সোমবার, ৯ মে, ২০১৬

ইসলামবিহীন বিশ্ব কাঙ্গাল

আল্লামা মুফতি নুর হুসাইন নুরানী দা.বা।পীর সাহেব মুন্সিগঞ্জ ঢাকা।


ইসলাম ও মুসলিম এখনকার বহুল আলোচিত দুটি শব্দসমাজতন্ত্র পতনের পর ইসলামকেই পাশ্চাত্যের সামনে দাঁড় করানো হয়েছেবিশেষ করে পাশ্চাত্যের অনেকেই ইসলামকে বর্তমান সভ্যতার জন্য সবচেয়ে বড় বিপদ হিসেবে অভিহিত করছেঅনেকে তো ইসলামকে সন্ত্রাসবাদের প্রতিশব্দ হিসেবেও উল্লেখ করছেঅথচ বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্নপাশ্চাত্যের আগ্রাসন, ভুলনীতির কারণেই ক্ষুব্ধ হচ্ছে মুসলিমরাএমন এক প্রেক্ষাপটেই গ্রাহাম ই ফুলারের এ ওয়ার্ল্ড উইথআউট ইসলাম বইটি অনুবাদের উদ্যোগ নেয়া হয়েছেলেখক মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএর ন্যাশনাল ইন্টেলিজেন্স কাউন্সিলের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান, র‌্যান্ডের সাবেক সিনিয়র রাজনীতিবিজ্ঞানী এবং বর্তমানে সাইমন ফ্রেসার বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাজাঙ্কক্ট প্রফেসরতিনি প্রায় দুই যুগ মুসলিম বিশ্বে বসবাস করেছেন, কাজ করেছেনএ বইয়ের প্রতিটি বক্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্বতার ব্যাখ্যা ভিন্ন এক ধর্মে বিশ্বাসী ব্যক্তি ইসলামকে সমসাময়িক পরিপ্রেক্ষিতে কিভাবে দেখেছেন সে বিবেচনায় মূল্যায়ন করতে হবেএর সাথে দ্বিমত পোষণের অনেক অবকাশ থাকবেএরপরও লেখকের মূল দৃষ্টিভঙ্গি বুঝার জন্য কোন ব্যাখ্যা ছাড়া এখানে কেবল অনুবাদ করা হয়েছেএর ভাষান্তর করেছেন মোহাম্মদ  


ঈমান গ্রহণ করার শর্তগুলোর মধ্যে রয়েছে এক আল্লাহতে বিশ্বাস, আল্লাহর সব নবীর (হজরত মুসা আ: হজরত ঈসা আ: এবং হজরত মুহাম্মদ সা:) ওপর বিশ্বাস, ফেরেশতায় বিশ্বাস, আল্লাহর নাজিল করা প্রধান প্রধান কিতাবের (এগুলোর মধ্যে রয়েছে ওল্ড ও নিউ টেস্টামেন্ট তাওরাত, ইঞ্জিল ও কুরআন) ওপর বিশ্বাস, শেষ বিচার ও পুনরুত্থানের ওপর বিশ্বাস, ভাগ্য বা নিয়তির ওপর বিশ্বাসনতুন ধর্মের এ তাত্ত্বিক ভিত্তিটি সহজে এর প্রচার, ব্যাখ্যা গ্রহণের সুযোগ করে দেয়
হজরত মুহাম্মদ সা: ছিলেন প্রথম মুসলমান, তথা প্রথম ইসলাম গ্রহণকারী কিংবা আল্লাহর পরিকল্পনার কাছে প্রথম আত্মসমর্পণকারীতিনি এক আল্লাহর বাণী স্বচ্ছ ও স্পষ্ট করা এবং পূর্ববর্তী ইহুদি ও খ্রিষ্টান বাণীগুলো মানবীয় ব্যাখ্যার কারণে ভুল ও অবিশ্বাসে ভারাক্রান্ত হওয়া থেকে রক্ষার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলেনতবে ওহির ধারা ছিল এক ও অভিন্ন
