ছিলেন না। তিনি সব ইসলামি দলের সাথে সর্বদাই সু-সম্পর্ক বজায় রেখে
চলতেন। এখানে তাঁর কোন ভণ্ডামি ছিলো না, ছিলো না কোন স্বার্থিক কারণ। তাঁর সহজ বক্তব্য ছিলো-এখতেলাফতো আছে এবং থাকবে। কিন্তু আমরা একে অন্যের খেলাফ হবো কেনো। মানবিক ভালো আচরণ একের সাথে অন্যের থাকাতে আপত্তি কোথায়? আর কেউ যদি আমাকে ডাকে তাঁর মাহফিলে গিয়ে কথা বলার জন্য আর
সে নাস্তিক-মুরতাদ না হয়, তবে আমার যেতে আপত্তি কোথায়? আমিতো গিয়ে আমার কথা বলবো। মুসলমান হিসাবে আমরা প্রতিটি ইসলামী দলের সাথে একটি ইসলামী
সম্পর্ক রাখতে পারি।
খতিবের বিরুদ্ধে কয়েকটি অপ-প্রচারের উত্তর
১) ২০০১ খ্রিস্টাব্দের শেষদিকে জাতীয় ঈদগাহে খতিব সাহেবের
দেওয়া ঈদের খুতবাকে কেন্দ্র করে সুযোগসন্ধানি মহল আমেরিকাকে বুঝাতে চেষ্টা করে-খতিব
আমেরিকার বিরুদ্ধে বক্তব্য দিয়েছেন। ‘গরিবের বৌ সকলের
ভাবি’ বাংলাদেশ সরকারের জন্য বিষয়টি একটি চিন্তার কারণ হয়ে গেলো। দেশের শত্র“রা এ কথাকে বেশি প্রচার শুরু করে। এ সবের জবাবে খতিব তখন বলেছিলেন-‘ঈদের প্রধান জামায়াতে দেয়া আমার খুতবা নিয়ে একটি
সুযোগসন্ধানী মহল এক তীরে দুই পাখি শিকারের মতলব এঁটেছে। তারা বিভিন্ন পয়েন্ট বের করে হিংসা বিদ্বেষ চরিতার্থ করতে
চায়। এই সুযোগসন্ধানিরা বিদেশে গিয়ে দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র
করছে। আমিতো দেশের বিরুদ্ধে কিছু বলিনি, যা বলেছি ইসলামী আকিদা থেকে বলেছি। খুতবায় সরকারের সমালোচনা ছিলো না। রাশেদ খান মেনন অতীতেও আমার বিরুদ্ধে বয়ান রেখেছে। তার বামপন্থী দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আমরা কখনো খুতবা পাঠ করিনি। সরকারের ওপর মহলের সাথে খতিব-ইমামদের কোন সংঘাত নেই। সরকার পক্ষ কথা বলবেন তাদের আন্তর্জাতিক পলিসি অনুযায়ী আর
খতিব-ইমামগণ কথা বলবেন আন্তর্জাতিক ইসলামী ভ্রাতৃত্ববোধ প্রাধান্য দিয়ে। খুতবার ওপর মতার ছড়ি ঘুরানো চলবে না। রাষ্ট্রীয় কূটনৈতিক পলিসি যাই হোক, যতদিন মুসলিম বিশ্বে অত্যাচার-অবিচার চালানো হবে আমি তার
বিরুদ্ধে বলবোই। তার সাথে সরকারি নীতির সম্পর্ক নেই। নতুবা সরকার ঠিক করে দিক খতিব-ইমামগণ কি এক হাজার বছর আগের
ইবনে বতুতার আমলের গৎবাধা খুতবা পাঠ করবেন না কি বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে দিক
নির্দেশনামূলক খুতবা পাঠ করবেন। এ নিয়ে
প্রায়শই দেশের বুদ্ধিজীবী ও শিতি মহল বিতর্ক তোলেন। তারা বলেন, খুতবা গৎবাধা হবে কেন, বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে পাঠ করা হোক। আবার দিক নির্দেশনা মূলক বক্তব্য দিলে তাদের গা জ্বলে ওঠে।’
২) বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদ হলেও এই কথা সর্বজন স্বীকৃত
যে, মাওলানা উবায়দুল হকের মতো মেধাসম্পন্ন সাহসী ব্যক্তিত্ব এই
মসজিদের খতিব হওয়ার পর এই পদ জাতীয় বিভিন্ন বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। দেশের যে কোন সংকটময় মূহুর্তে খতিবের ভূমিকা দেশ, জাতি এবং ধর্মদ্রোহী শ্রেণী সহ্য করতে না পেরে শুরু করে
তাঁকে এই পদ থেকে সরিয়ে দেয়ার গভীর ষড়যন্ত্র। পাশাপাশি তারা খতিবের বিরুদ্ধে চালায় বিভিন্ন মিথ্যা
অপপ্রচার। এরই মধ্যে আওয়ামীলীগ নির্বাচনে বিজয়ী
হয়ে সরকার গঠনের পর সরকারি ছত্রছায়ায় ষড়যন্ত্রকারিরা তাদের ষড়যন্ত্রের মাত্রা আরো
বৃদ্ধি করে দেয়। আওয়ামীলীগ সরকারের শেষ দিকে তারা
তাওহিদী জনতার বিবেকী কণ্ঠ, ইসলামী তাহজিব-তামাদ্দুন রার সংগ্রামী
সিপাহসালার খতিব মাওলানা উবায়দুল হককে বায়তুল মোকাররমের খতিব পদ থেকে সরানোর মরণ
কামড় দিলো । বিভিন্ন বাম পত্রিকা এই সময় উলঙ্গ হয়ে
নেমে যায় খতিবের বিরুদ্ধে। মস্কোপন্থী কমিউনিস্টদের পত্রিকা
দৈনিক সংবাদ লিখেÑ‘খতিব প্রকৃতপে একজন জামাতি। জামাত প্রভাবিত ‘ইসলামি ব্যাংক
বাংলাদেশ’-এর শরিয়াহ বোডের চেয়ারম্যান হিসাবে তিনি ২০ হাজার টাকা মাসে
সম্মানি নিয়ে থাকেন। খতিব তিন বিয়ে করেছেন। কিশোরগঞ্জের স্ত্রীর সাথে তাঁর ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে। খতিবের ছেলেরা কেউ আরবি শিতি নয়। ইত্যাদি।’ দৈনিক সংবাদে
প্রকাশিত এই সব ভিত্তিহীন সংবাদের ভিত্তিতে অবশেষে দৈনিক আজকের কাগজের প থেকে
তৎকালিন সাংবাদিক সেলিম জাহিদ মুখোমুখি হয়েছিলেন খতিব সাহেবের। খতিব সাহেবের সেদিন তাঁর বিরুদ্ধে প্রচারিত অভিযোগের উত্তরে
যা বলেছিলেন তা ২০০১ খ্রিস্টাব্দের ৬ মে দৈনিক আজকের কাগজে প্রকাশিত হয়েছিলো। আমরা এখানে দৈনিক আজকের কাগজের দীর্ঘ বক্তব্য থেকে সংেেপ
শুধু সারমর্ম নেবো। খতিব সাহেব সেদিন খুব দৃঢ়তার সাথে সকল
অপপ্রচারের জবাব দিয়ে বলে ছিলেনÑ‘তারা বলেছে ইসলামী ব্যাংকের শরিয়াহ
কাউন্সিলে আমি বিশ হাজার টাকা বেতন নেই। এটা মিথ্যা, ভিত্তিহীন। আমি ইসলামী ব্যাংকের বেতনভূক্ত কোন সদস্য বা কর্মচারি নই। ব্যাংকের অনারারি কাউন্সিলার হিসাবে অধিবেশনে যাতায়াত বাবত
এক হাজার বিশ টাকা ভাতা পাই।’ এখন আমরা যদি
ব্যাংকের দিক থেকে চিন্তা করি, ইসলামী ব্যাংক খতিবকে দেখিয়ে কত টাকা
ব্যবসা করলো আর তাঁকে কত টাকা সম্মানি দিলো, তবে নিশ্চয় এক
হাজার বিশ টাকা খুবই হাস্যকর। আর যদি
খতিবের দিক থেকে চিন্তা করি তবে তিনি হয়তো মানুষকে সূদমুক্ত ব্যাংকিং-এর দিকে
উৎসাহিত করতে দ্বীনি দায়িত্ব আদায় করেছেন। আর যারা অপপ্রচার করলো তারা হয়তো শত্র“তা বশত কিংবা অজ্ঞতা বশত অন্ধ ছিলো। সন্তানদের সাধারণ শিক্ষার ব্যাপারে তিনি বলেছিলেন-‘কাল্পনিক প্রশ্ন। আমার এক ছেলেও ইসলামী শিক্ষার বাইরে পড়ালেখা করেনি।’ খতিব সাহেবের পরিবারকে আমরা যারা জানি সবাই এক বাক্যে বলতে
পারি সত্যই তাঁর এক ছেলেও ইসলামি শিক্ষার বাইরে লেখাপড়া করেনি-তাঁর বড় ছেলে
মাওলানা সাউদুল হক, দ্বিতীয় ছেলে মাওলানা আতাউল হক, তৃতীয় ছেলে মাওলানা শহিদুল হক, চতুর্থ ছেলে হাফেজ একরামুল হক মাদ্রাসারই ছাত্র। এমন কি তাঁর ভাই-ভাতিজা এবং ভাগিনারাও ইসলামি শিক্ষায়
শিক্ষিত। আমরা ইতোমধ্যে তাঁর পিতা মাওলানা
জহরুল হকের আলোচনায় আমরা দেখেছি তাঁর গ্রামে অধিকাংশ মানুষ মাদ্রাসা শিক্ষায়
শিক্ষিত। তৃতীয় বিয়ের ব্যাপারে তাঁর পাল্টা
প্রশ্ন ছিলো-‘তৃতীয় স্ত্রী পাইলেন কৈ যে ছাড়াছাড়ি হইবো? কিশোরগঞ্জের স্ত্রী আপনাকে চা বানাইয়া দিলো, নুডুল্স বানাইয়া খাওয়াইলো, এরপর কি
কইবেন ছাড়াছাড়ি হইয়া গেছে?’ খতিব সাহেবের পরিবারের সাথে যারা
সরাসরি জড়িত,
তারা সাক্ষি দিয়ে বলতে পারি-তিনি দুটি বিয়ে করেছেন। তাঁর কোন স্ত্রী ছাড়াছাড়ির প্রশ্নই উঠতে পারে না। এমনকি তিনি যে দুই স্ত্রীকে নিয়ে জীবন কাটিয়েছেন ওদের
দুজনের ভেতর আছে সুমধুর সম্পর্ক। এমন কি এই
পর্যন্ত কেউ বলতে পারবেন না, খতিব সাহেবের দু’পরে সন্তানদের মধ্যে কোন মতানৈক্য হয়েছে। কমপে আমরা শুনি নাই। খতিব সাহেবের বিরুদ্ধে আরেকটি অভিযোগ ছিলো, তিনি সরকারি চাকুরি করে জুমার নামাজে সরকার বিরোধী বক্তব্য
রাখতেন। তিনি এই অভিযোগের উত্তরে বলেছিলেন-‘কোনদিন সরকার বিরোধী বক্তব্য রাখিনি। তবে শরিয়তের মাসআলা নিয়ে কথা বলেছি। তা কারো বিরুদ্ধে চলে গেলে আমার করার কি আছে? যেমন শেখ মুজিবুর রহমানের ছবির প্রতি সম্মান প্রদর্শনের
বিষয়ে শরিয়তের মাসআলা অনুযায়ি কথা বলেছি।’ হাসিনা-খালিদার
মধ্যে কে নেতৃত্বে যোগ্য জানতে চাইলে তিনি বলেন-‘নাউযুবিল্লাহ, আমি রাজনীতি করি না।’
৩) আওয়ামীলীগ সরকার মতায় আসার পর ১৯৯৭/৯৮ খ্রিস্টাব্দে
মাওলানা উবায়দুল হককে খতিবের পদ থেকে সরানোর উদ্যোগ নিয়েছিলো। কিন্তু সারাদেশের মুসল্লি এবং আলেম সমাজের তীব্র প্রতিবাদ-আন্দোলনের
কারণে শেষ পর্যন্ত সরকার তার সিদ্ধান্ত পরিবর্তনে বাধ্য হয়। সেই সময় ইসলামিক ফাউণ্ডেশন আয়োজিত বায়তুল মোকাররম চত্বরে
মাহে রবিউল আউয়ালের উদ্ভোধনী অনুষ্ঠানে তৎকালিন ফাউন্ডেশনের আওয়ামী সমর্থক পরিচালক
মাওলানা আব্দুল আউয়াল কর্তৃক খতিব সাহেবকে দাওয়াত না দিলে মুসল্লিরা ক্ষুব্ধ হয়ে
উঠেন। এই ক্ষুব্ধতার ফলে ঘটে কিছু অপ্রীতিকর ঘটনা। তৎকালিন ইসলামিক ফাউন্ডেশন কর্তৃপ ইচ্ছেকৃত এই ঘটনার জন্য
খতিব সাহেবের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনে। তবে
তদন্তের পর কোন সংস্থাই তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ করতে পারেনি।
৪) ইসলামিক ফাউন্ডেশন ষড়যন্ত্র মামলায় পরাজিত হয়ে আওয়ামীলীগ সরকার খতিব সাহেবের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন
ব্যুরোর মাধ্যমে মামলা করে। এই
মামলায়ও সরকার পরাজিত হয়। তদন্তের পর একটি টাকারও দুর্নীতির
অভিযোগ প্রমাণ করতে পারেনি।
৫) আওয়ামীলীগ সরকার যখন মামলা-অভিযোগের ষড়যন্ত্রে বার বার
ব্যর্থ হলো খতিব সাহেবকে বায়তুল মোকররমের খতিবের পদ থেকে সরাতে তখন হাস্যকর ৭৩ বয়েসের
অভিযোগে তাঁকে ২০০১ খ্রিস্টাব্দের ২২ এপ্রিল খতিব পদ থেকে অব্যাহতি দেয়ার চিঠি দেয়। শেষ পর্যন্ত বিচারপতি এম এ আজিজ ও বিচারপতি শামসুল হুদার
সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের ডিভিশন ব্রাঞ্চ সরকারের এই সিদ্ধান্তকে অবৈধ ঘোষণা করে।
৬) অনেকে অপপ্রচার করতেন যে খতিব মাওলানা উবায়দুল হক জামাতে
ইসলামির লোক। এই বিশ্বাস কারো কারো আরো দৃঢ় হয় যখন
তিনি দাওয়াতুল ইসলাম ইউকের খতমে নাবুওয়াত সম্মেলনে ইংল্যান্ড যান। এ বিষয়ে আমাকে অনেকে ব্যক্তিগতভাবে প্রশ্নও করেছেন। আমি খতিব সাহেবের দেওয়া উত্তরকেই সাবার কাছে উপস্থাপনের
চেষ্টা করেছি। উল্লেখ্য যে, দাওয়াতুল ইসলাম ইউকে এক সময় জামাতে ইসলামী বাংলাদেশের
বৃটেনিয় সংস্করণ ছিলো। পরে ইষ্ট লণ্ডন মসজিদের কর্তৃত্বকে
কেন্দ্র করে এই সংগঠনের ভেতর সংঘাত শুরু হয়ে যায়। এই সংঘাতের এক পর্যায়ে অধ্যাপক গোলাম আযম, মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী, মাওলানা
দেলওয়ার হোসেন সাঈদি প্রমূখ শীর্ষস্থানীয় জামাত নেতারা ইষ্ট লন্ডন মসজিদের
ননসিলেটী নেতাদের প নিলে সিলেটের মাওলানা আবু সাঈদ, আব্দুস
সালাম, হাফেজ মাওলানা লুৎফুর রহমান, মাওলানা
শরিফ মুহাম্মদ আব্দুল কাদের প্রমূখরা বাংলাদেশ জামাতে ইসলামীর সাথে বিদ্রোহ করেন। দাওয়াতুল ইসলাম এবং ইষ্ট লন্ডন মসজিদ নিয়ে এরপর দীর্ঘদিন
মামলা চলে বৃটেনের আদালতে দুই গ্রুপের মধ্যে। শেষ পর্যন্ত মাওলানা আবু সাঈদ এবং আব্দুস সালাম গ্র“প মামলায় জিতে ‘দাওয়াতুল ইসলাম’ পেয়ে গেলেও ইষ্ট লন্ডন মসজিদ হারিয়ে ফেলেন। এই থেকে শুরু হয় দাওয়াতুল ইসলামের সাথে কেন্দ্রীয় জামাতে
ইসলামির সংঘাত। সেখানে জামাতে ইসলামির নতুন সংগঠন
হিসেবে আত্মপ্রকাশ ঘটে ইসলামিক ফোরাম ইউকে’র। কেন্দ্রের অসহযোগিতার ফলে দাওয়াতুল ইসলামের সাংগঠনিক অবস্থা
দূর্বল হয়ে পড়লে তারা বাংলাদেশ থেকে অধ্যাপক ফরিদ আহমদ রেজাকে অফিস সেক্রেটারীর
চাকুরি দিয়ে ইংল্যান্ড নিয়ে যান। উল্লেখ্য
যে, অধ্যাপক ফরিদ আহমদ রেজা এক সময় ইসলামী ছাত্র শিবিরের
কেন্দ্রীয় সেক্রেটারী জেনারেল ছিলেন। এই সময়
আহমদ আব্দুল কাদের (যিনি তৎকালিন সময় আব্দুল কাদের বাচ্চু নামে পরিচিত ছিলেন) ছিলেন
কেন্দ্রীয় সভাপতি। এক পর্যায়ে এসে অধ্যাপক গোলাম আযম ও
মাওলানা মতিউর রহমান নিজামি প্রমূখ জামাত নেতাদের সাথে শিবির নেতাদের মতানৈক্য হলে
শিবির জামাত থেকে বেরিয়ে আসার ঘোষণা করে এবং পুরাতন সাথীদেরকে নিয়ে গঠন করে ইসলামি
যুব শিবির। এই ইসলামি যুব শিবির এবং ইসলামী ছাত্র
শিবির প্রথমে হযরত হাফেজ্জী হুজুর (র.) এর সাথে খেলাফত সংগ্রাম পরিষদে যোগ দেয়। এক সময় হাফেজ্জী হুজুরের সাথে শায়খুল হাদিসের মতানৈক্য হয়
এবং শায়খুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হকের খেলাফত আন্দোলনের সাথে ইসলামী যুব শিবির
মিলে হয়ে যায় বাংলাদেশ খেলাফত মজলিশ। এই খেলাফত
মজলিশের প্রতিষ্ঠাকালিন কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য অধ্যাপক ফরিদ আহমদ রেজা এক সময়
দাওয়াতুল ইসলামের অফিসে চাকুরি নিয়ে ইংল্যান্ড চলে গেলেন। সাংগঠনিক ধারাবাহিকতায় তিনি পরবর্তিতে দাওয়াতুল ইসলামের
কেন্দ্রীয় আমীর নির্বাচিত হন। অধ্যাপক
ফরিদ আহমদ রেজা দাওয়াতুল ইসলামের কেন্দ্রীয় আমীর নির্বাচিত হয়ে তিনি গোটা
ইংল্যান্ডে দাওয়াতুল ইসলামের উদ্যোগে খতমে নাবুওয়াত সম্মেলনের আয়োজন করেন। এই সম্মেলনে আন্তর্জাতিক তাহাফফুজে খতমে নাবুওয়াত
বাংলাদেশের সভাপতি হিসাবে খতিব মাওলানা উবায়দুল হককে দাওয়াত করা হলে তিনি তাঁর
বক্তব্য নিয়ে এই সম্মেলন গুলোতে অংশগ্রহণ করেন। তখন বৃটেনে কোন কোন লোক খতিব সাহেবের বিরুদ্ধে অপপ্রচার
শুরু করেন জামাতে চলে গেছেন বলে। কেউ কেউ
বিষয়টি নিয়ে খতিব সাহেবের সাথে বসার আগ্রহী হয়ে উঠলে তিনি তাদেরকে সময় দিলেন। সেদিনের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তরে খতিব সাহেব স্পষ্ট
বলেছিলেনÑ‘হযরত রাসুল (স.)তো আবু জেহেলের বাড়িতেও যেতেন, আর ওরাতো কমপে মুসলমান। আমিতো মন্দির, গির্জা যেখান
থেকে দাওয়াত পাই সেখানে যাই আমার কথা বলার জন্য। আপনারা কি শায়খুল ইসলাম মাওলানা সাইয়েদ হোসেন আহমদ মাদানি(র.)