সনাতন মুসলিম বিশেষজ্ঞরা ইসলামের আত্মপ্রকাশ কোনো ধরনের দুর্ঘটনা তথা এটা খোদায়ি না হওয়ার ধারণা পুরোপুরি নাকচ করে দেনঅন্য কথায় তারা হজরত মুহাম্মদ সা: লাভ করা ওহিতে সম্ভাব্য সব ধরনের বহিরাগত, আঞ্চলিক বা অখোদায়ী উৎস ও প্রভাবের কথা অস্বীকার করেনতাদের নিজস্ব ধর্মতাত্ত্বিক বাধ্যবাধকতার কাঠামোর মধ্যে তা যুক্তিসঙ্গতকিন্তু হজরত মুহাম্মদ সা: যে পরিবেশে বাস করেছিলেন, তাঁর মন, চিন্তা-চেতনা ও ব্যক্তিত্বে নিশ্চিতভাবেই তা প্রভাব বিস্তার করেছে, এটা ওহি ধারণ এবং তাঁর নিজের ও তাঁর অনুসারীরা তাঁর লাভ করা ওহি উপলব্ধি ও প্রয়োগ করার ভঙ্গিকে প্রভাবিত করতএ কারণেই ওহির অভিজ্ঞতা ও ব্যাখ্যায় সম্ভাব্য ও যুক্তিসঙ্গত বহিরাগত প্রভাব, ইতিহাসের অন্যান্য নবি ও ধর্মীয় ব্যক্তির অভিজ্ঞতা ও ওহির তুলনা করাও যুক্তিসঙ্গত
এই সময়টাতে পবিত্র কুরআনের মৌলিক নতুন বিধিবিধানগুলোর বেশির ভাগই আরব উপদ্বীপে সুপরিচিত ছিলযিশুকে মসিহ হিসেবে অস্বীকার করে তাঁকে কেবল আধ্যাত্মিক শক্তিসম্পন্ন রোগ নিরাময়কারী হিসেবে গ্রহণ করার ইহুদি বিশ্বাস দিয়ে শুরু হয়একই সাথে মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে যিশুর প্রকৃতির প্রতিটি বিষয় সম্পর্কে অনুমান করে নানা ধরনের ধর্মভ্রষ্টতাও পরিচিত ছিলবস্তুত পবিত্র কুরআনের কঠোর একেশ্বরবাদ অনেক দিক থেকেই পরবর্তীকালে ইস্টার্ন অর্থোডক্স চার্চের ধর্মভিত্তিক দ্বন্দ্বজনিত মতাদর্শগত আপসমূলক দৃষ্টিভঙ্গির চেয়ে মধ্যপ্রাচ্যের একেবারে প্রাচীনতম খ্রিষ্টানদের দৃষ্টিভঙ্গির বেশ ঘনিষ্ঠ ছিল
হজরত মুহাম্মদ সা: ছিলেন কোনো প্রধান ধর্মের প্রথম নবী, যিনি পুরোপুরি ইতিহাসের আলোতে বাস করেছেনতাঁর জীবন এবং কার্যক্রম-সম্পর্কিত তথ্য প্রচুর পাওয়া যায়, পবিত্র কুরআনে এবং তারচেয়েও বেশি তাঁর সমসাময়িককালের লোকজনের বিবরণ থেকে, যারা হাদিস বা সুন্নাহ হিসেবে ঘটনাগুলো রেকর্ড করেছিলেনকিন্তু তা সত্ত্বেও খ্রিষ্টানসহ অন্য প্রায় সব ধর্ম যেসব সমস্যার মুখোমুখি হয়, ইসলাম সেগুলোর সামনে পড়ে : নবীর জীবন ও কথা নিয়ে সমসাময়িকদের বর্ণনা কতটা নির্ভুল? এসব কথা ও কাজ কেবল মুখে মুখে প্রচারিত হয়েছে, ইসলামে এগুলো লিখিত আকারে সঙ্কলিত, বিশ্লেষিত ও পদ্ধতিগতভাবে মূল্যায়ন হয়েছে আরো শতাধিক বছর পরউদাহরণ হিসেবে বলা যায়, কোন গসপেলগুলো নির্ভরযোগ্য এবং কোনগুলো নয়, তা নির্ধারণ করতে যিশুর জীবনের সব ভাষ্য সংগ্রহ করার ক্ষেত্রে খ্রিষ্টান সমস্যার মতোই এটাএখনো এতে অনুমান-নির্ভরতা রয়ে গেছে এবং সেটা শেষ হওয়ার নয়
ইসলামে হাদিস আক্ষরিকভাবে আল্লাহর কাছ থেকে ওহির মাধ্যমে সরাসরি লাভ করা পবিত্র কুরআনের আয়াতের মতো পবিত্র না হলেও এগুলো ইসলামি আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে পবিত্র কুরআনের চেয়েও অনেক সময় বেশি গুরুত্বপূর্ণ উৎস বিবেচিত হয়েছেকারণ, প্রথম দিকের ইসলামি সমাজ বিনির্মাণে পবিত্র কুরআনে কোনো ইঙ্গিত নেই এমন অনেক সুনির্দিষ্ট ও সুস্পষ্ট ক্ষেত্রে হাদিসই অনেক বেশি কার্যকর গুরুত্বপূর্ণ সূত্র বিবেচিত হয়েছেনবী সা: নিজে প্রাপ্ত ওহিকে কিভাবে বুঝেছেন এবং পরিস্থিতির আলোকে প্রয়োগ করেছেন, সে সম্পর্কেও হাদিস গুরুত্বপূর্ণ ইঙ্গিত দেয়আজ যেসব খ্রিষ্টান বলেন, যিশু কী করতেন? এটা তাদের জন্য একটা উদাহরণ
কিন্তু তার পরও ইসলামের মধ্যে ছোট ছোট অনেক গ্রপ রয়েছে, যারা হাদিসের জটিল ও পরিবর্তনশীল প্রকৃতি, বিশ্বাসযোগ্যতার নানা মাত্রা এবং অনেক সময় কর্তৃপক্ষের নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য একটি রেখে অন্য হাদিস গ্রহণের প্রেক্ষাপটে আসমানি উৎসের কারণে একমাত্র কুরআনকেই ইসলাম বোঝার উৎস হিসেবে স্বীকার করার কথা বলেনএ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা দরকার যে, এটা রিফরমেশন আন্দোলনের সোলা ক্রিপটুরা (কিতাবই একমাত্র) ভিত্তির সাথে তুলনীয়কেবল কিতাবের ভিত্তিতে ধর্মতাত্ত্বিক উপলব্ধি প্রতিষ্ঠার অনুকূলে ওই আন্দোলন বিপুলসংখ্যক চার্চ ইতিহাস, এর প্রাসঙ্গিক বিষয়াদি, কাউন্সিল রুলিং ইত্যাদি প্রত্যাখ্যান করে
একটি নতুন ইসলামি রাজনৈতিক ও ধর্মীয় সম্প্রদায় বিনির্মাণে নতুন ওহিগুলো প্রয়োগ করার ক্ষেত্রে বাস্তব বাধা ছিল বিপুল, বিশেষ করে মক্কার এলিটদের (হজরত মুহাম্মদ সা: বার্তার কারণে তাদের ক্ষমতা, সম্পদ ও মর্যাদা হুমকির মুখে পড়ায়) কাছ থেকে আসা প্রথম দিককার সহিংস বিরোধিতাতাঁর জীবন বিপদের মুখে পড়ল, নবী এবং তাঁর অনুসারীরা মদিনা নগরীতে হিজরত করলেন, সেখানে তিনি প্রথম মুসলিম সমাজ গড়ে তুললেন এবং আমন্ত্রণক্রমে শান্তিপূর্ণ একটি নতুন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে দ্বন্দ্বরত পক্ষগুলোর মধ্যে মীমাংসার ভার নিলেনএটাকে মদিনা সনদ হিসেবে অভিহিত করা হয়এতে নগরীর নানা গ্রপের (ইহুদি, খ্রিষ্টান ও মুসলমান) মধ্যকার অধিকার, দায়দায়িত্ব ও সম্পর্ক সুস্পষ্টভাবে বর্ণিত ও সমন্বিতভাবে একটি দলিলে তুলে ধরা হয়এ দিকে ৬৩০ সালে রক্তপাতহীন বিজয়ের ফলে মক্কার চূড়ান্তভাবে বিরোধিতা পরিত্যাগ এবং নবী সা: সাড়ম্বরে প্রত্যাবর্তনের আগে পর্যন্ত মদিনার মুসলিম সম্প্রদায় অনেক বছর ধরে ইসলাম বৈরী মক্কা বাহিনীর অব্যাহত সামরিক ও রাজনৈতিক হুমকির সম্মুখিন ছিলসদ্য সৃষ্ট সম্প্রদায়টিকে ধ্বংস করতে চাওয়া শত্রদের মোকাবেলায় মুসলিম ঐক্য নিয়ে উদ্বিগ্ন পবিত্র কুরআন উত্তেজনা, বৈরিতা, যুদ্ধ, পরিবর্তনশীল মিত্রতা এবং বিশ্বাসঘাতকতার এ সময়কালটি রহস্যপূর্ণ ও অপেক্ষাকৃত যুদ্ধাকাক্সক্ষামূলক কিছু আয়াতে প্রতিফলন ঘটিয়েছেএসব আয়াতের রহস্যাচ্ছন্নতা ও ক্রোধ ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পথে দাঁড়ানো সেমিটিক গোত্রগুলোর মোকাবেলায় ইসরাইলিদের সংগ্রামের সময়কার মতোই, যখন ওল্ড টেস্টামেন্ট ইহুদিদের সব শত্রকে নির্মমভাবে পুরোপুরি ধ্বংস করার আহ্বান জানিয়েছেউভয় ধর্মেই ওই গোলযোগপূর্ণ সময়ে সমন্বয় সাধন ও শান্তির প্রতি উৎসাহ ছিল না