থেকে বেশি দেওবন্দি হয়ে গেলেন। আমি
দেওবন্দে, বাঁশকান্দিতে হযরতের সংস্পর্শে দীর্ঘদিন ছিলাম। তিনি মাওলানা মওদুদী সাহেব কিংবা জামাতে ইসলামির বিরোধীতা
করেছেন, কিন্তু তিনি এটাকে মিশন বানিয়ে নেননি। মতানৈক্য থাকতে পারে, কিন্তু শত্র“তা নয়। বিশ্বব্যাপি
মুসলিম উম্মাহ এখন বিশাল বিপদের মুখোমুখি, এই প্রোপটে
আমাদের ঐক্য হতে পারে কিছু মৌলিক বিষয়ের উপর। জামাতে ইসলামির সাথে আমাদের ইখতিলাফ আছে, কিন্তু তাদের কাছে যাওয়া যাবে না, বসা যাবে না, কথা বলা যাবে না, এমনতো নয়। শুধু
জামাতে ইসলামী নয়, অন্যান্য ইসলামী গ্রুপগুলোর সাথেও
আমাদের সু-সম্পর্ক গড়তে হবে ইখতেলাফের বিষয় ইখতেলাফে রেখে। এটা আমাদের আকাবির উলামাদের উসূল। আরে ভাই, মদিনার মসনদেতো ইহুদিদের সাথেও
রাজনৈতিক, সামাজিক চুক্তির নিদর্শন রয়েছে।’ খতিব সাহেবের এইসব উদার বক্তব্যকে কেন্দ্র করে অনেকে তাঁকে
জামাতের সাথে একাকার করে ফেলেন। আসলে তিনি
কোন রাজনীতিই করতেন না। মৃত্যুর কয়েকদিন আগে আমি এবং সাংবাদিক
সেলিম আউয়াল তাঁর সাাৎকার গ্রহণে গেলে সেলিম ভাই যখন জানতে চাইলেনÑমতিউর রহমান নিজামীর দলের সাথে আপনার কোন সম্পর্ক আছে কি না? তখন খতিব সাহেব স্পষ্ট করে বলে দেনÑনাই। তবে এই
সাাৎকারের অন্য একটি প্রশ্নে সেলিম ভাই যখন জানতে চাইলেনÑজামাতে ইসলামির বর্তমান আমীর মাওলানা নিজামী কি আপনার ছাত্র
ছিলেন? তখন খতিব সাহেব স্পষ্ট ভাষায় নিজামী সাহেবের কিছু প্রশংসা
করে ‘হাঁ’ বলেন। মোট কথা খতিব মাওলানা উবায়দুল হক সাদাকে সাদা এবং কালোকে
কালো বলতে কারো চোখ কিংবা মনের দিকে চেয়ে কথা বলতেন না। তবে উম্মতের প্রতি তাঁর ভেতরে প্রচুর দরদ ছিলো বলে তিনি
চাইতেন আজকের এই সংকটময় মূহূর্তে গোটা মুসলিম উম্মাহ এক প্লাটফরমে এসে দাঁড়িয়ে যাক।
প্রকাশিত গ্রন্থসমূহখতিব মাওলানা উবায়দুল হক (র.) প্রকাশিত বেশ কিছু গ্রন্থ রয়েছে। তন্মধ্যে উলেখযোগ্য-
প্রকাশিত গ্রন্থসমূহখতিব মাওলানা উবায়দুল হক (র.) প্রকাশিত বেশ কিছু গ্রন্থ রয়েছে। তন্মধ্যে উলেখযোগ্য-
১) তরিখে ইসলাম, দুই খণ্ড, এই গ্রন্থে একজন পাঠক পাবেন জাহিলিয়াত ও ইসলামের শুরু থেকে
বাংলাদেশ পর্যন্ত ইতিহাসের অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। মূলগ্রন্থ উর্দু।
২) সিরাতে মোস্তফা, মূলগ্রন্থ উর্দু, এটা নবী হযরত মুহাম্মদ (স.)এর জীবন ও চরিত্র নিয়ে রচিত।
৩) তাসহীলুল কাফিয়া। কাফিয়ার উর্দু শরাহ। এটা মূলত মাদ্রাসার শিক্ষক-ছাত্রদের জন্য পাঠ-উপযোগি করে
লেখা।
৪) আযহারুর আযহার। নূরুল আনওয়ারের দ্বিতীয় অংশের উর্দু শরাহ। এটাও মূলত মাদ্রাসার ছাত্র-শিকদের পাঠ্য বই।
৫) নসরুল ফাওয়ায়িদ (শরাহ ও নোট শরহে আক্বায়িদ, উর্দু)।
৬) আস সেক্বায়া। শরহে
ওয়াক্বেয়া দ্বিতীয় খণ্ডের উর্দু অনুবাদ।
৭) শিয়া সুন্নী এখতেলাফ, মূলগ্রন্থ উর্দু, শিয়া সুন্নি বিরোধ নামে তা বাংলায় অনুবাদ হয়েছে।
৮) শরহে শিকওয়া ও জওয়াবে শিকওয়া।
৯) কুরআন বুঝিবার পথ (বাংলা)।
১০) কুরআনে হাকীম আওর হামারী যিন্দেগী। রেডিও পাকিস্তানে পঠিত উর্দু কথিকা সমগ্র। এটা বাংলা অনুবাদ হয়েছে।
খতিব সাহেবের আরবি ভাষায় পাণ্ডিত্য খতিব সাহেব পৃথিবীর অন্য যে কোন ভাষা থেকে আরবি ভাষায় ছিলেন দ। সাহিত্যের দিকে তিনি নিজের মাতৃভাষা বাংলা থেকেও আরবিতে ছিলেন বেশি পারদর্শি। যার বাস্তব প্রমাণÑতিনি ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দের আগষ্ট ও ১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দের মে মাসে দু’বার আরবি বক্তৃতা প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে প্রতিবারই প্রথম স্থান লাভের গৌরব অর্জন করে ছিলেন। এ প্রতিযোগিতা মাদরাসা-ই আলিয়া ঢাকার প্রিন্সিপাল শায়খ শরফুদ্দীন(র.)এর পৃষ্ঠপোষকতায় পাকিস্তান জমিয়তে লিসানুল কুরআন-এর তত্ত্বাবধানে অনুষ্ঠিত হয়েছিলো।
খতমে নবুওয়ত আন্দোলনের নেতৃত্বে খতিব সাহেব ‘হযরত মুহাম্মদ (স.) সর্বশেষ নবী এবং রাসুল’ এই কথা হলো খতমে নবুওয়াতের দাবি। ঈমান এবং আকায়েদের দিকে ‘খতমে নাবুওয়াত’ এর প্রতি বিশ্বাস রাখা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কেউ যদি এই বিশ্বাস না রাখে তবে সে মুসলমান থাকবে না। ভারতের কাদিয়ান শহরের মির্জা গোলাম আহমদ বৃটিশ শাসন যুগে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় নিজকে নবী দাবি করে বসে(নাউযুবিল্লাহ)। সে তার এই দাবির পে বিভিন্ন কৌশলি প্রচার চালিয়ে এবং ইসলামের শত্র“দের সহযোগিতায় কিছু মানুষকে বিভ্রান্ত করতে থাকে। বাংলাদেশেও ইসলাম সম্পর্কে মূর্খ কিছু লোককে বিভিন্নভাবে তার পে তৈরি করে ফেলে। এই বিভ্রান্তি থেকে মানুষকে বাঁচানোর জন্য বিশ্বব্যাপি খতমে নাবুওয়াত আন্দোলনের প্রয়োজন দেখা দেয়। বাংলাদেশও এই প্রয়োজন থেকে খালি নয়। উলামায়ে কেরাম শুরু করেন বাংলাদেশে খতমে নাবুওয়াত আন্দোলন। এই আন্দোলন এক পর্যায়ে সাংগঠনিক রূপ নেয় ‘ আন্তর্জাতিক মজলিশে তাহাফফুজে খতমে নবুওয়াত বাংলাদেশ’ নামে। খতিব সাহেব এই সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি না হলেও তাঁর নেতৃত্বে তা প্রাঞ্জল হয়ে দেশ-বিদেশের বাংগালী মুসলমানদের ভেতর জাগরণ সৃষ্টি করেছে। তাঁর নেতৃত্বে কাদিয়ানী স¤প্রদায়ের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী আন্দোলনের ফলে ২০০৪ খ্রিস্টাব্দে সরকার কাদিয়ানী স¤প্রদায়ের সকল প্রকাশনা মুদ্রণ ও বিতরণ নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে বাধ্য হয়। মাওলানা উবায়দুল হকের ডাকে এবং তাঁর সভাপতিত্বে ঢাকায় প্রতি বছর মজলিসে তাহাফফুজে খতমে নাবুওয়তের বিশাল আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হতো। তিনি সভাপতি থাকাকালিন সময়ে এই আন্দোলন কোন রাজনীতিক দলের সাথে সম্পৃক্ত হয়নি। ফলে দেখা গেছে খতমে নবুওয়াত আন্দোলনে দল-মত নির্বিশেষে এদেশের সকল শ্রেণীর তাওহিদী জনতা অংশ গ্রহণ করতেন।খতিব সাহেবের রাজনৈতিক জীবন নেজামে ইসলাম পার্টির নেতা মাওলানা আতহার আলী (র.) খতিব মাওলানা উবায়দুল হককে মুফতি শফি (র.)এর দারুল উলূম করাচি থেকে ঢাকায় নিয়ে এসেছিলেন মূলত নেজামে ইসলাম পার্টির প্রচার ও প্রকাশনা বিভাগের দায়িত্ব সোপর্দ করতে। সোপর্দ করেছিলেনও। তবে তিনির দায়িত্ব লাভের অল্পদিন পর কেন্দ্রীয় সরকার পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক সরকার ভেঙ্গে সকল রাজনৈতিক দল বেআইনী ঘোষণা দিয়ে যাবতীয় কার্যকলাপ বন্ধ করে দেয়। যার ফলে নেজাম ইসলাম পার্টির সকল তৎপরতা বন্ধ হয়ে যায়। এরপর তিনি ঢাকা আলিয়া মাদ্রাসায় শিকতা শুরু করলে আর কোনদিন সক্রিয় দলীয় রাজনীতিতে আসেননি। তিনি রাজনীতিতে সক্রিয় না হলেও বিভিন্ন সময় জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের কর্যকরি কমিটি তাঁকে সদস্য রেখেছে। খতিব মাওলানা উবায়দুল হকের রাজনৈতিক জীবন বলা যেতে পারে ছোটবেলা থেকেই। কিন্তু সক্রিয় রাজনীতিতে তিনি খুবই অল্পদিন ছিলেন। ৪৭ পূর্ব ভারতের রাজনীতিতে তিনি জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের সাথে ছিলেন। জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের সাথে নয়। তৎকালিন সময় জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম আর জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের মধ্যে ব্যবধান ছিলো। শায়খুল ইসলাম হযরত মাওলানা সাইয়েদ হোসেন আহমদ মাদানি (র.)এর নেতৃত্বাধীন জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ ছিলো যুক্ত ভারতের পে আর শায়খুল ইসলাম মাওলানা শিব্বির আহমদ উসমানি (র.) ছিলেন মুসলমানদের জন্য পৃথক স্বাধীন ভূমি পাকিস্তান তৈরির পক্ষে পাকিস্তান হওয়ার পরও বিশেষ করে সিলেট অঞ্চলে জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের বিশাল প্রভাব রয়ে গিয়েছিলো। হযরত মাদানি (র.)এর খলিফা হাফেজ মাওলানা আব্দুল করিম শায়খে কৌড়িয়া (র.) ছিলেন জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের নেতা, আর জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের নেতৃত্বে ছিলেন হাকিমুল উম্মাত হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানবি (র.)এর খলিফাদ্বয় হযরত মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরি ও হযরত মাওলানা আতহার আলী (র.) প্রমূখ। কেন্দ্রীয়ভাবে স্বয়ং হাকিমুল উম্মাত মাওলানা আশরাফ আলী থানবি (র.)ও ছিলেন জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের পক্ষে। আমরা জানি যে, খতিব সাহেবের বাবা ছিলেন হযরত থানবি (র.)এর খলিফা। তাই এটাই বাস্তবতা যে, খতিব সাহেব চিন্তাগতদিকে জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের পক্ষে থাকবেন, কারণ তখনও পিতা থেকে রাজনৈতিক ভিন্নমত করার মতো তাঁর বয়স হয়নি। আর অন্যদিকে ছোটবেলা খতিব সাহেব ঘুংগাদিতে হযরত মাওলানা আতহার আলী সাহেবের মাদ্রাসার ছাত্র ছিলেন। এই সব বিভিন্ন কারণে খতিব সাহেব ছোটবেলা থেকেই জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের পে কাজ করেছেন, জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের পে যাননি। এক সময় জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বিভিন্ন ইসলামী দলের সাথে মিলে খতিবে আজম মাওলানা সিদ্দিক আহমদ (র.)এর নেতৃত্বে নেজামে ইসলাম হয়ে যায়। হযরত খতিব সাহেব (র.) নিজে আমাদেরকে বলেছেন- ‘তবে তখনও নেজামে ইসলাম পার্টির নামকরণ হয় নাই, তখন নাম ছিলো জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম। তখন আমি বাচ্চা মানুষ ছিলাম, তবে তাদের সাথে সহযোগী ছিলাম। মাওলানা আতহার আলী সাহেব ছিলেন জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের সভাপতি।’ এরপর আমরা যখন জানতে চাইলাম-জমিয়তের প্রচার সম্পাদকের দায়িত্বে কোন সময় ছিলেন? তখন তিনি বলেন-‘যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনের সময়, অর্থৎ ৫১ থেকে ৫৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। আবার যখন জানতে চাইলাম-তা হলে আপনি যুক্তফ্রন্টের পক্ষে নির্বাচনী প্রচারে অংশ নিয়ে ছিলেন? তখন খতিব সাহেব বলেন- ‘না, আমি অংশ নিতে পারি নাই, তখন আমি করাচিতে ছিলাম। তবে ঐখান থেকে তাদের পে বয়ান পত্র-পত্রিকায় প্রচার করে কিছুটা অংশ নিয়েছি।’ পরবর্তীতে আপনি জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের আর কোন দায়িত্ব পালন করেছেন কি না জানতে চাওয়া হলে খতিব সাহেব বলেন- ‘না, কোন দায়িত্ব ছিলো না। আমি এমনি অনারারি সদস্য ছিলাম জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের। তবে নথিতে আমাকে আর সদস্য হিসেবেও লিপিবদ্ধ করা হয়নি।’ তা হলে রাজনীতির সাথে সক্রিয় কখনো জড়িত ছিলেন না? জিজ্ঞাস করা হলে খতিব সাহেব বলেন-‘জি না।’ তা হলে আমরা খতিব মাওলানা উবায়দুল হকের নিজের ভাষ্য থেকেই জানলাম- তিনি কোনদিন দলীয় রাজনীতির মাঠে সক্রিয় ছিলেন না। কিন্তু আমরা যারা তাকে জানি তারা কি অস্বীকার করতে পারবো যে, তিনি আজীবন দেশ, জাতি এবং ইসলামের শত্র“দের সকল ষড়যন্ত্র উদঘাটিত করতে, সাধারণ মানুষকে এ ব্যাপারে সতর্ক ও সচেতন করতে ময়দানে সর্বদা অগ্রণী ভূমিকা রাখেননি? নিশ্চয় পারবো না। জাতির প্রতিটি সংকটে তাঁর সাহসী ভূমিকা ইতিহাসে স্বর্ণারে লেখা থাকবে। এই ভূমিকার নাম কি রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের দৃষ্টিতে বুদ্ধিভিত্তিক রাজনীতি নয়? আবশ্যই এগুলো রাজনীতি, কিন্তু তা দলীয় সংকীর্ণতায় আবদ্ধ নয়। স্বাধীনচেতা মাওলানা উবায়দুল হক জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমে জুমআর বক্তৃতায় সর্বদা ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক নতুন-পুরাতন সকল নীতির জোর প্রতিবাদ করতেন। তিনি তাঁর উদার ভালোবাসানীতি দিয়ে ইসলামী রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক সকল দল ও সংগঠনসমূহের পারস্পরিক দূরত্ব কমিয়ে আনার চেষ্টা করতেন। যে কোন দ্বীনি সংগঠন কিংবা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ও মতবিরোধ দূর করার কাজে তিনি সর্বদা প্রাণ খুলে নিরপেভাবে কাজ করতেন। ফলে উলামায়ে কেরাম থেকে সাধারণ সমাজ পর্যন্ত সবার কাছে তিনি ছিলেন একজন নিরপে ন্যায়বিচারক ব্যক্তি হিসেবে খ্যাত। বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষ নিজেদের সমস্যা, অভাব-অভিযোগ নিয়ে সর্বদা তাঁর কাছে ছুটে যেতেন। জাতীয় পর্যায় থেকে শুরু করে গ্রাম পর্যায় পর্যন্ত মানুষ তাঁর কাছে ছুটে যেতো সমস্যা সমাধানের জন্য। তিনি একজন বাস্তবতাবাদি পরিপূর্ণ মানুষ ছিলেন।