ইসলাম বিকশিত, বিস্তৃত ও সাম্রাজ্য বিনির্মাণে সম্পৃক্ত হওয়ার ফলে হাদিসের বিশ্বাসযোগ্যতা-সংক্রান্ত সমস্যা একটি বড় রাজনৈতিক জটিলতা সৃষ্টি করেখ্রিষ্টান চার্চের মতো পরবর্তীকালের মুসলিম সেকুলার বা ধর্মীয় কর্তৃপক্ষ ইসলামের বাণী কতটা ভূতাপেক্ষভাবে প্রভাব, নিয়ন্ত্রণ বা ব্যাখ্যা কামনা করেছিল? খ্রিষ্টান ধর্মের বিপরীতে ইসলাম সৌভাগ্যক্রমে নবীর সম্ভাব্য আসমানি মদদ নিয়ে বিতর্ক থেকে রক্ষা পেয়েছেনতিনি বা অন্য কেউ এমন দাবি কখনোই করেননিইসলামের ধর্মতাত্ত্বিক ভিশনের সংযত রেখার কারণেও সম্ভবত খ্রিষ্টানদের চেয়ে এখানে কিতাবগত ব্যাখ্যার ভিত্তিতে ধর্মভ্রষ্টতা ও বিভক্তি অনেক অনেক কমকিন্তু তা সত্ত্বেও পবিত্র কুরআন ও হাদিসের ব্যাখ্যার প্রশ্নটি আজো ইসলামের চলমান ক্রমবিকাশের প্রধান বিষয় হিসেবে রয়ে গেছে 
ইসলাম বিস্তৃত হওয়ার সময় নতুন নতুন ভাষা, ভূগোল, সংস্কৃতি ও ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতার সামনে পড়েঅন্যান্য ধর্মের মতো ইসলামও নতুন বিশ্বাস গ্রহণ ও ধর্মান্তরের ব্যবস্থা করার জন্য স্থানীয় পরিবেশের সাথে নিজেকে খাপ খাইয়ে নেয়অবশ্য পরবর্তীকালের সংস্কারকদের দৃষ্টিতে এসব খাপ খাওয়ানো ও উপজাতগুলো অনৈসলামিক, বিদয়াত বিবেচিত হয়ে ধর্মতাত্ত্বিক পরিশোধন ও মূলে ফেরার প্রয়োজনীয়তা অনুভব হয়েছেএসব ইস্যু ইসলামি পুনর্জাগরণ এবং মৌলবাদের ভিত্তি গঠন করেছেএ ধরনের উপজাত মার্টিন লুথারের মতো প্রাথমিক কালের প্রটেস্ট্যান্ট সংস্কারকদের জন্যও প্রধান ইস্যু ছিল
ধর্ম এবং সেগুলোর অনুসারীদের মধ্যে বিরোধ খুব কম ক্ষেত্রেই সুনির্দিষ্ট ধর্মতাত্ত্বিক মতপার্থক্যের কারণে ঘটে থাকে, বরং তাদের রাজনৈতিক ও সামাজিক জটিলতাই হয় প্রধান কারণআসুন আমরা ইহুদি, খ্রিষ্টান ও ইসলাম ধর্মের মধ্যে তিন ধারার সম্পর্কের মধ্যে অস্তিত্বশীল সত্যিকারের ধর্মতাত্ত্বিক পার্থক্যের নির্যাস পরীক্ষা করে দেখিএসব ধর্মতাত্ত্বিক পার্থক্য প্রাচীন ও মধ্যযুগের মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে বাস্তবে আসলেই কতটুকু সত্যিকারের পার্থক্য সৃষ্টি করত? আমরা আরো ঘনিষ্ঠভাবে তাকালে দেখি, একেশ্বরবাদের সুনির্দিষ্ট মৌলিক যুক্তিগুলোই এই অঞ্চল ও সংস্কৃতিকে বারবার প্লাবিত করেছেআমরা লক্ষ করি, ক্ষেত্রটিকে ধর্মতাত্ত্বিক রূপান্তর না করে ইসলাম বরং অন্য দুটি ধর্মের মধ্যে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করেছে, এক ধরনের ধর্মতাত্ত্বিক ধারাবাহিকতা জোরদার করার ভান করেছেইহুদি-খ্রিষ্টান বিশ্বাসের কাছে অপরিচিত অনেকটা সংহতি নাশক সাংস্কৃতিক ও ধর্মতাত্ত্বিক শক্তিই ইসলাম প্রতিনিধিত্ব করে কিংবা পরবর্তীকালে সৃষ্ট পাশ্চাত্যবিরোধী অনুভূতির ভিত্তিভূমি গঠন করেছে বলে আধুনিক জনপ্রিয় তত্ত্বগুলোর লক্ষ্য ইসলামকে এর সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট থেকে পুরোপুরি নির্মূল করে দেয়াবস্তুত, ইসলাম পাশ্চাত্যের প্রতি বেশ প্রতিরোধমূলক মনোভাবসহ মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে গভীর সাংস্কৃতিক, দার্শনিক ও ধর্মীয় ধারার প্রতিনিধিত্ব ও সম্প্রসারিত করেছেইসলাম ওইসব ধারার সৃষ্টি করেনি, ইসলামকে সরিয়ে নেয়া হলেও এসব ধারা বহাল থাকবেএই তিন ধর্ম একে অপরকে কিভাবে দেখে, আসুন আমরা তা বিবেচনা করি
অনুলিখন মুফতি ওসমান আল-হুমাম 
মুহাদ্দিস জামিয়া কুরআনিয়া দারুল উলূম ওসমানাবাদ রাজঘাটা চট্টগ্রাম

ইসলামী রাজনীতির স্থপতি আল্লামা আতহার আলী


লাহোর প্রস্তাব

লেখক:মুফতি ওসমান আল-হুমাম 

মুহাদ্দিস. জামিয়া কুরআনিয়া দারুল উলূম ওসমানাবা রাজঘাটা চট্টগ্রাম।
ইসলামী রাজনীতির স্থপতি আল্লামা আতহার আলী রহ.


রাজনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ, সমাজ সংস্কারক আলেমেদীন, যোগ্য সংগঠক এবং এদেশের ইসলামী রাজনীতির মহান স্থপতি ও পথিকৃৎ আল্লামা আতহার আলী রহ.
হযরত আতহার আলী রহ. ১৮৯১ সনে মোতাবেক ১৩০৯ হিজরী সিলেটের বিয়ানীবাজার থানার গোঙ্গাদিয়া গ্রামের এক ধর্মপরায়ণ মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেনকথিত আছে, তার পূর্ব পুরুষগণ উত্তর ইরান থেকে প্রাচীন মুসলিম শাসকদের আমলে সিলেটে এসে বসবাস করেনতিনি নিজ এলাকাতেই প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা সমাপ্ত করার পর মুরাদাবাদের কাসেমিয়া মাদরাসায় ও রামপুর মাদরাসায় বিভিন্ন শাস্ত্রে জ্ঞান অর্জন করেনঅতঃপর সাহারানপুর ও পরে বিশ্ববিখ্যাত দারুল উলূম দেওবন্দে শিক্ষাগ্রহণ করেনতঁর উস্তাদদের মধ্যে ছিলেন আল্লামা আনওয়ার শাহ কাশ্মিরী, পাকিস্তানের অন্যতম প্রবক্তা মাওলানা শাব্বীর আহমাদ উসমানী ও জাফর আহমাদ উসমানীর মত প্রমুখ মনীষীগণশিক্ষা সমাপ্তির পর আতহার আলী রহ. উপমহাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ইসলামী সংস্কারক, আধ্যাত্মিক সাধক ও হাজারের অধিক গ্রন্থ প্রণেতা মাওলানা আশরাফ আলী থানবীর রহ. কাছে আধ্যাত্মিক প্রশিক্ষণ লাভ ও রূহানী তাযকিয়াহ তারাক্কি অর্জন করেন এবং তার থেকে খেলাফতপ্রাপ্ত হয়ে দেশে প্রত্যাবর্তন করেন
উস্তাদদের প্রতি যে তার কত গভীর শ্রদ্ধা ছিল, তাদের পবিত্র স্মৃতি নিজের অন্তরে জাগরুক রাখার জন্যে পুত্রের নাম আনোয়ার শাহ এবং দাদা পীর হাজী এমদাদুল্লাহ মহাজিরে মক্কীর রহ. নামে তার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নাম জামিয়া ইমদাদিয়া নামকরণ থেকেই তা সহজে অনুমেয়
দেশে ফিরে আল্লামা আতহার আলী ইসলামী শিক্ষা বিস্তারের কাজে আত্মনিয়োগ করেনতিনি সিলেট এবং কুমিল্লার জামিয়া মিল্লিয়া (বর্তমানে কাসেমুল উলূম) ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জামিয়া ইউনুসিয়াসহ একাধিক মাদরাসায় শিক্ষকতা করেনঅতঃপর কিশোরগঞ্জের একটি মাদরাসায় শিক্ষকতা ও পরে ঐতিহাসিক শহীদী মসজিদের ইমাম নিযুক্ত হন এবং একজন পীর হিসাবে ইসলামের