দৈনিক প্রথম আলো সম্পাদকের তাওবাহ প্রসঙ্গখতিব মাওলানা উবায়দুল হকের ইন্তেকালের মাত্র কয়েকদিন পূর্বের ঘটনা। দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকার আলপিনে ইসলাম ধর্মকে কটা করে কার্টুন প্রকাশিত হলে তাওহিদী জনতার বিবেকী কণ্ঠ খতিব মাওলানা উবায়দুল হক এবং সারাদেশের তাওহিদী জনতা গর্জে উঠেন এক সাথে। দৈনিক প্রথম আলো কর্তৃপ বুঝতে পারে তারা কি ভুলটা করেছে। তাদের চলার পথ প্রায় অন্ধকার। তারা এখন নিজেদের ভুলের জন্য জাতির কাছে মা চেয়ে ভুল সংশোধন করতে চায়। প্রথমে জাতীয় পত্রিকার সম্পাদকদ্বয় বসেন এই সমস্যা নিরসনের পথ খুঁজতে। তাঁরা তাদের বৈঠক থেকে তিন সদস্য বিশিষ্ট একটি টিম প্রেরণ করেন খতিব সাহেবের কাছে। এই টিমের একজন সদস্য ছিলেন দৈনিক যুগান্তরের সিনিয়র রিপোর্টার বন্ধুবর সেলিম জাহিদ। সেলিম জাহিদ তাঁর ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণ ‘একজন রিপোর্টার এবং খতিব উবায়দুল হক’ শীর্ষক লেখায় লিখেছেন-‘খতিব মাওলানা উবায়দুল হকের সাথে আমার শেষ দেখাটি হয়েছিলো তাঁর আজিমপুরের বাসায়। মৃত্যুর ১৮দিন আগে গত ১৮ সেপ্টেম্বর, ৫ রমজান রাতে। শীর্ষ স্থানীয় বাংলা দৈনিক প্রথম আলোর বিতর্কিত কার্টুন নিয়ে হইচই শুরুর দিন। মধ্যস্থতার অনুরোধ পেয়ে তিন সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল নিয়ে ওই রাতে হুজুরের বাসায় যাই।(বিষয়টি এমন নয় যে, আমি খতিবের ওপর প্রভাব বিস্তার করার মতো কোন ব্যক্তি বা আমার মধ্যস্থতায় কোন সমাধান হয়েছে)। খুব দরদ দিয়ে নিজ হাতে আপ্যায়ন করালেন। একজন সংবাদকর্মীর সঙ্গে দেশের একজন শীর্ষ আলেমের এমন দরদ ছিল অকল্পনীয়। সেদিনের ওই বৈঠকের কথা এখনও কানে বাজে। ১৮ সেপ্টেম্বরের প্রথম আলো হাতে খতিব বলেন- ‘অপরাধ করলেন এত বড়, আর মা চাইলেন দেড় ইঞ্চির-আলেম সমাজ এই মা মানে না।’ শেষ কথাটি ছিল- ‘অন্তর দিয়ে মা চাইলে পত্রিকায় এর প্রভাব পড়বে।’ (পত্রিকায় প্রকাশের পূর্বেই সেলিম জাহিদ আমাকে এই স্মৃতিচারণ দিয়েছিলেন পড়ার জন্য। আমার এই লেখা তৈরির পূর্ব পর্যন্ত তা কোন পত্রিকায় প্রকাশ পায়নি)। এই তিন সদস্যের আলোচনার ভিত্তিতেই পরবর্তিতে ২০ সেপ্টেম্বর ০৭, শুক্রবার দুপুরে প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান কয়েকটি জাতীয় পত্রিকার সম্পাদককে সাথে নিয়ে আইন উপদেষ্টা ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন এবং ধর্ম উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) ডা. মতিউর রহমানের সাথে বৈঠক করেন। বৈঠকে প্রথম আলো সম্পাদক সরকারের যে কোন শর্ত মেনে নেওয়ার কথা জানান। বিকেলে প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমানকে নিয়ে আইন উপদেষ্টা, ধর্ম উপদেষ্টা, দৈনিক যুগান্তর সম্পাদক গোলাম সারোয়ার, ইন্ডিপেন্ডেন্ট সম্পাদক মাহবুবুল আলম, আমাদের সময় সম্পাদক মাঈনুল ইসলাম খান, মানব জমিন সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী জাতীয় মসজিদ বায়তুল মুকাররমের খতিব মাওলানা উবায়দুল হকের সাথে দেখা করেন। ইসলামিক ফান্ডেশনের ইফতার মাহফিল এবং মাগরিবের নামাজ শেষে দেশের শীর্ষস্থানীয় এই ব্যক্তিবর্গের বৈঠক বসে খতিব সাহেবের সাথে। এই বৈঠকে অন্যন্যের মধ্যে আরো উপস্থিত ছিলেন-বায়তুল মোকাররম মসজিদের পেশ ইমাম মুফতি মাওলানা নুরউদ্দিন, তামিরুল মিল্লাত কামিল মাদ্রাসার অধ্য মাওলানা যইনুল আবেদিন, ইসলামিক ফান্ডেশনের মহা পরিচালক মুহাম্মদ ফজলুর রহমান, খেলাফত মজলিস নেতা মাওলানা মাসুম বিল্লাহ, আহলে হাদিস যুব সংঘের আবদুল ওয়াদুদ সহ আরো কিছু ইসলামী দলের নেতা। এই বৈঠকে আলোচনার মাধ্যমে প্রথমে দৈনিক প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান অঙ্গিকারনামা পেশ করেন যে, ‘ভবিষ্যতে আলপিন ম্যাগাজিন আর প্রকাশ করা হবে না এবং প্রথম আলোতে ভবিষ্যতে পবিত্র ইসলাম ধর্ম নিয়ে কুৎসামূলক কোন বক্তব্য-বিবৃতি ছাপানো হবে না’। প্রথম আলো সম্পাদক এই অঙ্গিকারনামা পেশ করলে খতিব সাহেব সম্পাদক সাহেবকে উদ্দেশ্য করে বলেন-‘আপনার পত্রিকা শুরু থেকেই ইসলাম ও ইসলামী মূল্যবোধের বিরুদ্ধে বিভিন্ন লেখালেখি করে আসছে। দেশের শতকরা ৮৫ভাগ মানুষের অনুভূতিতে আঘাত দেয়ার অধিকার আপনাকে কেউ দেয়নি। মুসলমানরা মহানবী (স.)কে নিজের জীবনের চেয়ে বেশি ভালোবাসে। আপনারা কার্টুন ছাপিয়ে মুসলমানদের মনে যে আঘাত দিয়েছেন তা কোন অবস্থায়ই মার যোগ্য নয়। তারপরেও ভবিষ্যতে আর এ ধরনে ঘটনা ঘটবে না এবং ইসলাম ও মুসলমানদের স্বার্থবিরোধী কোনো সংবাদ ও লেখা প্রকাশ করবেন না বলে আল্লাহর কাছে আপনার অপরাধের জন্য তওবাহ করা উচিৎ।’ খতিবের বক্তব্যের পর প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান খতিব মাওলানা উবায়দুল হকের হাত ধরে তওবা করেন এবং দোয়া চান। এরপর খতিব মাওলানা উবায়দুল হক উপস্থিতদের উদ্দেশ্যে যে বক্তব্য দিয়েছেন তা দৈনিক আমার দেশের ভাষ্যমতে এইÑ‘ মহান আল্লাহ তা’আলা মাশীল। তিনি মাকে পছন্দ করেন। প্রথম আলো সম্পাদক তার পত্রিকার মাধ্যমে মহানবী (স.)-কে অবমাননার মাধ্যমে যে অপরাধ করেছেন, তার জন্য তিনি এখন অনুতপ্ত। তিনি আল্লাহর কাছে তওবা করেছেন, বিষয়টি ব্যক্তিগতভাবে আমাদের সাথে সম্পৃক্ত নয়। এটি সমগ্র মুসলিম জাতির আবেগ-অনুভূতির সাথে সংশ্লিষ্ট। তবে তিনি যেহেতু মা চেয়েছেন, তওবা করেছেন, কাজেই তার মার বিষয়টি আল্লাহ পাকই জানেন। আপনারা অনেক বিজ্ঞজন এখানে এসেছেন এবং অনুরোধ করেছেন। এ বিষয়ে আমার প থেকে আর কোনো ােভ নেই। তবে রাষ্ট্রিয় আইনে কোন অপরাধ হলে সে বিষয়ে রাষ্ট্রই বুঝবে।’ (দৈনিক আমার দেশ, ২১ সেপ্টেম্বর,২০০৭, পৃষ্টা ২)। দৈনিক প্রথম আলোর ভাষ্য মতে খতিব বলেন - ‘যেহেতু প্রথম আলো সম্পাদক উপস্থিত হয়ে বলেছেন তাদের ত্র“টি হয়েছে। তাঁরা দুঃখিত, জনগণের কাছে মা চেয়েছেন। এরপরও আদালতে গিয়ে মা চাইতেও তারা প্রস্তুত আছেন। এ অবস্থায় আমরা মনে করি এটা নিয়ে আন্দোলন করা, এটা ঠিক না। কারণ আন্তরিকভাবে মা চাওয়ার পর আমাদের নবী করিম (স.)-এর উসওয়া এবং সুন্নত হলো এটাকে মাফ করে দেওয়া। আমরা আশা করি জনগণও মাফ করে দেবে। ভবিষ্যতে এই পত্রিকা ধর্মীয় বিষয়ে কোনো রকম সমালোচনা, বিদ্রুপে লিপ্ত হবে না।’ এরপর ওলামায়ে কেরাম সকলেই বলেছেন, এটা মাফ করে দেওয়া সমুচিত। এতে আমারও একই মত।(দৈনিক প্রথম আলো, ২১ সেপ্টেম্বর০৭, প্রথম পৃষ্টা)। এখানেই ঘটনা শেষ নয়। দৈনিক প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান লিখিতভাবে ২১ সেপ্টেম্বরে নিজ পত্রিকার প্রথম পৃষ্টার লিড নিউজে ‘আমরা দুঃখিত ও মাপ্রার্থী’ শিরোনামে তিন কলামে তাঁর অঙ্গিকারনামা জাতির সামনে পেশ করেছেন। এই অঙ্গিকারনামায় প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান স্পষ্ট ভাষায় বলেছেনÑ‘গত ১৭ সেপ্টেম্বর প্রথম আলোর সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন ‘আলপিন’-এ প্রকাশিত একটা অনাকাঙ্খিত, অগ্রহণযোগ্য কার্টুন-কাহিনী প্রকাশের জন্য আবারও দুঃখপ্রকাশ ও মা প্রার্থনা করছি। পাশাপাশি বিষয়টিকে ভুল হিসেবে মাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখার জন্য সবার প্রতি আবেদন জানাচ্ছি। ওই কার্টুন-কাহিনীসংবলিত আলপিনসহ ১৭ সেপ্টেম্বরের পত্রিকা বাজারে চলে যাওয়ার পর ধরা পড়ে যে, একটা বড় অনাকাঙ্খিত ভুল হয়ে গেছে। এ এমন একটা ভুল, যার পে কোনো যুক্তি যথেষ্ট নয়। প্রথম আলো সব সময়ই ইসলাম ধর্ম ও ধর্মীয় আবেগের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। পাঠক ও ধর্মপ্রাণ মুসল্লিদের আবেগ ও অনুভূতিতে যাতে আঘাত না লাগে, সে ব্যাপরে আমরা সব সময় সচেতন এবং তা রায় সর্বদা সচেষ্ট। স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন আসে, এত সতর্কতা, এত চেষ্টার ভেতরও কী করে এ রকম একটা সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য কার্টুন ছাপা হয়ে গেলো? বিষয়টি জানার সাথে সাথে প্রথম আলো ঘটনার কারণ অনুসন্ধান এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে শুরু করে। সিদ্ধান্ত নেয়, নিঃশর্তভাবে মা চাওয়া হবে এবং সংশ্লিষ্ট দায়িত্বপ্রাপ্ত যে সহসম্পাদকের বিবেচনায় এই ভুল ধরা পড়েনি, তাঁকেও অপসারণ করা হবে। প্রথম আলো পাঠকদের অনেকেই ফোন করে জানিয়েছেন, এই কার্টুন তাঁদের আহত করেছে। আমরা তাদের সমব্যথী। প্রথম আলোর সম্পাদকীয় নীতির একটি হলো-ভুল যাতে না হয় সে জন্য চেষ্টা করা। তারপরও ভুল হয়ে গেলে তা বুঝার বা জানার সঙ্গে সঙ্গে সংশোধনী ছাপানো ও দুঃখ প্রকাশ করা। কারণ যে পত্রিকাটি ২৫ লাখ মানুষের কাছে প্রতিদিন যায়, তাতে একটা ভুল হলে তার নেতিবাচক প্রভাবও হয় ব্যাপক। অনেক এজন্য তিগ্রস্ত হতে পারেন,অনেকে মানসিকভাবে আহত হতে পারেন। এই নীতি অনুসরণ করে গত ১৮ সেপ্টেম্বর পত্রিকার মাধ্যমে প্রথম আলো এই কার্টুক-কাহিনী প্রত্যাহার করে নেয়। ১৯ সেপ্টেম্বর ওই প্রদায়ক কার্টুনিস্টের আর কোনো লেখা বা কার্টুন পত্রিকায় না ছাপার সিদ্ধান্ত নেয়। একই সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সহসম্পাদককে অপসারণের সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে দেয় পাঠকদেরকে। প্রথম আলো পর পর দুই দিন সবার কাছে আন্তরিক দুঃখ প্রকাশ ও নিঃশর্ত মা প্রার্থনা করে। প্রথম আলোর প্রথম পৃষ্টায় এই আবেদন প্রকাশিত হয়। ২০ সেপ্টেম্বর প্রথম আলোর সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে-‘ধর্মীয় অনুভূতির প্রতি আমরা শ্রদ্ধাশীল। অনিচ্ছাকৃত ভুলটি মাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখুন।’ সরকার গত বুধবার আলপিনের ১৭ সেপ্টেম্বরের সব কপি বাজেয়াপ্ত করে এবং প্রদায়ক কার্টুনিস্ট আরিফুর রহমানকে গ্রেফতার করে। এ রকম একটা অনাকাঙ্খিত কার্টুন প্রকাশিত হওয়ার জন্য আজও প্রথম আলো দুঃখপ্রকাশ ও মা প্রার্থনা করছে আন্তরিকভাবে। কারণ এই ভুলটি একেবারে অনিচ্ছাকৃত ও অসাবধানতাবশত। ভবিষ্যতে এ ধরণের ভুলের পুনরাবৃত্তি না করার ব্যাপারে সতর্ক থাকার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে এই পত্রিকা। একই সঙ্গে ১৩জন সম্পাদকের গতকালকের বক্তব্যের সঙ্গে আমরা একমত। প্রথম আলো আশা করে সবাই বিষয়টা মা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।’ ( দৈনিক প্রথম আলো, ২১ সেপ্টেম্বর০৭, প্রথম পৃষ্ঠা)। প্রথম আলো সম্পাদক তার মাধ্যমে দেশবাসীর কাছে মা চাইলে তিনি দেশবাসীকে সহিষ্ণুতা বজায় রাখার আহবান জানান। যদিও না বুঝে কেউ কেউ তখন খতিব সাহেবের এই ভূমিকার জন্য অসস্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন, কিন্তু চিন্তার পর যখন দেখেছে-‘এর ফলে দেশ এক ভয়াবহ রক্তয়ী সংঘর্ষ থেকে রা পেয়েছে’ তখন প্রায় সবাই নিরবতা প্রদর্শন করেছেন। খতিব মাওলানা উবায়দুল হকের এই ভূমিকা সত্যই দেশের সর্বস্তরের মানুষের কাছে প্রসংশিত হয়েছে। যারা বলেন, খতিব সাহেব এ সব সরকারের ছাপে করেছেন, তারা মূলত খতিব সাহেবকে জানেন না।
সম্মান ও মূল্যায়নকর্মঠ এবং যোগ্য মানুষের কাছে প্রাপ্তিতে তৃপ্তি নেই, কর্মে তৃপ্তি। খতিব মাওলানা উবায়দুল হক একজন কর্মে বিশ্বাসী আলেম ছিলেন। যারা তাঁকে কাছ থেকে দেখেছেন তারা সবাই স্বীকার করবেন, তিনি কর্মের ফল দুনিয়াতে পাওয়ার বিশ্বাসী ছিলেন না। এই সব গুণের কারণেই তিনি বাংলাদেশের উলামায়ে কেরাম ও সর্বসাধারণের নিকট একজন জনপ্রিয় ও অতি সম্মানিত ব্যক্তি হয়েছেন। শুধু বাংলাদেশে নয়, বিদেশেও তাঁর খ্যাতি আছে। তিনি অর্ধ শতাব্দীর কর্মমুখর সফল জীবনে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা ও প্রতিষ্ঠান দ্বারা বিশেষ বিশেষ সম্মানে ভূষিত হয়েছেন। সৌদি আরবের রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ মতাসম্পন্ন তত্ত্বাবধায়ক প্রতিষ্ঠান মজলিসে শুরা তাঁকে আমন্ত্রণ জানিয়ে স্বর্ণপদক প্রদান করেছে। জাতীয় সীরাত কমিটি বাংলাদেশ তাঁকে ২০০৪ খ্রিস্টাব্দে বছরের সেরা ইসলামী ব্যক্তিত্ব নির্বাচিত করে স্বর্ণপদক প্রদান করেছে। পবিত্র কুরআন ও হাদীসের শিকতায় বিশেষ অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ তাঁকে কোরআন শিক্ষা সোসাইটি ২০০৫ খ্রিস্টাব্দে নগদ পঞ্চাশ হাজার টাকা ও বিশেষ এ্যাওয়ার্ড প্রদান করে। হোফফাজুল কুরআন ফাউণ্ডেশন বাংলাদেশ জাতীয় পর্যায়ে বিভিন্ন বিষয়ে অবদানের স্বীকৃতি হিসাবে বিশেষ পদকে ভূষিত করে। এছাড়া তিনি আরো অনেক দেশী ও বিদেশী সংস্থা থেকে সম্মানজনক সনদ, ক্রেস্ট, পদক ও খেতাব লাভ করেছিলেন।
বায়তুল মোকাররমে খতিব সাহেবের জীবনের শেষ খুতবাবায়তুল মোকাররমে খতিব মাওলানা উবায়দুল হক শেষ জুম্মার খুতবা দিলেন ৫ অক্টোবর ০৭। কিন্তু সেদিন কে জানতো এটা তাঁর জীবনের শেষ খুতবা? অথচ সেদিন তিনি তাঁর খুতবায় বার বার বলেছ-‘আমার মনে হচ্ছে আজ জুম্মাতুল বিদা। কিন্তু আগামী জুম্মা হচ্ছে জুম্মাতুল বিদা।’ খতিব মাওলানা উবায়দুল হক তাঁর জীবনের শেষ খুতবায় আরো বলেন- ‘ব্যাংকে টাকা রেখে সুদ গ্রহণ করা হারাম। আর সুদ খাওয়া ব্যবিচারের চেয়েও বড় অপরাধ। হারাম উপার্জনে গঠিত রক্ত-মাংসের জন্য জাহান্নাম অবধারিত। তাদের জাকাত, ফিতরা, হজ্ব সহ কোন ইবাদতই কবুল হবে না।’ ব্যাংকের সুদ গ্রহণ এবং হারাম উপার্জন থেকে বেঁচে থাকার জন্য তিনি সকলের প্রতি আহ্বান জানান। খতিব আরো বলেন- ‘জুম্মা হলো সপ্তাহের প্রধান দিবস। এ দিবসে আল্লাহ দোয়া কবুল করে থাকেন। আর জুম্মার দিনে হযরত রাসুল (স.)এর উপর দুরূদ পাঠ করলে সত্তর গুণ বেশি সোয়াব হয়ে থাকে। তাই জুম্মার দিন বেশি বেশি ইবাদত করা দরকার। আর রমজান মাসে এমন একটি রাত রয়েছে যা হাজার মাস তথা ৮৬ বছর ৪ মাসের চেয়েও উত্তম। ভাগ্য নির্ধারণ করা হয় বলে এ রাতকে লাইলাতুল ক্বদর বলা হয়। এ রাতে ইবাদত করলে হাজার বছর তথা ৮৬ বছর চার মাস ইবাদত করার চেয়েও বেশি সোয়াব হবে। লাইলাতুল ক্বদর নির্দ্দিষ্ট করে বলা হয়নি বিধায় হযরত রাসুল (স.) রমজানের শেষ দশদিন ইতেকাফের মাধ্যমে লাইলাতুল ক্বদর তালাশ করতেন। তিনি আরো বলেছেনÑ ‘সদকাতুল ফিতরা ও সম্পদের যাকাত আদায় করা জরুরী। যারা সম্পদের যাকাত আদায় করে না, এই সম্পদ কিয়ামতের দিন আগুন হয়ে তাদেরকে শাস্তি দেবে। আর যারা নামাজ পড়ে, হজ্ব পালন করে, আবার সুদও খায় তাদের ইবাদত আল্লাহ কবুল করবেন না। সুদ ব্যভিচারের চেয়ে বড় অপরাধ। আর হারাম খাদ্য দ্বারা গঠিত রক্ত-মাংস বেহেশতে যাবে না। তাই হারাম উপার্জন থেকে বেঁচে থাকা সকলের জন্য জরুরী।’ ( দৈনিক সংগ্রাম, শনিবার, ৬ অক্টোবর ০৭)।
খতিব সাহেবের আরবি ভাষায় পাণ্ডিত্য খতিব সাহেব পৃথিবীর অন্য যে কোন ভাষা থেকে আরবি ভাষায় ছিলেন দ। সাহিত্যের দিকে তিনি নিজের মাতৃভাষা বাংলা থেকেও আরবিতে ছিলেন বেশি পারদর্শি। যার বাস্তব প্রমাণÑতিনি ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দের আগষ্ট ও ১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দের মে মাসে দু’বার আরবি বক্তৃতা প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে প্রতিবারই প্রথম স্থান লাভের গৌরব অর্জন করে ছিলেন। এ প্রতিযোগিতা মাদরাসা-ই আলিয়া ঢাকার প্রিন্সিপাল শায়খ শরফুদ্দীন(র.)এর পৃষ্ঠপোষকতায় পাকিস্তান জমিয়তে লিসানুল কুরআন-এর তত্ত্বাবধানে অনুষ্ঠিত হয়েছিলো।