যাবতীয় শিক্ষা আদর্শ প্রচার করতে থাকেনতখন তিনি ইসলামী আন্দোলন তথা রাজনীতির ফাউন্ডেশন বা প্রাথমিক স্তর বিনির্মাণে আত্মনিয়োগ করেন এবং মানুষকে এরশাদ ও নসীহতের মাধ্যমে ধর্মপরায়ণ করে তোলেন, জায়গায় জায়গায় মাদরাসা মক্তব স্থাপন করেনফলে তাকে কেন্দ্র করে কিশোরগঞ্জ এলাকায় একটি সুন্দর ইসালামী পরিবেশ গড়ে উঠেতার খ্যাতি বাইরের অন্যান্য জেলায়ও ছড়িয়ে পড়ে
আল্লামা আতহার আলীর শিক্ষাজীবন যেসব মহামনীষীর সংস্পর্শে অতিবাহিত হয়ে ছিল, তারা যেমন ছিলেন ইসলামী বিশেষজ্ঞ, উঁচু স্তরের পণ্ডিত ও জ্ঞানতাপস, তেমনি ছিলেন বিশ্ব পরিস্থিতির ব্যাপারেও সচেতন এবং ইংরেজবিরোধী আন্দোলনে ও রাজনীতিতে যাদের ছিল সক্রিয় পদচারণাতার উস্তাদদের মধ্যে শাব্বীর আহমাদ উসমানী, জাফর আহমাদ উসমানী, আনোয়ার শাহ কাশ্মিরী এবং আধ্যাত্মিক গুরু আশরাফ আলী থানবী রহ., যারা অবিভক্ত ভারতের আজাদী আন্দোলনের ত্যাগী ও সংগ্রামী সিপাহসালার ছিলেনফলে শিক্ষকদের প্রভাবে হযরত আতহার আলীর মধ্যেও স্বাভাবিকভাবেই ছাত্রজীবন থেকে রাজনৈতিক ভাবধারা ও সচেতনতার উন্মেষ ঘটেছিল
আর যেহেতু পরাধীন ভারত থেকে ইংরেজ উৎখাত আন্দোলন ও ইসলামী তাহযীব-তামাদ্দুন প্রতিষ্ঠার সংকল্প নিয়ে প্রতিষ্ঠিত দারুল উলূম দেওবন্দ, সেহেতু এর শিক্ষানবীশ পরিবেশটাও ছিল রাজনৈতিক ভাবধারায় আচ্ছন্নফলে সে পরিবেশে অধ্যয়নের সুবাধে তখন থেকে তার মধ্যেও রাজনৈতিক চিন্তা-চেতনার উম্মেষ ঘটেতার এই চিন্তা-চেতনা ও সচেতনতা উত্তরকালে দেশ, জাতি ও ধর্মের মহান কল্যাণ সাধনে রাজনৈতিক অঙ্গনে টেনে আনেবস্তুত তার রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতা নিজের শিক্ষা পরিবেশ ও তৎকালীন রাজনৈতিক পারিপার্শিকতা থেকে উদগত
বৃটিশবিরোধী আজাদী আন্দোলন যখনই গতি সম্পন্ন হচ্ছিল, ভারতের জনগণ তখনই দুটি শিবিরে বিভক্ত হয়ে পড়ছিল। (ক) মুসলিম দল (খ) হিন্দু দলঅর্থাৎ খণ্ড ভারত আর অখণ্ড ভারতের দুটি দলেহিন্দুরা চেয়েছিল ইংরেজরা যেভাবে প্রায় দুইশত বছর মুসলমানদের শোষণ ও নির্যাতন চালিয়েছে, ভারতকে অখণ্ড রেখে মুসলমানদের স্বকীয়তা ও স্বাতন্ত্র্য বিনাশ করে ঠিক সেভাবে আজীবন তাদের শোষণ ও নির্যাতনের বন্দবস্ত করাএতে ইংরেজদেরও সায় ছিলকিন্তু ইউরোপীয় ও মঙ্গলীয় আর্যদের এই নীলনকশায় বাঁধ সেধে বসে ছিল আপামর সচেতন মুসলিম জনগণআর প্রত্যক্ষ নেতৃত্বে ছিলেন কায়েদে আযম মোহাম্মাদ আলী জিন্নাহ, মাওলানা শাব্বীর আহমাদ উসমানী, শেরে বাংলা এ.কে ফজলুল হক, মাওলানা জাফর আহমাদ উসমানী, আল্লামা আযাদ সোবহানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, আল্লামা আতহার আলী ও মাওলানা সৈয়দ মোসলেহ উদ্দীন প্রমুখ রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গযে ভাবনার দার্শনিক ও আধ্যাত্মিক উদ্যোক্তা ছিলেন হাকীমুল উম্মত আশরাফ আলী থানবী রহ. ও আল্লামা ইকবাল রহ.