খতমে নবুওয়ত আন্দোলনের নেতৃত্বে খতিব সাহেব ‘হযরত মুহাম্মদ (স.) সর্বশেষ নবী এবং রাসুল’ এই কথা হলো খতমে নবুওয়াতের দাবি। ঈমান এবং আকায়েদের দিকে ‘খতমে নাবুওয়াত’ এর প্রতি বিশ্বাস রাখা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কেউ যদি এই বিশ্বাস না রাখে তবে সে মুসলমান থাকবে না। ভারতের কাদিয়ান শহরের মির্জা গোলাম আহমদ বৃটিশ শাসন যুগে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় নিজকে নবী দাবি করে বসে(নাউযুবিল্লাহ)। সে তার এই দাবির পে বিভিন্ন কৌশলি প্রচার চালিয়ে এবং ইসলামের শত্র“দের সহযোগিতায় কিছু মানুষকে বিভ্রান্ত করতে থাকে। বাংলাদেশেও ইসলাম সম্পর্কে মূর্খ কিছু লোককে বিভিন্নভাবে তার পে তৈরি করে ফেলে। এই বিভ্রান্তি থেকে মানুষকে বাঁচানোর জন্য বিশ্বব্যাপি খতমে নাবুওয়াত আন্দোলনের প্রয়োজন দেখা দেয়। বাংলাদেশও এই প্রয়োজন থেকে খালি নয়। উলামায়ে কেরাম শুরু করেন বাংলাদেশে খতমে নাবুওয়াত আন্দোলন। এই আন্দোলন এক পর্যায়ে সাংগঠনিক রূপ নেয় ‘ আন্তর্জাতিক মজলিশে তাহাফফুজে খতমে নবুওয়াত বাংলাদেশ’ নামে। খতিব সাহেব এই সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি না হলেও তাঁর নেতৃত্বে তা প্রাঞ্জল হয়ে দেশ-বিদেশের বাংগালী মুসলমানদের ভেতর জাগরণ সৃষ্টি করেছে। তাঁর নেতৃত্বে কাদিয়ানী স¤প্রদায়ের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী আন্দোলনের ফলে ২০০৪ খ্রিস্টাব্দে সরকার কাদিয়ানী স¤প্রদায়ের সকল প্রকাশনা মুদ্রণ ও বিতরণ নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে বাধ্য হয়। মাওলানা উবায়দুল হকের ডাকে এবং তাঁর সভাপতিত্বে ঢাকায় প্রতি বছর মজলিসে তাহাফফুজে খতমে নাবুওয়তের বিশাল আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হতো। তিনি সভাপতি থাকাকালিন সময়ে এই আন্দোলন কোন রাজনীতিক দলের সাথে সম্পৃক্ত হয়নি। ফলে দেখা গেছে খতমে নবুওয়াত আন্দোলনে দল-মত নির্বিশেষে এদেশের সকল শ্রেণীর তাওহিদী জনতা অংশ গ্রহণ করতেন।খতিব সাহেবের রাজনৈতিক জীবন নেজামে ইসলাম পার্টির নেতা মাওলানা আতহার আলী (র.) খতিব মাওলানা উবায়দুল হককে মুফতি শফি (র.)এর দারুল উলূম করাচি থেকে ঢাকায় নিয়ে এসেছিলেন মূলত নেজামে ইসলাম পার্টির প্রচার ও প্রকাশনা বিভাগের দায়িত্ব সোপর্দ করতে। সোপর্দ করেছিলেনও। তবে তিনির দায়িত্ব লাভের অল্পদিন পর কেন্দ্রীয় সরকার পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক সরকার ভেঙ্গে সকল রাজনৈতিক দল বেআইনী ঘোষণা দিয়ে যাবতীয় কার্যকলাপ বন্ধ করে দেয়। যার ফলে নেজাম ইসলাম পার্টির সকল তৎপরতা বন্ধ হয়ে যায়। এরপর তিনি ঢাকা আলিয়া মাদ্রাসায় শিকতা শুরু করলে আর কোনদিন সক্রিয় দলীয় রাজনীতিতে আসেননি। তিনি রাজনীতিতে সক্রিয় না হলেও বিভিন্ন সময় জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের কর্যকরি কমিটি তাঁকে সদস্য রেখেছে। খতিব মাওলানা উবায়দুল হকের রাজনৈতিক জীবন বলা যেতে পারে ছোটবেলা থেকেই। কিন্তু সক্রিয় রাজনীতিতে তিনি খুবই অল্পদিন ছিলেন। ৪৭ পূর্ব ভারতের রাজনীতিতে তিনি জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের সাথে ছিলেন। জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের সাথে নয়। তৎকালিন সময় জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম আর জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের মধ্যে ব্যবধান ছিলো। শায়খুল ইসলাম হযরত মাওলানা সাইয়েদ হোসেন আহমদ মাদানি (র.)এর নেতৃত্বাধীন জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ ছিলো যুক্ত ভারতের পে আর শায়খুল ইসলাম মাওলানা শিব্বির আহমদ উসমানি (র.) ছিলেন মুসলমানদের জন্য পৃথক স্বাধীন ভূমি পাকিস্তান তৈরির পক্ষে পাকিস্তান হওয়ার পরও বিশেষ করে সিলেট অঞ্চলে জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের বিশাল প্রভাব রয়ে গিয়েছিলো। হযরত মাদানি (র.)এর খলিফা হাফেজ মাওলানা আব্দুল করিম শায়খে কৌড়িয়া (র.) ছিলেন জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের নেতা, আর জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের নেতৃত্বে ছিলেন হাকিমুল উম্মাত হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানবি (র.)এর খলিফাদ্বয় হযরত মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরি ও হযরত মাওলানা আতহার আলী (র.) প্রমূখ। কেন্দ্রীয়ভাবে স্বয়ং হাকিমুল উম্মাত মাওলানা আশরাফ আলী থানবি (র.)ও ছিলেন জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের পক্ষে। আমরা জানি যে, খতিব সাহেবের বাবা ছিলেন হযরত থানবি (র.)এর খলিফা। তাই এটাই বাস্তবতা যে, খতিব সাহেব চিন্তাগতদিকে জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের পক্ষে থাকবেন, কারণ তখনও পিতা থেকে রাজনৈতিক ভিন্নমত করার মতো তাঁর বয়স হয়নি। আর অন্যদিকে ছোটবেলা খতিব সাহেব ঘুংগাদিতে হযরত মাওলানা আতহার আলী সাহেবের মাদ্রাসার ছাত্র ছিলেন। এই সব বিভিন্ন কারণে খতিব সাহেব ছোটবেলা থেকেই জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের পে কাজ করেছেন, জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের পে যাননি। এক সময় জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বিভিন্ন ইসলামী দলের সাথে মিলে খতিবে আজম মাওলানা সিদ্দিক আহমদ (র.)এর নেতৃত্বে নেজামে ইসলাম হয়ে যায়। হযরত খতিব সাহেব (র.) নিজে আমাদেরকে বলেছেন- ‘তবে তখনও নেজামে ইসলাম পার্টির নামকরণ হয় নাই, তখন নাম ছিলো জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম। তখন আমি বাচ্চা মানুষ ছিলাম, তবে তাদের সাথে সহযোগী ছিলাম। মাওলানা আতহার আলী সাহেব ছিলেন জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের সভাপতি।’ এরপর আমরা যখন জানতে চাইলাম-জমিয়তের প্রচার সম্পাদকের দায়িত্বে কোন সময় ছিলেন? তখন তিনি বলেন-‘যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনের সময়, অর্থৎ ৫১ থেকে ৫৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। আবার যখন জানতে চাইলাম-তা হলে আপনি যুক্তফ্রন্টের পক্ষে নির্বাচনী প্রচারে অংশ নিয়ে ছিলেন? তখন খতিব সাহেব বলেন- ‘না, আমি অংশ নিতে পারি নাই, তখন আমি করাচিতে ছিলাম। তবে ঐখান থেকে তাদের পে বয়ান পত্র-পত্রিকায় প্রচার করে কিছুটা অংশ নিয়েছি।’ পরবর্তীতে আপনি জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের আর কোন দায়িত্ব পালন করেছেন কি না জানতে চাওয়া হলে খতিব সাহেব বলেন- ‘না, কোন দায়িত্ব ছিলো না। আমি এমনি অনারারি সদস্য ছিলাম জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের। তবে নথিতে আমাকে আর সদস্য হিসেবেও লিপিবদ্ধ করা হয়নি।’ তা হলে রাজনীতির সাথে সক্রিয় কখনো জড়িত ছিলেন না? জিজ্ঞাস করা হলে খতিব সাহেব বলেন-‘জি না।’ তা হলে আমরা খতিব মাওলানা উবায়দুল হকের নিজের ভাষ্য থেকেই জানলাম- তিনি কোনদিন দলীয় রাজনীতির মাঠে সক্রিয় ছিলেন না। কিন্তু আমরা যারা তাকে জানি তারা কি অস্বীকার করতে পারবো যে, তিনি আজীবন দেশ, জাতি এবং ইসলামের শত্র“দের সকল ষড়যন্ত্র উদঘাটিত করতে, সাধারণ মানুষকে এ ব্যাপারে সতর্ক ও সচেতন করতে ময়দানে সর্বদা অগ্রণী ভূমিকা রাখেননি? নিশ্চয় পারবো না। জাতির প্রতিটি সংকটে তাঁর সাহসী ভূমিকা ইতিহাসে স্বর্ণারে লেখা থাকবে। এই ভূমিকার নাম কি রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের দৃষ্টিতে বুদ্ধিভিত্তিক রাজনীতি নয়? আবশ্যই এগুলো রাজনীতি, কিন্তু তা দলীয় সংকীর্ণতায় আবদ্ধ নয়। স্বাধীনচেতা মাওলানা উবায়দুল হক জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমে জুমআর বক্তৃতায় সর্বদা ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক নতুন-পুরাতন সকল নীতির জোর প্রতিবাদ করতেন। তিনি তাঁর উদার ভালোবাসানীতি দিয়ে ইসলামী রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক সকল দল ও সংগঠনসমূহের পারস্পরিক দূরত্ব কমিয়ে আনার চেষ্টা করতেন। যে কোন দ্বীনি সংগঠন কিংবা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ও মতবিরোধ দূর করার কাজে তিনি সর্বদা প্রাণ খুলে নিরপেভাবে কাজ করতেন। ফলে উলামায়ে কেরাম থেকে সাধারণ সমাজ পর্যন্ত সবার কাছে তিনি ছিলেন একজন নিরপে ন্যায়বিচারক ব্যক্তি হিসেবে খ্যাত। বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষ নিজেদের সমস্যা, অভাব-অভিযোগ নিয়ে সর্বদা তাঁর কাছে ছুটে যেতেন। জাতীয় পর্যায় থেকে শুরু করে গ্রাম পর্যায় পর্যন্ত মানুষ তাঁর কাছে ছুটে যেতো সমস্যা সমাধানের জন্য। তিনি একজন বাস্তবতাবাদি পরিপূর্ণ মানুষ ছিলেন।
দৈনিক প্রথম আলো সম্পাদকের তাওবাহ প্রসঙ্গখতিব মাওলানা উবায়দুল হকের ইন্তেকালের মাত্র কয়েকদিন পূর্বের ঘটনা। দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকার আলপিনে ইসলাম ধর্মকে কটা করে কার্টুন প্রকাশিত হলে তাওহিদী জনতার বিবেকী কণ্ঠ খতিব মাওলানা উবায়দুল হক এবং সারাদেশের তাওহিদী জনতা গর্জে উঠেন এক সাথে। দৈনিক প্রথম আলো কর্তৃপ বুঝতে পারে তারা কি ভুলটা করেছে। তাদের চলার পথ প্রায় অন্ধকার। তারা এখন নিজেদের ভুলের জন্য জাতির কাছে মা চেয়ে ভুল সংশোধন করতে চায়। প্রথমে জাতীয় পত্রিকার সম্পাদকদ্বয় বসেন এই সমস্যা নিরসনের পথ খুঁজতে। তাঁরা তাদের বৈঠক থেকে তিন সদস্য বিশিষ্ট একটি টিম প্রেরণ করেন খতিব সাহেবের কাছে। এই টিমের একজন সদস্য ছিলেন দৈনিক যুগান্তরের সিনিয়র রিপোর্টার বন্ধুবর সেলিম জাহিদ। সেলিম জাহিদ তাঁর ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণ ‘একজন রিপোর্টার এবং খতিব উবায়দুল হক’ শীর্ষক লেখায় লিখেছেন-‘খতিব মাওলানা উবায়দুল হকের সাথে আমার শেষ দেখাটি হয়েছিলো তাঁর আজিমপুরের বাসায়। মৃত্যুর ১৮দিন আগে গত ১৮ সেপ্টেম্বর, ৫ রমজান রাতে। শীর্ষ স্থানীয় বাংলা দৈনিক প্রথম আলোর বিতর্কিত কার্টুন নিয়ে হইচই শুরুর দিন। মধ্যস্থতার অনুরোধ পেয়ে তিন সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল নিয়ে ওই রাতে হুজুরের বাসায় যাই।(বিষয়টি এমন নয় যে, আমি খতিবের ওপর প্রভাব বিস্তার করার মতো কোন ব্যক্তি বা আমার মধ্যস্থতায় কোন সমাধান হয়েছে)। খুব দরদ দিয়ে নিজ হাতে আপ্যায়ন করালেন। একজন সংবাদকর্মীর সঙ্গে দেশের একজন শীর্ষ আলেমের এমন দরদ ছিল অকল্পনীয়। সেদিনের ওই বৈঠকের কথা এখনও কানে বাজে। ১৮ সেপ্টেম্বরের প্রথম আলো হাতে খতিব বলেন- ‘অপরাধ করলেন এত বড়, আর মা চাইলেন দেড় ইঞ্চির-আলেম সমাজ এই মা মানে না।’ শেষ কথাটি ছিল- ‘অন্তর দিয়ে মা চাইলে পত্রিকায় এর প্রভাব পড়বে।’ (পত্রিকায় প্রকাশের পূর্বেই সেলিম জাহিদ আমাকে এই স্মৃতিচারণ দিয়েছিলেন পড়ার জন্য। আমার এই লেখা তৈরির পূর্ব পর্যন্ত তা কোন পত্রিকায় প্রকাশ পায়নি)। এই তিন সদস্যের আলোচনার ভিত্তিতেই পরবর্তিতে ২০ সেপ্টেম্বর ০৭, শুক্রবার দুপুরে প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান কয়েকটি জাতীয় পত্রিকার সম্পাদককে সাথে নিয়ে আইন উপদেষ্টা ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন এবং ধর্ম উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) ডা. মতিউর রহমানের সাথে বৈঠক করেন। বৈঠকে প্রথম আলো সম্পাদক সরকারের যে কোন শর্ত মেনে নেওয়ার কথা জানান। বিকেলে প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমানকে নিয়ে আইন উপদেষ্টা, ধর্ম উপদেষ্টা, দৈনিক যুগান্তর সম্পাদক গোলাম সারোয়ার, ইন্ডিপেন্ডেন্ট সম্পাদক মাহবুবুল আলম, আমাদের সময় সম্পাদক মাঈনুল ইসলাম খান, মানব জমিন সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী জাতীয় মসজিদ বায়তুল মুকাররমের খতিব মাওলানা উবায়দুল হকের সাথে দেখা করেন। ইসলামিক ফান্ডেশনের ইফতার মাহফিল এবং মাগরিবের নামাজ শেষে দেশের শীর্ষস্থানীয় এই ব্যক্তিবর্গের বৈঠক বসে খতিব সাহেবের সাথে। এই বৈঠকে অন্যন্যের মধ্যে আরো উপস্থিত ছিলেন-বায়তুল মোকাররম মসজিদের পেশ ইমাম মুফতি মাওলানা নুরউদ্দিন, তামিরুল মিল্লাত কামিল মাদ্রাসার অধ্য মাওলানা যইনুল আবেদিন, ইসলামিক ফান্ডেশনের মহা পরিচালক মুহাম্মদ ফজলুর রহমান, খেলাফত মজলিস নেতা মাওলানা মাসুম বিল্লাহ, আহলে হাদিস যুব সংঘের আবদুল ওয়াদুদ সহ আরো কিছু ইসলামী দলের নেতা। এই বৈঠকে আলোচনার মাধ্যমে প্রথমে দৈনিক প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান অঙ্গিকারনামা পেশ করেন যে, ‘ভবিষ্যতে আলপিন ম্যাগাজিন আর প্রকাশ করা হবে না এবং প্রথম আলোতে ভবিষ্যতে পবিত্র ইসলাম ধর্ম নিয়ে কুৎসামূলক কোন বক্তব্য-বিবৃতি ছাপানো হবে না’। প্রথম আলো সম্পাদক এই অঙ্গিকারনামা পেশ করলে খতিব সাহেব সম্পাদক সাহেবকে উদ্দেশ্য করে বলেন-‘আপনার পত্রিকা শুরু থেকেই ইসলাম ও ইসলামী মূল্যবোধের বিরুদ্ধে বিভিন্ন লেখালেখি করে আসছে। দেশের শতকরা ৮৫ভাগ মানুষের অনুভূতিতে আঘাত দেয়ার অধিকার আপনাকে কেউ দেয়নি। মুসলমানরা মহানবী (স.)কে নিজের জীবনের চেয়ে বেশি ভালোবাসে। আপনারা কার্টুন ছাপিয়ে মুসলমানদের মনে যে আঘাত দিয়েছেন তা কোন অবস্থায়ই মার যোগ্য নয়। তারপরেও ভবিষ্যতে আর এ ধরনে ঘটনা ঘটবে না এবং ইসলাম ও মুসলমানদের স্বার্থবিরোধী কোনো সংবাদ ও লেখা প্রকাশ করবেন না বলে আল্লাহর কাছে আপনার অপরাধের জন্য তওবাহ করা উচিৎ।’ খতিবের বক্তব্যের পর প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান খতিব মাওলানা উবায়দুল হকের হাত ধরে তওবা করেন এবং দোয়া চান। এরপর খতিব মাওলানা উবায়দুল হক উপস্থিতদের উদ্দেশ্যে যে বক্তব্য দিয়েছেন তা দৈনিক আমার দেশের ভাষ্যমতে এইÑ‘ মহান আল্লাহ তা’আলা মাশীল। তিনি মাকে পছন্দ করেন। প্রথম আলো সম্পাদক তার পত্রিকার মাধ্যমে মহানবী (স.)-কে অবমাননার মাধ্যমে যে অপরাধ করেছেন, তার জন্য তিনি এখন অনুতপ্ত। তিনি আল্লাহর কাছে তওবা করেছেন, বিষয়টি ব্যক্তিগতভাবে আমাদের সাথে সম্পৃক্ত নয়। এটি সমগ্র মুসলিম জাতির আবেগ-অনুভূতির সাথে সংশ্লিষ্ট। তবে তিনি যেহেতু মা চেয়েছেন, তওবা করেছেন, কাজেই তার মার বিষয়টি আল্লাহ পাকই জানেন। আপনারা অনেক বিজ্ঞজন এখানে এসেছেন এবং অনুরোধ করেছেন। এ বিষয়ে আমার প থেকে আর কোনো ােভ নেই। তবে রাষ্ট্রিয় আইনে কোন অপরাধ হলে সে বিষয়ে রাষ্ট্রই বুঝবে।’ (দৈনিক আমার দেশ, ২১ সেপ্টেম্বর,২০০৭, পৃষ্টা ২)। দৈনিক প্রথম আলোর ভাষ্য মতে খতিব বলেন - ‘যেহেতু প্রথম আলো সম্পাদক উপস্থিত হয়ে বলেছেন তাদের ত্র“টি হয়েছে। তাঁরা দুঃখিত, জনগণের কাছে মা চেয়েছেন। এরপরও আদালতে গিয়ে মা চাইতেও তারা প্রস্তুত আছেন। এ অবস্থায় আমরা মনে করি এটা নিয়ে আন্দোলন করা, এটা ঠিক না। কারণ আন্তরিকভাবে মা চাওয়ার পর আমাদের নবী করিম (স.)-এর উসওয়া এবং সুন্নত হলো এটাকে মাফ করে দেওয়া। আমরা আশা করি জনগণও মাফ করে দেবে। ভবিষ্যতে এই পত্রিকা ধর্মীয় বিষয়ে কোনো রকম সমালোচনা, বিদ্রুপে লিপ্ত হবে না।’ এরপর ওলামায়ে কেরাম সকলেই বলেছেন, এটা মাফ করে দেওয়া সমুচিত। এতে আমারও একই মত।(দৈনিক প্রথম আলো, ২১ সেপ্টেম্বর০৭, প্রথম পৃষ্টা)। এখানেই ঘটনা শেষ নয়। দৈনিক প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান লিখিতভাবে ২১ সেপ্টেম্বরে নিজ পত্রিকার প্রথম পৃষ্টার লিড নিউজে ‘আমরা দুঃখিত ও মাপ্রার্থী’ শিরোনামে তিন কলামে তাঁর অঙ্গিকারনামা জাতির সামনে পেশ করেছেন। এই অঙ্গিকারনামায় প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান স্পষ্ট ভাষায় বলেছেনÑ‘গত ১৭ সেপ্টেম্বর প্রথম আলোর সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন ‘আলপিন’-এ প্রকাশিত একটা অনাকাঙ্খিত, অগ্রহণযোগ্য কার্টুন-কাহিনী প্রকাশের জন্য আবারও দুঃখপ্রকাশ ও মা প্রার্থনা করছি। পাশাপাশি বিষয়টিকে ভুল হিসেবে মাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখার জন্য সবার প্রতি আবেদন জানাচ্ছি। ওই কার্টুন-কাহিনীসংবলিত আলপিনসহ ১৭ সেপ্টেম্বরের পত্রিকা বাজারে চলে যাওয়ার পর ধরা পড়ে যে, একটা বড় অনাকাঙ্খিত ভুল হয়ে গেছে। এ এমন একটা ভুল, যার পে কোনো যুক্তি যথেষ্ট নয়। প্রথম আলো সব সময়ই ইসলাম ধর্ম ও ধর্মীয় আবেগের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। পাঠক ও ধর্মপ্রাণ মুসল্লিদের আবেগ ও অনুভূতিতে যাতে আঘাত না লাগে, সে ব্যাপরে আমরা সব সময় সচেতন এবং তা রায় সর্বদা সচেষ্ট। স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন আসে, এত সতর্কতা, এত চেষ্টার ভেতরও কী করে এ রকম একটা সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য কার্টুন ছাপা হয়ে গেলো? বিষয়টি জানার সাথে সাথে প্রথম আলো ঘটনার কারণ অনুসন্ধান এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে শুরু করে। সিদ্ধান্ত নেয়, নিঃশর্তভাবে মা চাওয়া হবে এবং সংশ্লিষ্ট দায়িত্বপ্রাপ্ত যে সহসম্পাদকের বিবেচনায় এই ভুল ধরা পড়েনি, তাঁকেও অপসারণ করা হবে। প্রথম আলো পাঠকদের অনেকেই ফোন করে জানিয়েছেন, এই কার্টুন তাঁদের আহত করেছে। আমরা তাদের সমব্যথী। প্রথম আলোর সম্পাদকীয় নীতির একটি হলো-ভুল যাতে না হয় সে জন্য চেষ্টা করা। তারপরও ভুল হয়ে গেলে তা বুঝার বা জানার সঙ্গে সঙ্গে সংশোধনী ছাপানো ও দুঃখ প্রকাশ করা। কারণ যে পত্রিকাটি ২৫ লাখ মানুষের কাছে প্রতিদিন যায়, তাতে একটা ভুল হলে তার নেতিবাচক প্রভাবও হয় ব্যাপক। অনেক এজন্য তিগ্রস্ত হতে পারেন,অনেকে মানসিকভাবে আহত হতে পারেন। এই নীতি অনুসরণ করে গত ১৮ সেপ্টেম্বর পত্রিকার মাধ্যমে প্রথম আলো এই কার্টুক-কাহিনী প্রত্যাহার করে নেয়। ১৯ সেপ্টেম্বর ওই প্রদায়ক কার্টুনিস্টের আর কোনো লেখা বা কার্টুন পত্রিকায় না ছাপার সিদ্ধান্ত নেয়। একই সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সহসম্পাদককে অপসারণের সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে দেয় পাঠকদেরকে। প্রথম আলো পর পর দুই দিন সবার কাছে আন্তরিক দুঃখ প্রকাশ ও নিঃশর্ত মা প্রার্থনা করে। প্রথম আলোর প্রথম পৃষ্টায় এই আবেদন প্রকাশিত হয়। ২০ সেপ্টেম্বর প্রথম আলোর সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে-‘ধর্মীয় অনুভূতির প্রতি আমরা শ্রদ্ধাশীল। অনিচ্ছাকৃত ভুলটি মাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখুন।’ সরকার গত বুধবার আলপিনের ১৭ সেপ্টেম্বরের সব কপি বাজেয়াপ্ত করে এবং প্রদায়ক কার্টুনিস্ট আরিফুর রহমানকে গ্রেফতার করে। এ রকম একটা অনাকাঙ্খিত কার্টুন প্রকাশিত হওয়ার জন্য আজও প্রথম আলো দুঃখপ্রকাশ ও মা প্রার্থনা করছে আন্তরিকভাবে। কারণ এই ভুলটি একেবারে অনিচ্ছাকৃত ও অসাবধানতাবশত। ভবিষ্যতে এ ধরণের ভুলের পুনরাবৃত্তি না করার ব্যাপারে সতর্ক থাকার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে এই পত্রিকা। একই সঙ্গে ১৩জন সম্পাদকের গতকালকের বক্তব্যের সঙ্গে আমরা একমত। প্রথম আলো আশা করে সবাই বিষয়টা মা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।’ ( দৈনিক প্রথম আলো, ২১ সেপ্টেম্বর০৭, প্রথম পৃষ্ঠা)। প্রথম আলো সম্পাদক তার মাধ্যমে দেশবাসীর কাছে মা চাইলে তিনি দেশবাসীকে সহিষ্ণুতা বজায় রাখার আহবান জানান। যদিও না বুঝে কেউ কেউ তখন খতিব সাহেবের এই ভূমিকার জন্য অসস্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন, কিন্তু চিন্তার পর যখন দেখেছে-‘এর ফলে দেশ এক ভয়াবহ রক্তয়ী সংঘর্ষ থেকে রা পেয়েছে’ তখন প্রায় সবাই নিরবতা প্রদর্শন করেছেন। খতিব মাওলানা উবায়দুল হকের এই ভূমিকা সত্যই দেশের সর্বস্তরের মানুষের কাছে প্রসংশিত হয়েছে। যারা বলেন, খতিব সাহেব এ সব সরকারের ছাপে করেছেন, তারা মূলত খতিব সাহেবকে জানেন না।
সম্মান ও মূল্যায়নকর্মঠ এবং যোগ্য মানুষের কাছে প্রাপ্তিতে তৃপ্তি নেই, কর্মে তৃপ্তি। খতিব মাওলানা উবায়দুল হক একজন কর্মে বিশ্বাসী আলেম ছিলেন। যারা তাঁকে কাছ থেকে দেখেছেন তারা সবাই স্বীকার করবেন, তিনি কর্মের ফল দুনিয়াতে পাওয়ার বিশ্বাসী ছিলেন না। এই সব গুণের কারণেই তিনি বাংলাদেশের উলামায়ে কেরাম ও সর্বসাধারণের নিকট একজন জনপ্রিয় ও অতি সম্মানিত ব্যক্তি হয়েছেন। শুধু বাংলাদেশে নয়, বিদেশেও তাঁর খ্যাতি আছে। তিনি অর্ধ শতাব্দীর কর্মমুখর সফল জীবনে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা ও প্রতিষ্ঠান দ্বারা বিশেষ বিশেষ সম্মানে ভূষিত হয়েছেন। সৌদি আরবের রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ মতাসম্পন্ন তত্ত্বাবধায়ক প্রতিষ্ঠান মজলিসে শুরা তাঁকে আমন্ত্রণ জানিয়ে স্বর্ণপদক প্রদান করেছে। জাতীয় সীরাত কমিটি বাংলাদেশ তাঁকে ২০০৪ খ্রিস্টাব্দে বছরের সেরা ইসলামী ব্যক্তিত্ব নির্বাচিত করে স্বর্ণপদক প্রদান করেছে। পবিত্র কুরআন ও হাদীসের শিকতায় বিশেষ অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ তাঁকে কোরআন শিক্ষা সোসাইটি ২০০৫ খ্রিস্টাব্দে নগদ পঞ্চাশ হাজার টাকা ও বিশেষ এ্যাওয়ার্ড প্রদান করে। হোফফাজুল কুরআন ফাউণ্ডেশন বাংলাদেশ জাতীয় পর্যায়ে বিভিন্ন বিষয়ে অবদানের স্বীকৃতি হিসাবে বিশেষ পদকে ভূষিত করে। এছাড়া তিনি আরো অনেক দেশী ও বিদেশী সংস্থা থেকে সম্মানজনক সনদ, ক্রেস্ট, পদক ও খেতাব লাভ করেছিলেন।
বায়তুল মোকাররমে খতিব সাহেবের জীবনের শেষ খুতবাবায়তুল মোকাররমে খতিব মাওলানা উবায়দুল হক শেষ জুম্মার খুতবা দিলেন ৫ অক্টোবর ০৭। কিন্তু সেদিন কে জানতো এটা তাঁর জীবনের শেষ খুতবা? অথচ সেদিন তিনি তাঁর খুতবায় বার বার বলেছ-‘আমার মনে হচ্ছে আজ জুম্মাতুল বিদা। কিন্তু আগামী জুম্মা হচ্ছে জুম্মাতুল বিদা।’ খতিব মাওলানা উবায়দুল হক তাঁর জীবনের শেষ খুতবায় আরো বলেন- ‘ব্যাংকে টাকা রেখে সুদ গ্রহণ করা হারাম। আর সুদ খাওয়া ব্যবিচারের চেয়েও বড় অপরাধ। হারাম উপার্জনে গঠিত রক্ত-মাংসের জন্য জাহান্নাম অবধারিত। তাদের জাকাত, ফিতরা, হজ্ব সহ কোন ইবাদতই কবুল হবে না।’ ব্যাংকের সুদ গ্রহণ এবং হারাম উপার্জন থেকে বেঁচে থাকার জন্য তিনি সকলের প্রতি আহ্বান জানান। খতিব আরো বলেন- ‘জুম্মা হলো সপ্তাহের প্রধান দিবস। এ দিবসে আল্লাহ দোয়া কবুল করে থাকেন। আর জুম্মার দিনে হযরত রাসুল (স.)এর উপর দুরূদ পাঠ করলে সত্তর গুণ বেশি সোয়াব হয়ে থাকে। তাই জুম্মার দিন বেশি বেশি ইবাদত করা দরকার। আর রমজান মাসে এমন একটি রাত রয়েছে যা হাজার মাস তথা ৮৬ বছর ৪ মাসের চেয়েও উত্তম। ভাগ্য নির্ধারণ করা হয় বলে এ রাতকে লাইলাতুল ক্বদর বলা হয়। এ রাতে ইবাদত করলে হাজার বছর তথা ৮৬ বছর চার মাস ইবাদত করার চেয়েও বেশি সোয়াব হবে। লাইলাতুল ক্বদর নির্দ্দিষ্ট করে বলা হয়নি বিধায় হযরত রাসুল (স.) রমজানের শেষ দশদিন ইতেকাফের মাধ্যমে লাইলাতুল ক্বদর তালাশ করতেন। তিনি আরো বলেছেনÑ ‘সদকাতুল ফিতরা ও সম্পদের যাকাত আদায় করা জরুরী। যারা সম্পদের যাকাত আদায় করে না, এই সম্পদ কিয়ামতের দিন আগুন হয়ে তাদেরকে শাস্তি দেবে। আর যারা নামাজ পড়ে, হজ্ব পালন করে, আবার সুদও খায় তাদের ইবাদত আল্লাহ কবুল করবেন না। সুদ ব্যভিচারের চেয়ে বড় অপরাধ। আর হারাম খাদ্য দ্বারা গঠিত রক্ত-মাংস বেহেশতে যাবে না। তাই হারাম উপার্জন থেকে বেঁচে থাকা সকলের জন্য জরুরী।’ ( দৈনিক সংগ্রাম, শনিবার, ৬ অক্টোবর ০৭)।
খতিব সাহেবের সাথে আমার শেষ কথা-বার্তা
প্রায় বছর দিন থেকে বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা (বাসস)-এর সিলেট
প্রতিনিধি গল্পকার সেলিম আউয়াল আমাকে বলছেন খতিব সাহেবের একটি সাক্ষাৎ গ্রহণের
জন্য। খতিব সাহেব থাকেন ঢাকায় আর আমরা থাকি সিলেটে। তিনি সিলেট এলে মাঝে মধ্যে আমার সাথে দেখা হলেও সেলিম
ভাইয়ের সমন্বয়ে আমি আর তিনির মুখোমুখি হতে পারছিলাম না। এভাবে সময় চলে যায় বছর দিন। ১৩ আগস্ট২০০৭ তিনি যখন সিলেট দরগাহ মাদ্রাসার খতমে বোখারী
উপলে সিলেট আসেন, তখন এই সন্ধায় সেলিম ভাইকে নিয়ে হাজির
হই সিলেট শহরস্থ তাঁর মিতালী রোডের দশ নম্বার বাসায়। তাঁর সাথে অতীতে আমার অনেক কথা হয়েছে পারিবারিক থেকে
সামাজিক, রাজনৈতিক, মাসআলাগত, আলেমদের ঐক্য-অনৈক্য ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ে। কোনদিন তিনি আমার প্রতি ক্ষুব্ধতা প্রকাশ করেননি। এমনকী তাঁর অনেক ক্ষুব্ধ সময়ে আমি মুখোমুখি হয়ে দেখেছি তিনি
আমার কাছে ক্ষুব্ধতার কারণ ব্যাখ্যা দিয়ে শান্ত হওয়ার অভিনয় করেছেন। কিন্তু আজকের সাক্ষাৎকারের বিষয় তাঁর আত্মজীবনী শুনে প্রথমে
ক্ষুব্ধ হয়ে বললেন- ‘আমি আত্মপ্রচার চাই না। রাখেন এই সব ফাইজলামি।’সেলিম ভাই রিতিমতো কেঁপে উঠলেন। আমি খতিব সাহেবকে ভালো রকম জানি। কি ভাবে তাঁকে কাবুতে আনতে হবে সেই কৌশলও কিছুটা আমার
আয়ত্বে আছে। আমার একটা দৃঢ় বিশ্বাস তিনি আমাকে খুব
করেন, স্নেহ করেন, ভালোবাসেন। আমি এই সম্বল নিয়ে মুখের উপর বলে বসলাম- আপনাকে আত্ম প্রচার
করতে আমরা বলছি না, কিন্তু আপনার অভিজ্ঞতার ভেতর এমন কিছু
ঘটনাও যে আছে যা দেশ-জাতি এবং আগামি প্রজন্মের জন্য জানা খুবই জরুরী। এই স্বার্থে উচিৎ ছিলো আপনার নিজের আত্মজীবনী লিখে যাওয়া। কিন্তু তাতো করবেন না। এখন আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি আপনি সিলেট আসলেই আমরা এসে হাজির
হবো এবং প্রশ্ন করে করে ভেতর থেকে কথা বের করে রেকর্ড করবো। আপনি সময় না দিলেও আমরা সময় আদায় করে নেবো। তিনি হাসলেন আমার কথা শোনে। হাসলাম আমি এবং সেলিম ভাইও। অনুমতি পেয়ে আমি টি টেবিলটা টেনে একেবারে তাঁর মুখোমুখি
হাটুতে হাটু লাগিয়ে টেপরেকর্ডার নিয়ে বসে প্রশ্ন শুরু করি-আপনি কওমী মাদ্রাসায়
পড়তে গেলেন কি ভাবে, আপনার লেখা-পড়ার উদ্দেশ্য কি ছিলো? খতিব সাহেব-আমার পিতা হলেন দারুল উলূম দেওবন্দের ছাত্র। তিনি দেশে পড়ছেন বিভিন্ন মাদ্রাসায়। ঢাকার পরসিদ্ধ মাদ্রাসা ছিলো ভিক্টোরিয়া পার্কের ইখানে, পরে এইটার নাম হইছে ইসলামিক ইন্টারমেইটেড কলেজ, কিন্তু আগে নাম ছিলো তার অন্য। পরথমে এই মাদ্রাসা পাশ করছেন পরে তিনি দেওবন্দ গেছেন। তিনি সাহরানপুরও কিছু পড়ছেন। তবে দেওবন্দ পড়ছেন দওরায়ে হাদিস। উপমহাদেশের পরসিদ্ধ মুহাদ্দিস সৈয়দ আনোয়ার শাহ কাশ্মিরী (র.)
তিনির বিশেষ উস্তাদ। এর পরে সেখান থেকে তিনি থানাবন যান। ওখানে হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানবী (র.)-এর খেদমতে থাকেন, বয়আত হন, এরপরে দেশে ফিরিয়া আসেন। ফিরিয়া আসিয়া (আমরা শোনছি, আমাদের
জন্মের আগেরই কথা হইবে) তিনি ঢাকা ক্বাসিমুল উলূম নামী মাদ্রাসা, মাওলানা মুফতি দীন মুহাম্মদ সাহেব যেটা পরতিষ্টিত করেছিলেন
বেগম বাজার মসজিদ সংলগ্ন, ঐটায় কিছুদিন পড়াইছেন। এরপরে মুফতি দীন মুহাম্মদ সাহেব গেলেনগি বরমায়, মাদ্রাসায় কিছু অনিয়ম দেখা দিলো। তখন বাড়িতে আসিয়া পড়লেন। এই সময় কিছু ছাত্রও উনার কাছে আসিয়া ভিড়লো পড়বার জন্য। তাদেরে পেরাইভেট পড়াইতেন গ্রামের মসজিদের বারান্দায়। এই ছিলো পরথম উনার মাদরাসা। এরপরে মসজিদের দণি পাশে একটা ছন-বাঁশের ঘর তৈয়ার করলেন, বাইরের ছাত্ররা থাকার জন্য। ঐ সময় আমরার কিছু সুদবুদ হইছে, ওনিই পড়াইছেন আমাদেরকে। ঐ মসজিদে থাকিয়াই আমরা কোরআন শরিফ পড়ছি। এরপরে উর্দু, ফার্সি পারথমিক
কিতাবাদি কিছু পড়ছি। একবার আমাকে পাঠশালা ইস্কুল, বাবুর বাড়ি, নিজ গ্রাম, বারঠাকুরী সংলগ্ন, ওখানে পাঠাইলেন
এবং বললেন যে,
তুমি ইস্কুলে কিছু পড়, পারথমিক শিা লাভ
করো। আমি ঐখানে গেলাম। বাবুর বাড়ির ইস্কুল, মাষ্টার-শিক
তারা খুবই মেধাবি এবং যোগ্য কিন্তু তাদের আচরণ ছিলো হিন্দুয়ানী। যেমন, সালামের জায়গায় আদাব, মাথা নত করা ইত্যাদি আমার পছন্দ লাগলো না। আসিয়া আব্বাকে বললাম যে, ঐখানেতো সালাম-সুলামের
নিয়ম নাই, শুধু আদাব-উদাব এইসব কথা-বার্তা। আমারতো ইচ্ছা করে না যাইতে। তিনি বললেন-তবে আর যাইয়ো না। ঐ শেষ আমার ইস্কুলের পড়া। দু-একদিন মনে হয় গেছিলাম, এরপরে আর
না। আরো কিছু আব্বার কাছে পড়ার পর বয়স যখন আট-দশ কিংবা এগারো
বছর হয়েছে তখন আমাকে পাঠাইদিলেন ঘুংগাদি, মাওলানা আতহার
আলী সাহেবের বাড়িতে একটি মাদ্রাসা ছিলো। মবনু- এটা কোথায়? খতিব-ঘুংগাদি
হইলো বিয়ানিবাজার। ঐখানে বড় ভালো শিক একজন ছিলেন
শাহবাগের মাওলানা শামসুল হক (র.)। উনার কাছে
ফার্সি, মিজান-মনশাইব পারথমিক কিতাব কিছু পড়লাম। পড়ে আবার গেলামগি বাড়িতে। সেখানে আর আসা-যাওয়া দীর্ঘায়িত হইলো না। এক-দু বছর হয়তো ছিলাম। বাড়িতে গিয়া কিছু পারথমিক (সরকারি মাদরাসা নয়, প্রাইভেট পড়াইছেন) অর্থাৎ দরজায়ে ছুওম পর্যন্ত আব্বার কাছে
পড়লাম। পরে পড়ার প্রতি অমনযোগি হইয়া পড়লাম। শুধু অনুপস্থিত, আর এদিকে সেদিকে
চলাফেরা। পড়ার দিকে অমনযোগী। আব্বা অন্য মাধ্যমে জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কি করতে চাও, কারবার করলে
দোকান করে দিয়া দেই, আর তে-কৃষি করলে হাল খরিদ করে দিয়া
দেই, আর পড়বার হইলে পড়ো- একটা কিছু করোতো? আমি তখন আব্বার পরতিনিধির কাছে উত্তর দিলাম-পড়তে চাই, কিন্তু দেশে পড়বো না। দেওবন্দ যাইতে চাই। তখন আব্বা রাজি হইলেন এবং গঙ্গাজলের জনাব মাওলানা আব্দুর
রজাক সাব(ওনি মারা গেছেন)-এর সাথে আমাকে দেওবন্দ পাঠাইয়া দিলেন। ঐ সময় আমাদের গ্রামের একজন ছিলেন মাওলানা আব্দুর রকিব সাব (ওনি
জীবিত আছেন এখনও, বর্তমানে আছে তিনি ঢাকা মীরপুরে) ওনি
পড়তেন দেওবন্দে উপরের কাসে। উনার
তত্ত্ববধান কিংবা নেগরানিতে আমাকে দেওবন্দ থাকতে বলিয়া দিলেন। মবনুÑতখন আপনি কোন কাসে পড়েন?খতিবÑ ঐ কাস ছুওম থাকি গেলাম পড়িয়া। পরীা দিয়া ঐখানে এই জামাতে আবার ভর্তি হইলাম।মবনুÑনা, আমি
বলছিলাম কি,
অনেকে লিখেছেন কাফিয়ার জামাতের কথা?খতিবÑ হইছে, এই কাস
ছুওমকেই কাফিয়া বলা হয়। কাফিয়া গিয়া পরীা দিলাম, আবার ঐ জামাতে পড়তে হইলো আমার। প্রমোশন পাইলাম না পরথম ভর্তি পরিায়। গেছি আমি মনে হয় ৪২/ ৪৩ সনে। এরপর ধারাবাহিক লেখা-পড়া করে দাওরা হাদিস এবং এরপর আরো কিছু
অতিরিক্ত লেখা-পড়া করিয়া ১৯৫০-এ আমি ঢাকা বড়কাটরা মাদ্রাসায় ফিরিয়া আসি শিকতার
জন্য। এই হইলো আমার পড়ার জিন্দেগী। আমি কেনো পড়লাম এইটাতো আপনারা বুঝলেনই। মবনুÑআপনার ছাত্র জীবনে দারুল ঊলূম
দেওবন্দে মাওলানা সৈয়দ হোসেন আহমদ মাদানি সহ এমন আরো কিছু শিক ছিলেন যারা
ভারতবর্ষের রাজনীতিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছেন।খতিব-হাঁ।সেলিম
আউয়াল-আচ্ছা,
একটা প্রশ্ন হলো-এই যে মাদ্রাসার পরিবেশ, ঐ সময়ে দারুল ঊলূম দেওবন্দের যে পারিপার্শ্বিকতা ইত্যাদি
জানতে পারলে ভালো হতো।খতিব- পারিপার্শ্বিকতা কি বলবো? যে পারিপার্শ্বিকতা সাধারণত...সেলিম আউয়াল- যেমন আলীগর
বিশ্ববিদ্যালয় এবং দারুল ঊলূম দেওবন্দের অবস্থা? মবনু-সেলিম
ভাই বলতে চাচ্ছেন, আলীগড়, দেওবন্দ