আতহার আলী রহ. ১৯৪৫ সনে বঙ্গীয় ওলামা-মাশায়েখদেরকে নিয়ে নিখিল ভারতীয় ওলামা কনফারেন্সের আয়োজন করেন২৫ মে কলিকাতা মোহাম্মাদ আলী পার্কে আল্লামা আযাদ সোবহানীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মহাসম্মেলনে মাওলানা শাববীর আহমাদ উসামানীকে প্রধান করে জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম গঠিত হয়এই ঐতিহাসিক মহাসম্মেলন আয়োজনে আরো যেসব বঙ্গীয় ওলামায়েকেরামের অনবদ্য অবদান রয়েছে, তারা হলেন মাওলানা নেসার উদ্দীন আহমাদ (পীর সাহেব শর্ষীনা), মাওলানা সৈয়দ মুসলেহ উদ্দীন, মুফতী দ্বীন মুহাম্মাদ খাঁ ও মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরী রহ.
অতঃপর আল্লামা আতহার আলী পৃথক মুসলিম আবাসভূমি তথা পাকিস্তান কায়েমের লক্ষ্যে সমগ্র ভারতবর্ষ চষে বেড়ান ও প্রধান প্রধান শহরসমূহে সভা-সম্মেলনের আয়োজন করেন, বক্তৃতা দিয়ে পাকিস্তানের পক্ষে জনমত গড়ে তোলেন এবং মুসলমানদের মাঝে ঐক্যের প্রাচীর তৈরি করেনতিনি মুসলিম লীগের ঐতিহাসিক সিমলা কনফারেন্স ও বাংলার প্রতিনিধিত্বকারী নেতৃবৃন্দের অন্যতম ছিলেনযাদের মধ্যে ছিলেন শেরে বাংলা এ.কে ফজলুল হক, মাওলানা আকরম খাঁ, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, খাজা নাজিমুদ্দীন ও তাজুদ্দীন খান প্রমুখ নেতৃবৃন্দ
উল্লেখ্য, ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবে শেরে বাংলা এ.কে ফজলুক হক কর্তৃক পঠিত প্রস্তাব প্রণয়নে তার অবদান ছিল সিংহভাগএবং তা তিনি করেছিলেন মুর্শিদ মাওলানা আশরাফ আলী থানবীর রহ. বিশেষ ইঙ্গিতেলাহোর প্রস্তাব ঘোষণার ঐতিহাসিক সেই ছবিতে শেরে বাংলার পাশেই আল্লামা আতহার আলী ছিলেন
লাহোর প্রস্তাবে অংশগ্রহণকারী নেতৃবর্গ
আর সিলেট রেফারন্ডমে যারপর নাই ভূমিকার স্বীকৃতি স্বরূপ সিলেট আজ বাংলাদেশের অংশযেহেতু সিলেট তার জন্মভূমিতাই সিলেট পাকিস্তানের অন্তর্ভূক্ত হবে না! বিষয়টি স্বভাবতই তার পক্ষে মেনে নেয়া ছিল দুস্করতাই তিনি উত্তর প্রদেশের পাশাপাশি সিলেট রেফারন্ডমে পাকিস্তানের পক্ষে ভূমিকা পালন করেনতাতে তার অন্যতম সহযোগী ছিলেন মাওলানা সৈয়দ মুসলেহ উদ্দীন রহ. এবং তাতে পাকিস্তানের পক্ষে সকল আলেম, রাজনীতিবিদগণ ও সমাজ সচেতন নাগরিকবৃন্দ বিশেষ ভূমিকা রাখেন
অবশেষে বহু প্রত্যাশিত সেই দিবসটি আসলজীবনের সর্বক্ষেত্রে ইসলাম কায়েমের প্রতিশ্রুতি নিয়ে ১৪ আগস্ট ৪৭ সালে কায়েম হল পাকিস্তানপূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে একইসঙ্গে স্বাধীন পতাকা উত্তোলন করলে পাকিস্তান আন্দোলনে দুই অগ্রসৈনিক সিপাহসালার আল্লামা আতহার আলীর দুই উস্তাদ মাওলানা শাব্বীর আহমাদ উসমানী ও মাওলানা জাফর আহমাদ উসমানী