এবং নাদওয়ার মধ্যে পরিবেশগত ভিন্নতা কিংবা অভিন্নতার কথা?খতিবÑ আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয় হলো সাধারণ
শিক্ষার প্রধান্যতার মাধ্যমে একটা উচ্চশিক্ষার পরতিষ্ঠান। আর দারুল উলূম দেওবন্দে সাধারণ শিক্ষার কোন স্থান ছিলো না। এইখানে শুধু ইসলামি শিক্ষার, আরবি
শিক্ষার, হাদিস ও কোরআনের শিক্ষা ইংরেজি বা সাধারণ বিষয়ের কোন
সাবজেক্ট দারুল উলূম দেওবন্দে ছিলো না। আর নদওয়া
হলো ভিন্ন ধরনের একটা পরতিষ্ঠান। এইটার
সঙ্গে দারুল উলূম দেওবন্দের আলেম, শিক্ষক, পরিচালকদের
বন্ধুত্বমূলক একটা সম্পর্ক ছিলো। কিন্তু
শিক্ষানীতি ছিলো ভিন্ন। নদওয়ার শিক্ষানীতি ছিলো সাধারণ শিক্ষা
আর আরবি শিক্ষার মধ্যে সমন্বয় করে একসাথে চালিয়ে যাওয়া। এই জন্য তাদের শিক্ষার পদ্ধতি দেওবন্দের শিক্ষা পদ্ধতির
তুলনায় ভিন্ন। দেওবন্দের শিক্ষা ছিলো খাটি কোরআন-হাদিস-ফেকাহ
এবং আনুষাঙ্গিক বিষয়াদি। মবনু- কোলকাতা আলিয়া মাদ্রাসা আর নদওয়ার
মধ্যে ব্যবধান কি?খতিব-কলকাতা আলিয়া মাদরাসাতো বহু আগে
কায়েম হইছে। (কিছুণ চিন্তা
করেন) মনে হয় ১৭৮১ সালে আর দারুল উলূম দেওবন্দ ১৮ শতকের শেষদিকে, প্রায় একশ বছরের ব্যবধান আর নদওয়া হলো এর আরো পঞ্চাশ বছর
পরে। কলকাতা আলিয়া মাদরাসার মধ্যে বহু পরিবর্তন-পরিবর্ধন হয়েছে
বিভিন্ন সময়। পরথম অবস্থায় ঐ মাদরাসায় কোরআন-হাদিসের
পরধান্যতা ছিলো। আর শিক্ষক ছিলেন দারুল উলূম দেওবন্দের
শিকদের সূত্র যে দিকে অর্থাৎ শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী (র.) একজন শাগরিদ
মুল্লা মদন (র.), যার কিছু ভক্ত কলকাতায় ছিলেন, তারা তাঁকে এখানে নিয়ে আসলো। এরপর উনার নামে কিছু ভক্-ছাত্র জমা হইলো। প্রাইভেট, সেখানে থাকতেন এবং পড়াইতেন। কিছুদিনের মধ্যে সাড়া পড়ে গেলো কলকাতা শহরের বড় বড় ব্যবসায়ি
এবং ইসলামিক চিন্তাবিদদের মধ্যে। তারা
ভাবতে লাগলেন-আমাদের এত বড় শহর, রাজধানী, (তখন কলকাতা ছিলো ইংরেজদের রাজধানী শহর) অথচ একটা দ্বীনি
পরতিষ্ঠান নাই। আমরা একটা পরতিষ্ঠান করিয়া লইবো
মুল্লা মদনকে সামনে রাখিয়া এবং আরো কিছু শিক নিয়া। এটা নিজের থেকে একাকি করার সাহস না পেয়ে তারা ইংরেজ
গভর্ণরের কাছে একটা পরতিনিধি দল গিয়ে বলল-আমরা এই রকম একটা শিক্ষা পরতিষ্ঠান করতে
চাই, আপনারা কি সহযোগিতা করবেন? গভর্ণরকে
তারা বিভিন্ন যুক্তি দেখাইলেন, গভর্ণর তাদের যুক্তিতে আকৃষ্ট হইয়া
বললো-ঠিক আছে করেন। সে প্রাইভেট একটা জায়গা দিয়ে দিলো, তার কোন এক বিল্ডিং এ, এবং বললো-এইখানে
পড়ানোর ব্যবস্থা করেন আর আমি মাসিক এত টাকা দিয়ে সাহায্য করবো, বাকি আপনারা যোগাড় করেন। এই চালু হইয়া গেলো মাদরাসা। এটা লেখা আছে ‘তারিখে
মাদরাসায়ে আলিয়া’য়। এটা সিলেট আলিয়া মাদরাসাতেও পাইবেন, উর্দুও আছে, বাংলাও হয়ে গেছে। উর্দুটা লিখছেন মাওলানা আব্দুস সত্তার। তিনি আলিয়া মাদরাসার একজন লেকচারার ছিলেন, খুব ভালো মানুষ ছিলেন। এতটুকু আলোচনার পরই ভেতরের ঘর থেকে কিছুণ আগে তাঁর ছোট্ট
নাতিনের দিয়ে যাওয়া চা-নাস্তার দিকে ইশারা করে বললেন-‘এখন রাখো তোমার এই সব, আগে খাও, তারপর কথা।’ আমি আর সেলিম
ভাই কথা না এগিয়ে খেতে শুরু করি। তিনি নিজ
হাতে আমাদের দিকে চা-নাস্তা এগিয়ে দিতে থাকেন। তাঁর মেহমানদারিতে নিরহংকার একজন মানুষের প্রতিচ্ছবি
বারংবার প্রস্ফূটিত হয়ে উঠছিলো। নাস্তা
পর্ব শেষে সেলিম ভাই আবার কথা শুরু করেন. আমি বলছিলাম কি-সেই সময় শিক্ষার যে
পরিবেশটা ছিলো,
যেমন আমরা জানি হিন্দুদের ঠুল ছিলো, স্কুলের শিক্ষার একটা পরিবেশ ছিলো, বৌদ্ধদের বিহারের একটা পরিবেশ ছিলো, নিশ্চয় এসব থেকে দেওবন্দের পৃথক একটা পরিবেশ ছিলো, অনেক মানুষের জানার আগ্রহ রয়েছে দেওবন্দের পরিবেশ সম্পর্কে, যেমন ছাত্ররা বসতেন কী ভাবে, ছাত্র-শিকের
সম্পর্ক কেমন ছিলো, আজকের ছাত্র-শিকের সম্পর্কের সাথে
দেওবন্দের ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্কের মধ্যে ব্যবধান কতটুকু, ইত্যাদি আমরা একটু জানতে চেয়েছি? মবনু-এই জিনিষটাই আমি আগে বলেছিলাম, আপনার সময়ে যারা দেওবন্দের শিক ছিলেন তারা ভারতবর্ষের
রাজনীতিতে খুব প্রভাবশালী ছিলেন, সেই সময়ের পরিবেশ?খতিব-এই ধারণাটা ভুল, যা তুমি বলতেছো। দারুল ঊলূম দেওবন্দের শিকগণ সাধারণভাবে রাজনীতি করতেন না। রাজনীতিতে ছিলেন আমাদের সময়ে কিংবা পরে মাওলানা হোসেন আহমদ
মাদানি, ওনি ছিলেন সদরে মুদাররিস (প্রধান শিক্ষক) এবং আধ্যাত্মিক
তরিকতের শেখ,
একজন বড় মুসলেহ। এই জন্য
অন্যান্য ছাত্র-শিকরা উনার খুব ভক্ত ছিলেন। আর ওনি কোনদিন ছাত্র-শিক্ষকদেরকে রাজনীতিতে যাওয়ার জন্য
উদ্বুদ্ধ করতেন না। বরং অনেক সময় বলতেন আমিতো আমার
উস্তাদের কারণে অর্থাৎ শায়খুল হিন্দ হযরত মাওলানা মাহমুদুল হাসান দেওবন্দি (র.) এর
সঙ্গে থাকিয়া অঙ্গিকারবদ্ধ হয়ে গেছি যে হিন্দুস্তানের মুসলমানদের মুক্তির পথে
রাজনীতি করবো। তবে তোমরা আগে পড়া-লেখা করো, এরপর যার যে দিকে ইচ্ছা রাজনীতিতে যাইবা। তিনি প্রায়ই এই কথা বলতেন। কিন্তু ভক্তি করে সাধারণ ছাত্র এবং অধিকাংশ শিক উনার
অনুসারি ছিলেন। কিন্তু তবু তারা সরাসরি রাজনীতিতে অংশ
গ্রহণ করতেন না। আমিতো আট বছরের মতো রয়েছি দেওবন্দ। জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, যেটার সদর (সভাপতি
বা আমীর) ছিলেন মাওলানা হোসেন আহমদ মাদানি (র.), এইটার বড়
বড় মিটিং হইলে দিল্লি, সাহরানপুর কিংবা অন্য স্থানে, ছাত্ররা নিজ ইচ্ছায় গিয়া সামিল হইতো। তিনি কোনদিন বলতেন না যে, তোমরা
যাইও। আমরাও গিয়েছি স্বইচ্ছায়। আর অন্যান্য শিকেরা রাজনীতির কোন চিহ্নিত দায়িত্ব গ্রহণ
করেন নাই। ভক্তি হিসাবে মাওলানা হোসেন আহমদ
মাদানির সংস্পর্শে যাইতেন, বসতেন, কথা-বার্তা
শোনতেন। দারুল উলূম দেওবন্দ রাজনীতিতে পরসিদ্ধ
হয়েছে একতো মাওলানা মাহমুদুল হাসান (র.)এর কারণে, এরপরে
উনার শাগরিদ মাওলানা হোসেন আহমদ মাদানি (র.)এর কারণে। মাওলানা হোসেন মাদানি (র.)এর ইন্তেকালের পর আর কোন নেতা নাই
দারুল উলূম দেওবন্দে। শিকদের মধ্যে কোন নেতা অগ্রগামি হয়নাই
যে রাজনীতি করবেন। ভালোবাসা ভিন্ন কথা, বিভিন্ন শিকেরা কিংবা প্রায় সকল শিক জমিয়তে উলামায়ে হিন্দকে
ভালোবাসতেন,
কিন্তু সক্রিয় রাজনীতিতে কেউ ছিলেন না। তাবে মাওলানা হোসেন আহমদ মাদানির সাহেবজাদা মাওলানা আসআদ
মাদানি, যার ইন্তেকাল গত বছর হয়েছে, তিনি
রাজনীতি করতেন। ওনি পরথম জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের সহ-সভাপতি, তারপরে আজীবন সভাপতি ছিলেন। তিনিও বাপের নীতি অনুসরণ করে মাদরাসার ছাত্র শিকদেরকে
রাজনীতি করার প্রতি উদ্বুদ্ধ করেননি। তবে ভক্তি, শ্রদ্ধা, মতের মিল হিসেবে ছাত্রÑশিকরা সামিল হইলে হইছে। মবনু-তা হলে দারুল উলূম দেওবন্দ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যটা কি
ছিলো? খতিবÑ পরতিষ্ঠার মূল উদ্দেশ্যতো ছিলো কোরআন-হাদিসের
শিক্ষকেরা করা। ১৮৫৭-এর বিপ্লবের পর বৃটিশ যখন গোটা
ইন্ডিয়াকে দখলে নিয়ে নিলো তখন তারা পরিকল্পনা গ্রহণ করলো এই দেশের ছেলে-মেয়েদেরকে
পশ্চিমা শিায় শিতি করে খ্রিস্টান বানানোর। এই পরিকল্পনা যখন মুসলমানদের মধ্যে জানাজানি হয় তখনই ১৮৫৭এর
যুদ্ধের নয় বৎসর পর মাওলানা কাসেম নানতুবি এবং তাঁর সঙ্গি-সাথিরা কয়েকজনে মিলে
দেওবন্দে দারুল উলূম পরতিষ্ঠা করেন। পরথম
উদ্দেশ্য হলো ইংরেজরা যে এইখানে ইসলাম এবং ইসলামি শিক্ষা মিটাতে চায় এইটার
প্রতিরোধ কায়েম করা। আর দ্বিতীয় উদ্দেশ্য ছিলো-এই প্রতিরোধ
কায়েম করার মাধ্যমে ভারত উপমহাদেশের মুসলমানদের মধ্যে আবার এমন একটি জাগরণ সৃষ্টি
করা যা দিয়ে এই দেশ থেকে বৃটিশকে তাড়িয়ে স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা করা যায়। সেলিম আউয়াল-আমি জানতে পেরেছিলাম যে, আপনি মিশরের আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখা-পড়া করেছেন? খতিব-একদিনও না। তবে
বেড়াইতে গেছি,
দেখতে গেছি। সেলিম
আউয়াল-৫৪এর যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনের সময় আপনি জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের সাথে ছিলেন
না নেজামে ইসলামীর সাথে ছিলেন? খতিব-নেজামে ইসলাম পার্টির সাথে ছিলাম, তবে তখনও নেজামে ইসলাম পার্টির আসল নামকরণ হয় নাই, তখন নাম ছিলো জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম। তখন আমি বাচ্চা মানুষ ছিলাম, তবে তাদের
সাথে সহযোগী ছিলাম। মাওলানা আতহার আলী সাহেব ছিলেন জমিয়তে
উলামায়ে ইসলামের সেলিম আউয়াল-সিলেটের আতহার আলী সাহেব কি? খতিব- হাঁ, সিলেটের। তবে থাকতেন তিনি কিশোরগঞ্জে। তিনি ছিলেন জমিয়তে উলামায়ে উসলামের সভাপতি। মবনুÑআপনি জমিয়তের প্রচার সম্পাদকের
দায়িত্বে ছিলেন কোন সময়ে? খতিব-এই সময়ে, অর্থাৎ ৫১ থেকে ৫৪ সন।সেলিম আউয়াল-যুক্তফ্রন্টের সময় মাওলানা আতহার আলী সাহেব
মন্ত্রীসভায় ছিলেন কি না? খতিব- না, না, তিনি মন্ত্রি হন নাই। তবে তিনি প্রভাবশালী নেতা ছিলেন, মন্ত্রী বানিয়েছেন কয়েকজনকে। যেমন, আশরাফুদ্দিন চৌধুরী, চট্টগ্রামের মশহুর পাল্টামেন্টিসিয়ান ফরিদ উদ্দিন এবং নুরুল
হক চৌধুরী প্রমুখদেরকে মন্ত্রী বানিয়েছেন তিনি। তবে নিজে মন্ত্রি হন নাই।সেলিম আউয়াল-তা হলে আপনি যুক্তফ্রন্টের পক্ষে নির্বচনী
প্রচারে অংশ নিয়েছিলেন? খতিব- না, আমি অংশ নিতে পারি নাই, তখন আমি করাচিতে
ছিলাম। তবে ঐখান থেকে তাদের পে বয়ান পত্র-পত্রিকায় প্রচার করে
কিছুটা অংশ নিয়েছি। সেলিম আউয়াল-পরবর্তিতে আপনি জমিয়তে
উলামায়ে ইসলামের আর কোন দায়িত্ব পালন করেছেন কি না? খতিব- না, কোন দায়িত্ব ছিলো না। আমি এমনি অনারারি সদস্য ছিলাম জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের। তবে নথিতে আমাকে আর সদস্য হিসেবেও লিপিবদ্ধ করা হয়নি। মবনু-তা হলে রাজনীতির সাথে সক্রিয় কখনো জড়িত ছিলেন না? খতিব- জি না। সেলিম
আউয়াল- আপনি বায়তুল মোকাররমের খতিব কখন থেকে? খতিব- (কিছুটা
মুচকি হেসে ধমক দিয়ে) সবতা আমারে জিগাইতায়নি, কিছুটা নিজেরা
পড়িয়া সংগ্রহ করেন কোনদিন থাকি হইছি। এইটা
জিগাইয়া নিবেন ইসলামিক ফান্ডেশনের ডিজি বা ডাইরেক্টর সাহেবকে। আমি এতসব প্রচার করতে পারবো না।সেলিম আউয়াল-ঠিক আছে, আমরা অন্য বিষয়ে
চলে যাই, আমি জানতে চেয়েছিলাম হযরত হাফেজ্জী হুজুর সম্পর্কে? মবনু-শুনেছি, হযরত হাফেজ্জী
হুজুর আপনার পির সাহেব ছিলেন? খতিব- পির সাহেব নয়, আবার পির সাহেবও। উনাকে আমি ভক্তি করতাম, কারণ আমার আব্বা
এবং হাফেজ্জী হুজুর ছিলেন হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানবী (র.) মুরিদ এবং খলিফা। উনাদের সম্পর্ক ছিলো সেই থানাবন থেকেই। এই হিসেবে উনাকে মুরুব্বী মানতাম। যেমন মাওলানা আতহার আলী সাহেবকে মুরুব্বী মানতাম, তেমনি হাফেজ্জী হুজুরকে। মাওলানা আতহার আলী সাহেব ইন্তেকাল করে ফেললেন বাংলাদেশ
হওয়ার তিনÑচার বছর পর। পরে
হাফেজ্জী হুজুর ছিলেন। হাফেজ্জী হুজুরের সঙ্গে আমার
ব্যক্তিগত খুবই ঘষ্টি সম্পর্ক ছিলো। তিনিও
মহব্বত করতেন,
আমিও উনার মজলিশে যাইতাম। বিভিন্ন ব্যাপারে উনি আমার কাছে মাতমত চাইতেন মশওয়ারা
হিসাবে। আমি মতামত দিতাম। কোন সময় উনার মতের পে আমার মত হইতো, আর কোন সময় আমি শক্তভাবে বিরোধীতা করেছি। এই বিরোধীতার পরও তিনি এই কথা মানতেন না, অন্যান্য লোকের কথায় চলতেন কিন্তু তবু মূল্যায়ন করতেন। যেমন ইরানের দাওয়াত গ্রহণ করা আর যাওয়া। আমি খুব প্রতিবাদ করছি, নিষেধ করছি যে, যাইয়েন না, গেলে আপনি বদনামি হইবেন, আপনার দল বদনামি হইবো, সবকিছু লণ্ড-ভণ্ড
হইযাইবো। কিন্তু উনারে বুঝাইছে অন্যরা যে আপনি
যাইবেন একজন বিচারক হিসাবে, দুই দেশের মধ্যে যে লড়াই হচ্ছে এই
লড়াই বন্ধ করার চেষ্টা করাতো ইসলামের দৃষ্টিতে জরুরী। আপনি ছাড়া পৃথিবীতে আর কোন ব্যক্তি নাই যে এই দুই শক্তির
মধ্যকার যুদ্ধ থামাতে মধ্যস্ততা করতে পারে। আপনি মধ্যস্ততা করুন। এই যুক্তি দিয়া তারা উনাকে ইরানে যাওয়ার জন্য উদ্ভুদ্ধ করছে
বেশি। আমি উনাকে বলছি যে এই যুক্তি ঠিক নয় এই জন্য যে তারা আপনাকে
সমঝোতাকারি হিসাবে দাওয়াত করেনি যে আপনি গিয়ে সমঝোতা করেন। আর নিজের থেকে বললে এই কথার কোন মূল্য হয় না। ওনির যাওয়াটায় তি হইছে, ফায়দা হয়নি। উনার খেলাফত আন্দোলন এই কারণে ভেঙে গেছে। এই রকমের বিভিন্ন ব্যাপারে আমার সঙ্গে আলোচনা হইতো, আমিও করতাম। এরপর তিনি
কী ভাবে দেশে আন্দোলন চালাইয়া যাইবেন, এই ব্যাপারেও
আলোচনা করতেন। উনাকে জিজ্ঞাসা করা হইতোÑআপনি প্রেসিডেন্ট হইলে কি করবেন? তিনি বলতেনÑ৬৪ হাজার গ্রামে ৬৪ হাজারটি কোরআনিক
মক্তব কায়েম করবো। আমি বলতাম এইটা খুব ভালো আপনার
পরিকল্পনা। এইটা নিয়ে তিনি অনেকদিন আলোচনা, সমালোচনা, গবেষণা করছেন এবং ভাবছেন যে, মতায় আসতে পারলে এই কাজটা করবেন। এই রকমের বিভিন্ন চিন্তা ছিলো তাঁর ভেতরে। হাফেজ্জী হুজুর আগে পলিটিক্স করতেন না। হঠাৎ করিয়া তিনি ৭৫ সালের পরে আস্তে আস্তে সিয়াসতে (রাজনীতিতে)
যোগদান করতে শুরু করলেন। লোকে তাঁকে জিজ্ঞাস করতোÑহুজুর আপনিতো রাজনীতি করতেন না, বরং এইটাকে নাপছন্দ করতেন। হঠাৎ করে রাজনীতিতে আসলেন কেনো? আমরা জানতামÑআপনি রাজনীতিকে
না জায়েয মনে করেন? তখন তিনি বললেনÑতুমরা ভুল বুঝেছো। করছি না রাজনীতি এইটা ঠিক, কিন্তু
রাজনীতিকে আমি নাজায়েয কিংবা নাপছন্দ করতাম এইটা ভুল। তখন রাজনীতির মাঠে ছিলেন মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরী (র.), মাওলানা মুফতি দীন মুহাম্মদ, মাওলানা
আতহার আলী,
মাওলানা সিদ্দিক আহমদ প্রমুখ বড় বড় লোক, তারা আমার সঙ্গি, তাঁরা আমাকে
মহ্বত করতেন,
আমিও তাদেরকে মহ্বত করি, তারা ছিলো যোগ্য
আর মাঠে কাজ করতে ছিলো, আমি দেখছি আমার আর দরকার নেই মাঠে
যাওয়ার, আমি মাদ্রাসা নিয়া থাকলেই চলবে। উনারা রাজনীতি করুক মাঠে-ময়দানে। এই হিসাবে আমি দূরে রইছি। কিন্তু এখন উনাদের মধ্যে কেউ নাই, সব চলিয়া গেছে, মারা গেছে, এখন আমিও যদি মাঠে থেকে দূরে থাকি তবে ইসলামি আন্দোলনের
চেরাগ নিভিয়া যাইবে। কোন সাড়া-শব্দ থাকবে না। এই জন্য আমি চিন্ত-ভাবনা করিয়া মাঠে আসছি। হাফেজ্জী হুজুর এই যুক্তি দিতেন এবং এইটা আমাদের কাছেও বড়
যুক্তি সম্মত মনে হইতো। সেলিম আউয়াল-জামাতে ইসলামি বাংলাদেশের
বর্তমান আমীর মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী আপনার ছাত্র ছিলেন?খতিব সাহেব- হাঁ, আলিয়া মাদ্রাসার
শত শত, হাজার হাজার ছাত্রের মধ্যে তিনিও একজন ছাত্র। তিনি লজিং না কোথায় থাকতেন, মাঝে-মধ্যে
এসে দেখা করতেন,
তবে ব্যক্তিগত তিনির সাথে আমার কোন সম্পর্ক ছিলো না। তবে সাধারণ ছাত্র হিসাবে পরিচিত ছিলো। আমি যতটুকু জানি এবং তিনি নিজেও পরবর্তিতে বলেছে-তিনি একজন