সৃষ্টি হলো ইতিহাসশুরু হলো নতুন দিনের যাত্রাকিন্তু শুরুতেই হোঁচট, বিতর্কইংরেজ বেনিয়াদের মানসিক উত্তরসূরি আমলা ও ওজির-ওজারাদের বিপত্তির কারণে কায়েদে আযম মোহাম্মাদ আলী জিন্নাহ প্রতিশ্রুত ইসলামী নেজাম কায়েমে হলেন ব্যর্থইতোমধ্যে সাধারণ জনগণের চাপে এবং মাওলানা শাব্বীর আহমাদ উসমানীর বলিষ্ট নেতৃত্বের কাছে পরাজিত হয় মুসলিম লীগ অনীহা সত্ত্বেও ১৯৪৯ সনে ইসলামী হুকুমাত কায়েমের লক্ষ্যে একটি আদর্শ প্রস্তাব গ্রহণে বাধ্য হয়কিন্তু এরইমাঝে মোহাম্মাদ আলী জিন্নাহ ও আল্লামা শাব্বীর আহমাদ উসমানী দুইজনেই ইন্তেকাল করায় মুসলিম লীগে ঘাপটি মেরে থাকা ইসলামবিরোধী মহলটি মাথাচাড়া দিয়ে উঠে এবং ইসলামী নেজাম কায়েমের লক্ষ্যে আদর্শ প্রস্তাবের পরবর্তী ধাপ হয়ে বাধাগ্রস্তজাতি আবার পতিত হয় হতাশার তিমিরেপাকিস্তান আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী বেশিরভাগ আলেমই মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন এবং রাজনীতিতে নিরুৎসাহিত হয়ে যার যার কর্মক্ষেত্র মসজিদ, মাদরাসা ও খানকায়ে নির্দিষ্ট হয়ে পড়েনএমতাবস্থায় আতহার আলী রহ. ইসলাম কায়েমের মহান ব্রত নিয়ে নিজ উস্তাদের অসামাপ্ত কাজকে আঞ্জাম দেয়ার লক্ষ্যে ভারতবর্ষে সুলতান শিহাবুদ্দীন ঘুরির ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। (দ্বিতীয় ও শেষ কিস্তি পরের বার)
লেখক:  


শুক্রবার, ৬ মে, ২০১৬

আসহাবে কাহাফ কারা ?

 গ্রন্থনায়। মুফতি ওসমান আল-হুমাম 

সিনিয়র মুহাদ্দিস
জামিয়া কুরআনিয়া দারুল উলূম ওসমানাবাদ
রাজঘাটা, লোহাগাড়া,চট্টগ্রাম।
=============================
আসহাবে কাহাফ(গুহাবাসী) নামটা আমরা সবাই শুনেছি, সেই আল্লাহর প্রি বান্দাদের স্থানটি seven sleepers নামে বিদেশে পরিচিততাদের সেই গুহার স্থানটি জর্দানের আম্মানে আসহাবে কাহাফ স্টেটে অবস্থিততাদের শরিরের হাড় ও সেই স্থানের কিছু ছবি ও ঘটনা দেয়া হল
সূরা কাহাফ; আয়াত ১১-১৪ (পর্ব-৩)
সূরা কাহাফের ১১ ও ১২ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
فَضَرَبْنَا عَلَى آَذَانِهِمْ فِي الْكَهْفِ سِنِينَ عَدَدًا (11) ثُمَّ بَعَثْنَاهُمْ لِنَعْلَمَ أَيُّ الْحِزْبَيْنِ أَحْصَى لِمَا لَبِثُوا أَمَدًا (12)
এরপর আমি গুহার ভেতরে তাদের কানের উপর কয়েক বছরের জন্য নিদ্রারপর্দা টেনেদিয়েছিলাম” (১৮:১১)
পরবর্তীতে আমিতাদের জাগিয়ে দিলাম এ পরীক্ষা করার জন্য যে,দুই দলের মধ্যে কোন্‌ দল (গুহায়) তাদের অবস্থানকাল সঠিকভাবে নির্ণয় করতে পারে” (১৮:১২)
আগের আয়াতে আমরা আলোচনা করেছি, কিছু ঈমানদার লোক ঈমান রক্ষা করার জন্য নিজেদের শহর ত্যাগ করে গুহার মধ্য লুকিয়ে ছিলেনসে সময় তারা আল্লাহর কাছে নিজেদের মুক্তির জন্য আবেদন করেনআর