আমরা আরবিতে বলি মুয়াজ্জব, বা-সালাহিয়ত, মানুষের সঙ্গে সৎ ব্যবহারের একটা আখলাক বা চরিত্র তাঁর
মধ্যে ছিলো,
উগ্রপন্থী ছিলো না। সেলিম আউয়াল-মতিউর রহমান নিজামীর দলের সাথে আপনার কোন
সম্পর্ক আছে কি না? খতিব সাহেব- দল কি? তার দলতো জামাতে ইসলাম। জামাতে ইসলামীতে অতীতে আমরা কখনো ছিলাম না এবং আগামীতে কখনো
যাওয়ারও সম্ভবনা নেই। মবনু-বেশ কিছু দিন থেকে আমার ভেতরে
একটি বিষয়ে খেলা করছে, আমি ইংল্যান্ড, আরব বিশ্ব কিংবা ঢাকা বায়তুল মোকাররম মসজিদে দেখেছি
মহিলাদের জন্য নামাজের ব্যবস্থা রয়েছে, কিন্তু
বাংলাদেশের অন্য কোথাও ব্যাপকভাবে মসজিদগুলোতে মহিলাদের যাওয়ার কোন সুযোগ নেই। বরং ঘটনাচক্রে কোন মসজিদে মহিলারা নামাজের জন্য গেলে সবাই
হাউমাউ শুরু করে দেনÑএই মহিলা মসজিদে প্রবেশ করেছে, মহিলা মসজিদে প্রবেশ করেছে। মনে হয় যেনো মহিলা নয় কোন চোর প্রবেশ করেছে। আমরার দেশে কেনো অন্যান্য দেশের মতো কিংবা বায়তুল মোকাররমের
মতো মসজিদগুলোতে কোন ব্যবস্থা করা হয় না?খতিব সাহেব
আমাকে টেপরেকর্ড বন্ধ করতে বললেন। এরপর তিনি
তাঁর নিজের অভিজ্ঞতা থেকে একটা ঘটনা বর্ণনা করলেন। কিছু কথা বললেন নিজের মনের কথা। তবে একটি অভিজ্ঞতার কথা বলে দেওয়া যেতে পরে। বেশ আগে একবার তিনি তাঁর বোনকে নিয়ে লামাকাজি যাচ্ছেন। তখন আজকের মতো এতো গাড়ির পথ ছিলো না। তিনি হাঁটতে হাঁটতে কান্ত হয়ে তাঁর বোনকে নিয়ে এক মসজিদে
গিয়ে বসলে গোটা গ্রামবাসী এমনভাবে তাড়িয়ে আসে যেনো খুন-খারাপি কিছু একটা ঘটে গেছে। এসব মূলত মানুষের মূর্খতা। মহিলাদের মসজিদে যেতে কোন আপত্তি নেই। বর্তমানে দেখা যায় অনেক পুরুষ মসজিদের সামনে নিজের স্ত্রীকে
রিক্সায় কিংবা গাড়িতে দাঁড় করিয়ে নিজেরা নামাজ পড়তে যান, যদি মসজিদগুলোতে মহিলাদের জন্য সুব্যবস্থা থাকতো তা হলে এই
সময় মহিলারাও নামাজ পড়ে নিতে পারতো। তবে
উলামায়ে কেরাম বিভিন্ন মুসলাহতে বলেছেন মহিলারা যেনো ঘরেই নামাজ পড়ে এবং এটাই আফজল। এমনকি হজ্জের সময়ও তোয়াফ শেষে আর ধাক্কা-ধাক্কি না করে ঘরে
এসে নামাজ পড়া উত্তম। কিন্তু সেখানে মহিলারা গেলে মানে না। তারা ধাক্কাÑধাক্কি খেয়েও
জামাতে যাইবে।মবনু-ঈদের জামাত কি মহিলাদের জন্য
ওয়াজিব?খতিব সাহেব-না, বিলকুল না। জামাতি নামাজ কোনটাই মহিলাদের জন্য ওয়াজিব নয়। এতটুকু আলোচনার পর বিদ্যুৎ চলে যায়। গরমের সময়। খতিব
সাহেব বললেন-‘এখন আর রাখো তোমার এই গুলা। পরে আসলে আরেকদিন আরো কথা কইও।’ আমরা উঠতে উঠতে তাঁকে জানিয়ে দিলাম- আগামীতে সিলেট আসলে
প্রতিবার আমাদেরকে কমপে একঘন্টা সময় দিতে হবে। তিনি রাজি হলেন। আমার সাথে
কিছু ব্যক্তিগত আলাপ হলো। বিদায় নিয়ে বেরিয়ে আসলাম। আর তাঁর সাথে দেখা হলো না। তিনি মৃত্যুর মাত্র কয়েকদিন আগে ১৩ রমজান একদিনের জন্য
সিলেট আসলেও আমার জানতে দেরি হয়ে যায়। তিনি
সাধারণত রমজান মাসে ঢাকা থেকে সিলেট আসতেন না। কিন্তু মৃত্যু হলো যে রমজানে সেই রমজানে সিলেট আসেন এবং পরিবার
এবং আত্মীয়-স্বজন সবাইকে ইফতারের জন্য টাকা দিয়ে যান।
খতিব সাহেবের জীবনের শেষদিনের কিছু কথাদু’তিন দিন থেকেই তিনি শ্বাসকষ্টে ভুগছিলেন। অসুস্থ শরীর নিয়ে তিনি ৫ অক্টোবর শুক্রবারের জুম্মা পড়ান। এই দিন তিনি খুতবা শুরুর পূর্বে পেশ ইমাম মুফতি নুরউদ্দিনকে বলেন- ‘আপনি প্রস্তুত থাকেন, আমি না পারলে আপনি চালিয়ে যাবেন।’ ৬ অক্টোবর তিনি তাঁর শালাকে নিয়ে তাঁর নিজের ডাক্তারের কাছে যান এবং পরীা করান। ডাক্তার পরিক্ষা করে কিশোরদের হার্টের সাথে তাঁর হার্টের উপমা দিয়ে বললেন-চিন্তার কোন কারণ নেই, আপনি সুস্থ্য। খতিব সাহেব ঘরে ফিরে এসে তাঁর স্ত্রীকে মজা করে ডাক্তারের এই উপমার কথা বলেন। তখন তিনিও নাকি মজা করে বলেছেন- ‘ডাক্তার তোমাকে সুস্থ্য বলেছে, আর তুমি এখন শুরু করো গরুর গোশত খাওয়া।’ খতিব সাহেব বাসায় ইফতার করেন। রাতে ছিলো তাঁর দাওয়াত ইরানি কালচারাল সেন্টারে। সম্ভবত এই অনুষ্ঠান ছিলো ইরান থেকে বাংলাদেশে সফরে আসা ইরানের ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ শাহরুখীর সম্মানে। কারণ, পত্রিকার মাধ্যমে আমরা জানতে পারি ৫ তারিখ শুক্রবার বাদ জুম্মা বায়তুল মুকাররমে এই নেতার সাথে ফার্সিতে খতিব সাহেবের দীর্ঘ আলোচনা হয়েছে। রাতে তিনি ইরানি কালচারাল সেন্টারে যাওয়ার মুহূর্তে যখন তৈরি হচ্ছিলেন সে সময়ের কথা বলতে গিয়ে ছোট চাচী বলেন (খতিব সাহেবের ছোট স্ত্রী)-‘ তিনি কাপড় পরছিলেন, আমি টেনে-টুনে ঠিক করে দিচ্ছিলাম, এরপর পানের বাটা ঠিক করে দিলাম, তিনি আতরের শিশি হাতে নিয়ে ব্যবহার করলেন, আর হাসতে হাসতে আমাকে বললেনÑঈদের দিনে আমি কোন শাড়ি পড়বো। ছেলের বৌকে (একরামুল হকের স্ত্রী) কে ডাকলেন- ‘কী পাক করা হয়েছে’ জিজ্ঞাস করে বললে ‘এখন তোমরা খেয়ে নিও, আমি সেহরির সময় আমি খাবো।’ গাড়ি আসলে তিনি বেরিয়ে গেলেন। আমি জানতাম না তিনি আর এই ঘরে ফিরে আসবেন না। আমাকে একা ফেলে চলে যাবেন।’ ইরান কালচারেল সেন্টারের অনুষ্ঠান শেষে তিনি তাঁর বুকে একটু ব্যথা অনুভব করলে আল্লাহু আকবার তিনবার বলে তিনি বুক চেপে ধরেন। সাথে সাথে তাঁকে ল্যাব এইড হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পথে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।(ইন্নালিল্লাহি.....রাজিউন)।
ছড়িয়ে পড়লো মৃত্যুর সংবাদজাতীয় মুরুব্বী, আলেম সমাজের শিকÑঅভিভাবক, জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের খতিব, ইসলামি আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তিত্ব খতিব মাওলানা উবায়দুল হকের মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লে রমজানের মধ্যরাতের নিস্তব্ধতা মুহূর্তে উধাও হয়ে যায়। সংবাদপত্র অফিসে ও টিভি চ্যানেলগুলোর নিউজ ডেস্কে মুহূর্মুহু টেলিফোন আসতে থাকে। সবখানেই একটা কালো নিস্তদ্ধতা ছড়িয়ে পড়ে এবং শোকের ছায়া নেমে আসে। অনেকেই মরহুমের লাশ দেখতে ল্যাব এইড হাসপাতালে ভিড় করেন। গোটা দেশ যেনো এক সাথে শোকাভিভূত হয়ে পড়ে। অনেকে আবার রাতেই ছুটে যান হাসপাতালে এবং কান্নায় ভেঙে পড়েন। হাসপাতালে তাঁর সহকর্মী, শুভানুধ্যায়ী, ছাত্র ও অনুগামিদের ভিড় সামলাতে কর্তৃপকে হিমশিম খেতে হয়। ঢাকার আজিমপুরের বাসায় এবং সিলেটের সুবিদবাজারের বাসায় মুহূর্তের মধ্যে জমে উঠে অসংখ্য মানুষের ভিড়। লাশ সিলেট আসছে না শুনে সিলেটের অনেকেই মনে মনে কষ্ট অনুভব করেন। কেউ কেউ নিজেদের সাধ্যানুসারে চেষ্টা করতে থাকেন সিলেটে আনার কোন ব্যবস্থা করা যায় কি না। অনেকে রাতেই জানাজার জন্য যাত্রা শুরু করেন ঢাকার পথে। গোটা দেশের প্রায় সকল মসজিদের মাইকে এলান হতে থাকে খতিব সাহেবের মৃত্যু সংবাদ এবং জানাজার স্থান ও সময়।(তথ্যসূত্র- দৈনিক ইনকিলাব ও দৈনিক নয়াদিগন্ত)।
নামাজে জানাজা অশ্র“সজল নয়নে লাখো মানুষ জামায়েত হলেন ঢাকার জাতীয় ঈদগাহ ময়দানে তাদের প্রাণপ্রিয় রাহবার খতিব মাওলানা উবায়দুল হককে শেষ বিদায় জানাতে। আমরা যখন ঈদগাহ ময়দানে পৌঁছি তখন ঘড়িতে একটা। জানাজা হবে তিনটায়। সপ্তাহদিনের মধ্যে ঢাকায় বৃষ্টি নেই। আগামী সপ্তাহদিনের মধ্যে বৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা নেই বলে আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে। রমজানের দিন, মাথার উপর মধ্যদুপুরের প্রচণ্ড রোদ। ভয়ে ভয়ে মাঠে গিয়ে আমরা কেউ কেউ গাছ খুঁজতেছিলাম একটু ছায়ার জন্য। এরমধ্যে নিরাপত্তাকর্মীদের উৎপাত। সরকারের সর্বোচ্চ ব্যক্তিগণ আসছেন জানাজায়, তাই এসেছে সর্বোচ্চ নিরাপত্তাকর্মীরা। মাঠে আমার লেখক সত্ত্বা পরাধীনতায় কষ্টে ছিলো। এরই মধ্যে নিরাপত্তাকর্মীরা বললেন সবাই মাঠ ছেড়ে যেতে হবে, পরিক্ষা করার পর একজন একজন করে প্রবেশ করানো হবে। কথা শোনে অনেকটা হাসি পায়। যদি দু’চার হাজার মানুষের ব্যাপার হতো তবে এই কথার যুক্তি থাকতো। লাখ-লাখ মানুষ যদি হয় তবে? না, সেনাবাহিনী প্রথমদিকে কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেও শেষ পর্যন্ত শুধু সামনের দু’ কাতার ছাড়া বাকিগুলো ছেড়ে দেয়। আমরা যারা মঞ্চে তাদের পরিচয় জেনে নিলেন উপস্থিত আইন-শৃংখলা নিয়ন্ত্রক। তাহাফফুজে খতমে নাবুওয়াত আন্দোলনের সেক্রেটারি মাওলানা নুরুল ইসলাম চট্টগ্রামীর পরিচালনায় জানাজাপূর্ব সময়ে খতিব সাহেবের বিভিন্ন কর্মের উপর বক্তব্য রাখতে গিয়ে ধর্ম উপদেষ্টা অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল ড. মতিউর রহমান বলেন-‘ আল্লাহ সবার শ্রদ্ধেয় খতিব সাহেবকে রমজান মাসে তাঁর কাছে ডেকে নিয়ে গেছেন। আল্লাহ তা’আলা মানুষকে উদ্ভুদ্ধ করার জন্য, জাতীয় মসজিদের খতিব হিসাবে মানুষকে নেতৃত্ব দেওয়ার মতো সব যোগ্যতা দিয়েছিলেন তাঁকে। তাঁর মতো ব্যক্তিত্ব বায়তুল মোকাররমের খতিব হওয়া আমাদের জাতির জন্য ছিলো সৌভাগ্য।’ খেলাফত মজলিশের আমীর শায়খুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক তাঁর নিজের লেখা একটি আরবি কবিতা আবৃত্তি করে বলেন- ‘মাওলানা উবায়দুল হক ছিলেন সেই ব্যক্তিত্ব, অসংখ্য ফুল ফুটিয়ে যিনি বিলীন হয়ে গেলেন।’ জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের পেশ ইমাম মুফতি মাওলানা নুরউদ্দিন বলেন- ‘আমরা দীর্ঘদিন এক সাথে হুজুরের সাথে কাজ করেছি, তিনি আমাদেরকে কোনদিন কষ্ট দেননি।’ জামাতে ইসলামীর আমীর মাওলানা মতিউর রহমান নেজামী বলেন-তাঁর ইন্তেকাল আমাদের জন্য এক দুঃখজনক ঘটনা। তিনি ছিলেন এদেশের সব মানুষের অভিভাবক। বিশেষ করে ‘হুজুর আমার মতো অনেকেরই অভিভাবক ছিলেন। খতিব সাহেবের জাতীয় অভিভাবকত্ব ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। তাঁর মৃত্যুতে জাতি একজন অভিভাবক হারালো এবং একটি শূন্যতা সৃষ্টি হলো, আল্লাহ যেন তা পূরণ করে দেন। তিনি জাতীয় সব সংকটের সময় জাতিকে সঠিক দিক নির্দেশনা দিয়েছেন। ইসলামি দলগুলোর মধ্যে ঐক্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিলো তাঁর। ইসলামী উম্মাহের বিরুদ্ধে বিভিন্ন যড়যন্ত্র নস্যাৎ করতে তিনি সর্বদাই সাহসী ভূমিকা রেখেছেন।’ মাসিক মদিনার সম্পাদক মাওলানা মহিউদ্দিন খান বলেন-‘খতিব সাহেবের অনুপ্রেরণায় আমার মতো অনেক আলেম ইসলামী আন্দোলনে সাহসী ভূমিকা পালন করছেন।’ ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান আবু নাসের মোহাম্মদ আবদুজ জাহের বলেন-সুদমুক্ত অর্থনৈতিক সমাজ প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের প্রাণপুরুষ বলা যেতে পারে প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন খতিব সাহেব। ইসলামী ব্যাংকে দেওয়া তাঁর বক্তব্যসমূহ রেকর্ড করা আছে, আমরা এগুলো প্রকাশ করবো ইনশাল্লাহ।’ এই আলোচনা চলাকালীন সময় আস্তে আস্তে আকাশের সূর্যও মেঘের ভেতর দুঃখেÑকষ্ঠে মুখ লুকাতে শুরু করে। মুহুর্তের মধ্যে সমস্ত জাতীয় ঈদগাহ প্রায় অন্ধকার হয়ে পড়ে। বৃষ্টি আসছে আসছে অবস্থার মধ্যে মাঠে আসেন রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক ড. ইয়াজ উদ্দিন আহমেদ, প্রধান উপদেষ্টা ড. ফখরুদ্দিন আহমদ, ডেপুটি স্পীকার আখতার হামিদ সিদ্দিকী, তথ্য উপদেষ্টা ব্যরিস্টার মইনুল হোসেন, সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল মইন উদ্দিন আহমদ, নৌবাহিনী প্রধান ভাইস এডমিরাল সরোয়ার জাহান নিজাম, সেনাবাহিনীর প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার লে. জেনারেল মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী প্রমুখ সরকারি কর্মকতা। এছাড়াও জানাজায় উপস্থিত হয়েছিলেনÑসাবেক প্রেসিডেন্ট জাতীয় পার্টি প্রধান হুসেন মোহাম্মদ এরশাদ, বিএনপির মহাসচিব খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন, জামাতে ইসলামীর সেক্রেটারী জেনারেল আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ, ইসলামী ঐক্যজোটের সাবেক এমপি মাওলানা ফজলুল হক আমিনী, মসজিদ মিশনের যয়নুল আবেদিন প্রমুখ আরো অসংখ্য বিশেষ ব্যক্তিবর্গ। জানাজা শুরু হয় একেবারে মেঘলা অন্ধকারে। জানাজার নামাজ পড়ান খতিব সাহেবের দ্বিতীয় ছেলে সিলেট জামেয়া কাসিমুল উলূম দরগাহে হযরত শাহজালাল (র.) মাদ্রাসার মুহাদ্দিস মাওলানা আতাউল হক। জানাজার নামাজের শেষে খতিব মাওলানা উবায়দুল হকের মুখ শেষবারের মতো একবার দেখতে যখন লাখো মানুষের মিছিল লাশের দিকে এগিয়ে আসছে তখনই আকাশ ভেঙে ঝড়Ñবৃষ্টি নামতে শুরু করে। শুরু হয় উল্টো দিকে মানুষের দৌড়। লাশ নিয়ে যাওয়া হয় আজিমপুর গোরস্থানে এবং বৃষ্টির মধ্যেই দাফন করা হয় বড়কাটারা মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা প্রিন্সিপাল মাওলানা আব্দুল ওয়াহাব পিরজী হুজুর (র.) এবং আজিমপুর ফয়জুল উলূম মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা প্রিন্সিপাল মাওলানা আব্দুল্লা (র.)এর কবরের কাছাকাছি একেবারে গোরস্থানের ভেতরের রাস্তা ঘেষে।
হালাল ব্যবসার প্রতি খতিব মাওলানা উবায়দুল হকের গুরুত্বারোপ
খতিব সাহেবের জীবনের শেষদিনের কিছু কথাদু’তিন দিন থেকেই তিনি শ্বাসকষ্টে ভুগছিলেন। অসুস্থ শরীর নিয়ে তিনি ৫ অক্টোবর শুক্রবারের জুম্মা পড়ান। এই দিন তিনি খুতবা শুরুর পূর্বে পেশ ইমাম মুফতি নুরউদ্দিনকে বলেন- ‘আপনি প্রস্তুত থাকেন, আমি না পারলে আপনি চালিয়ে যাবেন।’ ৬ অক্টোবর তিনি তাঁর শালাকে নিয়ে তাঁর নিজের ডাক্তারের কাছে যান এবং পরীা করান। ডাক্তার পরিক্ষা করে কিশোরদের হার্টের সাথে তাঁর হার্টের উপমা দিয়ে বললেন-চিন্তার কোন কারণ নেই, আপনি সুস্থ্য। খতিব সাহেব ঘরে ফিরে এসে তাঁর স্ত্রীকে মজা করে ডাক্তারের এই উপমার কথা বলেন। তখন তিনিও নাকি মজা করে বলেছেন- ‘ডাক্তার তোমাকে সুস্থ্য বলেছে, আর তুমি এখন শুরু করো গরুর গোশত খাওয়া।’ খতিব সাহেব বাসায় ইফতার করেন। রাতে ছিলো তাঁর দাওয়াত ইরানি কালচারাল সেন্টারে। সম্ভবত এই অনুষ্ঠান ছিলো ইরান থেকে বাংলাদেশে সফরে আসা ইরানের ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ শাহরুখীর সম্মানে। কারণ, পত্রিকার মাধ্যমে আমরা জানতে পারি ৫ তারিখ শুক্রবার বাদ জুম্মা বায়তুল মুকাররমে এই নেতার সাথে ফার্সিতে খতিব সাহেবের দীর্ঘ আলোচনা হয়েছে। রাতে তিনি ইরানি কালচারাল সেন্টারে যাওয়ার মুহূর্তে যখন তৈরি হচ্ছিলেন সে সময়ের কথা বলতে গিয়ে ছোট চাচী বলেন (খতিব সাহেবের ছোট স্ত্রী)-‘ তিনি কাপড় পরছিলেন, আমি টেনে-টুনে ঠিক করে দিচ্ছিলাম, এরপর পানের বাটা ঠিক করে দিলাম, তিনি আতরের শিশি হাতে নিয়ে ব্যবহার করলেন, আর হাসতে হাসতে আমাকে বললেনÑঈদের দিনে আমি কোন শাড়ি পড়বো। ছেলের বৌকে (একরামুল হকের স্ত্রী) কে ডাকলেন- ‘কী পাক করা হয়েছে’ জিজ্ঞাস করে বললে ‘এখন তোমরা খেয়ে নিও, আমি সেহরির সময় আমি খাবো।’ গাড়ি আসলে তিনি বেরিয়ে গেলেন। আমি জানতাম না তিনি আর এই ঘরে ফিরে আসবেন না। আমাকে একা ফেলে চলে যাবেন।’ ইরান কালচারেল সেন্টারের অনুষ্ঠান শেষে তিনি তাঁর বুকে একটু ব্যথা অনুভব করলে আল্লাহু আকবার তিনবার বলে তিনি বুক চেপে ধরেন। সাথে সাথে তাঁকে ল্যাব এইড হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পথে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।(ইন্নালিল্লাহি.....রাজিউন)।
ছড়িয়ে পড়লো মৃত্যুর সংবাদজাতীয় মুরুব্বী, আলেম সমাজের শিকÑঅভিভাবক, জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের খতিব, ইসলামি আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তিত্ব খতিব মাওলানা উবায়দুল হকের মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লে রমজানের মধ্যরাতের নিস্তব্ধতা মুহূর্তে উধাও হয়ে যায়। সংবাদপত্র অফিসে ও টিভি চ্যানেলগুলোর নিউজ ডেস্কে মুহূর্মুহু টেলিফোন আসতে থাকে। সবখানেই একটা কালো নিস্তদ্ধতা ছড়িয়ে পড়ে এবং শোকের ছায়া নেমে আসে। অনেকেই মরহুমের লাশ দেখতে ল্যাব এইড হাসপাতালে ভিড় করেন। গোটা দেশ যেনো এক সাথে শোকাভিভূত হয়ে পড়ে। অনেকে আবার রাতেই ছুটে যান হাসপাতালে এবং কান্নায় ভেঙে পড়েন। হাসপাতালে তাঁর সহকর্মী, শুভানুধ্যায়ী, ছাত্র ও অনুগামিদের ভিড় সামলাতে কর্তৃপকে হিমশিম খেতে হয়। ঢাকার আজিমপুরের বাসায় এবং সিলেটের সুবিদবাজারের বাসায় মুহূর্তের মধ্যে জমে উঠে অসংখ্য মানুষের ভিড়। লাশ সিলেট আসছে না শুনে সিলেটের অনেকেই মনে মনে কষ্ট অনুভব করেন। কেউ কেউ নিজেদের সাধ্যানুসারে চেষ্টা করতে থাকেন সিলেটে আনার কোন ব্যবস্থা করা যায় কি না। অনেকে রাতেই জানাজার জন্য যাত্রা শুরু করেন ঢাকার পথে। গোটা দেশের প্রায় সকল মসজিদের মাইকে এলান হতে থাকে খতিব সাহেবের মৃত্যু সংবাদ এবং জানাজার স্থান ও সময়।(তথ্যসূত্র- দৈনিক ইনকিলাব ও দৈনিক নয়াদিগন্ত)।
নামাজে জানাজা অশ্র“সজল নয়নে লাখো মানুষ জামায়েত হলেন ঢাকার জাতীয় ঈদগাহ ময়দানে তাদের প্রাণপ্রিয় রাহবার খতিব মাওলানা উবায়দুল হককে শেষ বিদায় জানাতে। আমরা যখন ঈদগাহ ময়দানে পৌঁছি তখন ঘড়িতে একটা। জানাজা হবে তিনটায়। সপ্তাহদিনের মধ্যে ঢাকায় বৃষ্টি নেই। আগামী সপ্তাহদিনের মধ্যে বৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা নেই বলে আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে। রমজানের দিন, মাথার উপর মধ্যদুপুরের প্রচণ্ড রোদ। ভয়ে ভয়ে মাঠে গিয়ে আমরা কেউ কেউ গাছ খুঁজতেছিলাম একটু ছায়ার জন্য। এরমধ্যে নিরাপত্তাকর্মীদের উৎপাত। সরকারের সর্বোচ্চ ব্যক্তিগণ আসছেন জানাজায়, তাই এসেছে সর্বোচ্চ নিরাপত্তাকর্মীরা। মাঠে আমার লেখক সত্ত্বা পরাধীনতায় কষ্টে ছিলো। এরই মধ্যে নিরাপত্তাকর্মীরা বললেন সবাই মাঠ ছেড়ে যেতে হবে, পরিক্ষা করার পর একজন একজন করে প্রবেশ করানো হবে। কথা শোনে অনেকটা হাসি পায়। যদি দু’চার হাজার মানুষের ব্যাপার হতো তবে এই কথার যুক্তি থাকতো। লাখ-লাখ মানুষ যদি হয় তবে? না, সেনাবাহিনী প্রথমদিকে কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেও শেষ পর্যন্ত শুধু সামনের দু’ কাতার ছাড়া বাকিগুলো ছেড়ে দেয়। আমরা যারা মঞ্চে তাদের পরিচয় জেনে নিলেন উপস্থিত আইন-শৃংখলা নিয়ন্ত্রক। তাহাফফুজে খতমে নাবুওয়াত আন্দোলনের সেক্রেটারি মাওলানা নুরুল ইসলাম চট্টগ্রামীর পরিচালনায় জানাজাপূর্ব সময়ে খতিব সাহেবের বিভিন্ন কর্মের উপর বক্তব্য রাখতে গিয়ে ধর্ম উপদেষ্টা অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল ড. মতিউর রহমান বলেন-‘ আল্লাহ সবার শ্রদ্ধেয় খতিব সাহেবকে রমজান মাসে তাঁর কাছে ডেকে নিয়ে গেছেন। আল্লাহ তা’আলা মানুষকে উদ্ভুদ্ধ করার জন্য, জাতীয় মসজিদের খতিব হিসাবে মানুষকে নেতৃত্ব দেওয়ার মতো সব যোগ্যতা দিয়েছিলেন তাঁকে। তাঁর মতো ব্যক্তিত্ব বায়তুল মোকাররমের খতিব হওয়া আমাদের জাতির জন্য ছিলো সৌভাগ্য।’ খেলাফত মজলিশের আমীর শায়খুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক তাঁর নিজের লেখা একটি আরবি কবিতা আবৃত্তি করে বলেন- ‘মাওলানা উবায়দুল হক ছিলেন সেই ব্যক্তিত্ব, অসংখ্য ফুল ফুটিয়ে যিনি বিলীন হয়ে গেলেন।’ জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের পেশ ইমাম মুফতি মাওলানা নুরউদ্দিন বলেন- ‘আমরা দীর্ঘদিন এক সাথে হুজুরের সাথে কাজ করেছি, তিনি আমাদেরকে কোনদিন কষ্ট দেননি।’ জামাতে ইসলামীর আমীর মাওলানা মতিউর রহমান নেজামী বলেন-তাঁর ইন্তেকাল আমাদের জন্য এক দুঃখজনক ঘটনা। তিনি ছিলেন এদেশের সব মানুষের অভিভাবক। বিশেষ করে ‘হুজুর আমার মতো অনেকেরই অভিভাবক ছিলেন। খতিব সাহেবের জাতীয় অভিভাবকত্ব ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। তাঁর মৃত্যুতে জাতি একজন অভিভাবক হারালো এবং একটি শূন্যতা সৃষ্টি হলো, আল্লাহ যেন তা পূরণ করে দেন। তিনি জাতীয় সব সংকটের সময় জাতিকে সঠিক দিক নির্দেশনা দিয়েছেন। ইসলামি দলগুলোর মধ্যে ঐক্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিলো তাঁর। ইসলামী উম্মাহের বিরুদ্ধে বিভিন্ন যড়যন্ত্র নস্যাৎ করতে তিনি সর্বদাই সাহসী ভূমিকা রেখেছেন।’ মাসিক মদিনার সম্পাদক মাওলানা মহিউদ্দিন খান বলেন-‘খতিব সাহেবের অনুপ্রেরণায় আমার মতো অনেক আলেম ইসলামী আন্দোলনে সাহসী ভূমিকা পালন করছেন।’ ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান আবু নাসের মোহাম্মদ আবদুজ জাহের বলেন-সুদমুক্ত অর্থনৈতিক সমাজ প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের প্রাণপুরুষ বলা যেতে পারে প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন খতিব সাহেব। ইসলামী ব্যাংকে দেওয়া তাঁর বক্তব্যসমূহ রেকর্ড করা আছে, আমরা এগুলো প্রকাশ করবো ইনশাল্লাহ।’ এই আলোচনা চলাকালীন সময় আস্তে আস্তে আকাশের সূর্যও মেঘের ভেতর দুঃখেÑকষ্ঠে মুখ লুকাতে শুরু করে। মুহুর্তের মধ্যে সমস্ত জাতীয় ঈদগাহ প্রায় অন্ধকার হয়ে পড়ে। বৃষ্টি আসছে আসছে অবস্থার মধ্যে মাঠে আসেন রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক ড. ইয়াজ উদ্দিন আহমেদ, প্রধান উপদেষ্টা ড. ফখরুদ্দিন আহমদ, ডেপুটি স্পীকার আখতার হামিদ সিদ্দিকী, তথ্য উপদেষ্টা ব্যরিস্টার মইনুল হোসেন, সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল মইন উদ্দিন আহমদ, নৌবাহিনী প্রধান ভাইস এডমিরাল সরোয়ার জাহান নিজাম, সেনাবাহিনীর প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার লে. জেনারেল মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী প্রমুখ সরকারি কর্মকতা। এছাড়াও জানাজায় উপস্থিত হয়েছিলেনÑসাবেক প্রেসিডেন্ট জাতীয় পার্টি প্রধান হুসেন মোহাম্মদ এরশাদ, বিএনপির মহাসচিব খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন, জামাতে ইসলামীর সেক্রেটারী জেনারেল আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ, ইসলামী ঐক্যজোটের সাবেক এমপি মাওলানা ফজলুল হক আমিনী, মসজিদ মিশনের যয়নুল আবেদিন প্রমুখ আরো অসংখ্য বিশেষ ব্যক্তিবর্গ। জানাজা শুরু হয় একেবারে মেঘলা অন্ধকারে। জানাজার নামাজ পড়ান খতিব সাহেবের দ্বিতীয় ছেলে সিলেট জামেয়া কাসিমুল উলূম দরগাহে হযরত শাহজালাল (র.) মাদ্রাসার মুহাদ্দিস মাওলানা আতাউল হক। জানাজার নামাজের শেষে খতিব মাওলানা উবায়দুল হকের মুখ শেষবারের মতো একবার দেখতে যখন লাখো মানুষের মিছিল লাশের দিকে এগিয়ে আসছে তখনই আকাশ ভেঙে ঝড়Ñবৃষ্টি নামতে শুরু করে। শুরু হয় উল্টো দিকে মানুষের দৌড়। লাশ নিয়ে যাওয়া হয় আজিমপুর গোরস্থানে এবং বৃষ্টির মধ্যেই দাফন করা হয় বড়কাটারা মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা প্রিন্সিপাল মাওলানা আব্দুল ওয়াহাব পিরজী হুজুর (র.) এবং আজিমপুর ফয়জুল উলূম মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা প্রিন্সিপাল মাওলানা আব্দুল্লা (র.)এর কবরের কাছাকাছি একেবারে গোরস্থানের ভেতরের রাস্তা ঘেষে।
হালাল ব্যবসার প্রতি খতিব মাওলানা উবায়দুল হকের গুরুত্বারোপ
খতিব মাওলানা উবায়দুল হক (র.) কে আমরা এই সময়ের একজন
সংস্কারক বলতে পারি। বাংগালী আলেমদের মধ্যে তাঁর পূর্বে
যারা খ্যাতি অর্জন করেছেন রাজনৈতিক কিংবা সামাজিক সংস্কার কাজে, তাদের সবার প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলতে পারি খতিব উবায়দুল
হকের মতো সর্বদিকে এতো ব্যাপক প্রভাব বিস্তারকারী তাঁর পূর্বে অন্য কাউকে আমরা
হয়তো দেখতে পাবো না। এই তো তিনি মাত্র ইন্তোকাল করলেন ৬ অক্টোবর
০৭। এখনো তাঁর জীবনের পূর্ণাঙ্গ কর্মগুলো আমাদের সামনে আসেনি। তাঁর ৭৯ বছর জীবনের পূর্ণাঙ্গ কর্ম আমাদের সামনে আসতে আসতে
হয়তো আরো দশ বছর চলে যাবে। আমরা এই দশ বছরে যা লিখবো এগুলোকে
অবশ্যই তাঁর পূর্ণাঙ্গ জীবনী বলা যাবে না। তবে আমাদের খণ্ড খণ্ড চিত্রাঙ্কণ হয়তো এক সময় বিশাল এক নদীর
চিত্র জাতির সামনে নিয়ে আসবে। অতঃপর এই
চিত্রগুলোর সমম্বয়ে যে বা যারা লিখবে, তাদের ঐ কর্মকে
পূর্ণাঙ্গ কর্ম বলা যেতে পারে। আর যখন
খতিব মাওলানা উবায়দুল হকের পূর্ণাঙ্গ জীবন ও কর্ম আমাদের সামনে চলে আসবে, তখন আমরা বুঝতে পারবো তিনি কতো বিশাল ব্যক্তিত্ব ছিলেন। ২৯ অক্টোবর ০৭ ‘খতিব মাওলানা
উবায়দুল হকের জীবন ও কর্ম ’ শীর্ষক আমার একটি দীর্ঘ লেখা
গ্রন্থাকারে প্রকাশ করেছে ইসলামিক কালচারাল ফোর্স। গ্রন্থটি প্রকাশের পর আমার বার বার মনে হলো সম্পূর্ণ
অপূর্ণাঙ্গ থেকে গেলো। এতো ছোট পরিসরে একটা বিশাল নদীকে ধারণ
করা সত্যই অসম্ভব। আন্তর্জাতিক কোরআন তেলাওয়াত পরিষদ, বাংলাদেশ ( সংপেÑইকরা) একটা
স্মারক বের করছে খতিব সাহেবের জীবন ও কর্ম নিয়ে। আমাকে বলা হলো একটা লেখা দিতে। আমি এই লেখাটা তৈরি করতে আমার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সিটি অফসেট
প্রেসে বসে যখন খতিব সাহেবের বিভিন্ন দিক নিয়ে ভাবছিলাম, তখন বিস্মৃতির দেয়াল সরিয়ে কিছু স্মৃতি আমাকে নাড়িয়ে
যাচ্ছিলো। ২০ মে ২০০২ খ্রিস্টাব্দে এই প্রেসের
উদ্ভোধনী অনুষ্ঠানে আমরা অতিথী হিসেবে দাওয়াত করেছিলাম ভাষা সৈনিক অধ্য মাসউদ খান, ড. কবির চৌধুরী, হাফেজ মাওলানা
মনছুরুল হাসান রায়পুরী, আলহাজ্ব সৈয়দ আতাউর রহমান, এম. এ. করিম চৌধুরী. কবি কিশওয়ার ইবনে দিলওয়ার প্রমূখকে। এদিনের অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথী ছিলেন খতিব মাওলানা উবায়দুল
হক (র.)। সেই দিন খতিব সাহেব (র.) সুইচ টিপে যে
ভঙ্গিতে মিশিন চালু করেছিলেন, আজ আমার স্মৃতিতে সেই চিত্র খুব বেশি
খেলা করছে প্রেসের চেয়ারে বসে। আর হালাল
ব্যবসা এবং প্রেস ব্যবসা সম্পর্কিত খতিব সাহেবের বক্তব্য সেই সময়ে অনেকদিন আমাদের
বন্ধু মহলে আলোচনার বিষয় ছিলো। খতিব
সাহেব সেদিন বলেছিলেন- আজ একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আমরা সমবেত
হয়েছি, যাতে এ প্রতিষ্ঠানের উন্নতির জন্য দোয়াতে সামিল হই।.... যারা এই প্রেসের উদ্যোক্তা-পরিচালক তাদেরকে আমি বিশেষ কিছু
কথা বলতে চাই;
আপনারা স্মরণ রাখবেন-এই ব্যবসা শুধু দুনিয়া অর্জন বা জীবিকা
হাসিলের জন্যই নয়। এটা হল একটি ইবাদত। নবী করিম (সা.) এক হাদিসে এরশাদ করেছেন ‘ কাসফুল হালাল ফরিজাতুন বাদাল ফরিজা ’ অর্থাৎ ‘ হালাল রুজী অর্জন করা অন্যান্য ফরজের
মতই একটি ফরজ।’ আমাদের জানা আছে ফরজ কাজ ইবাদতই হয়ে
থাকে, তা আর অন্যান্য দুনিয়াবী কাজের মত থাকে না। আর এই ব্যবসায়ী ফরজ কাজ আদায় করতে গিয়ে এ পৃথিবীতে ইসলামের
প্রচার এবং প্রসার ঘটেছে। আমাদের নবী করিম (সা.) এর বড়
বৈশিষ্ট্যগুলির একটি ছিলো তিনি একজন বড় ব্যবসায়ী ছিলেন। তিনি বাল্যকাল থেকে ব্যবসা শুরু করে নবুওয়াত প্রাপ্তির
পূর্ব পর্যন্ত ব্যবসা করেছেন। তিনি
সাহাবায়ে কেরামদেরকে ব্যবসার প্রতি উৎসাহিত করেছেন।ব্যবসায়ীদের মর্যাদা ঘোষণায় তিনি বলেছেনÑ‘ আততাজিরু ছাদিকুল আমীন, মা’আন নাবীইয়িনা ওয়া সিদ্দিকিন, ওয়াশ
শুহাদাÑই ইয়াওমাল কিয়ামা।’ অর্থাৎ যে
ব্যবসায়ী সত্যবাদী হবে তার হাশর হবে নবী, সিদ্দিক এবং
শহীদদের সাথে।’ এর চেয়ে বড় মর্যাদা আর কি হতে পারে ? সিটি অফসেট প্রেসের পরিচালকেরা যদি সততার সাথে ব্যবসা করেন, তবে তা হবে ইবাদত, সাথে সাথে
ব্যবসারও উন্নতি হবে, সাধারণ মানুষ উপকৃত হবে, নিজেদের লাভ হবে। অনেকে ব্যবসায় তিগ্রস্থ হয়ে বলেন পুঁজির অভাবে এমন হয়েছে । কিন্তু আমাদের নবী করিম (সা.) বলেছেন-তোমরা যদি ব্যবসায় আসল
পুঁজি রা কর তবে কখনও তিগ্রস্থ হবে না। আর সেই
আসল পুঁজি হল দুটি জিনিষ-১) সত্যবাদীতা, ২) আমানতদারী। আমানতদারীর ভেতর ওয়াদা রাও সামিল। ভারত উপমহাদেশের মুসলমানদের মধ্যে প্রথম প্রেসের ব্যবসা
শুরু করেছিলেন আমাদের বুজুর্গ হযরত মাওলানা আহমদ আলী সাহারনপুরী (রহ.)। সেই প্রেসে কাজ করেছেন দারুল উলুম দেওবন্দের প্রতিষ্ঠাতা
মাওলানা কাসিম নানুতবি (রহ.)। এর পূর্বে
ভারতবর্ষে ছাপাকৃত ইসলামিক কিতাবের প্রচলন ছিল না। মাওলানা আহমদ আলী সাহারনপুরী ও মাওলানা কাসিম নানুতবি (রহ.)র
অকান্ত প্রচেষ্টায় ছাপাকৃত কোরআন-হাদীস তাফসিরের ধারা প্রথম শুরু হয়। আমরা দোয়া করি এই প্রেসের পরিচালকরা যেন সেই ধারাকে অব্যাহত
রাখতে পারেন। আসুন আমরা সবাই মিলে দোয়া করি -হে
আলাহ, এই প্রেস ব্যবসা তোমার প্রিয় হাবিব হযরত মোহাম্মদ (সা.) এর
সুন্নত অনুসারে শুরু করা হচ্ছে। আপনি এই
ব্যবসাকে কবুল করুন। যেভাবে ব্যবসা করলে আপনি খুশি হবেন এই
প্রেসের মালিকদেরকে সেভাবে ব্যবসা করার তৌফিক দিন। এই প্রেস ব্যবসাকে দ্বীনের খেদমত ও প্রচারে অবদান রাখার
তৌফিক দিন। হে রাব্বুল আলামিন -এই প্রেসের
পরিচালকদের ভেতর সততা, আমানতদারী, ওয়াদা রা ইত্যাদি ভাল দিকগুলিকে প্রতিষ্ঠিত করে দিন। হে আল্লাহ-আমাদের সবাইকে কবুল করুন।’ খতিব সাহেবের এই বক্তব্য সেদিন আমার ভেতর যে প্রভাব বিস্তার
করেছিলো পরবর্তিতে প্রেস পরিচালনার ক্ষেত্র তা পালনের চেষ্টা করেছি। প্রেস চালুকালে অনেকে আমাকে বলেছিলেন ইংল্যান্ড থেকে এসে
ব্যবসা করে বেশিদিন থাকতে পারবো না। কিন্তু
খতিব সাহেবের এই বক্তব্যকে আদর্শ করে প্রেস পরিচালনার ক্ষেত্র চেষ্টা করেছি বলেই
হয়তো এখনো দাঁড়িয়ে আছি। শুধু দাঁড়িয়ে আছি বললে হয়তো ভুল হবে, পূর্ণাঙ্গরূপেই দাঁড়িয়ে আছি। আমার বিশ্বাস এই বক্তব্যকে যদি সকল ব্যবসায়ীরা
পূর্ণাঙ্গরূপে অনুসরণ করেন, তবে ব্যবসার ক্ষেত্রে উপকৃতই হবেন। মহান আল্লাহ পাক আমাদের সবাইকে এই কথাগুলোর উপর আমলের তৌফিক
দান করুন এবং এর সকল নেকি খতিব মাওলানা উবায়দুল হকের আমলানামায় লিখে দিন। আমীন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন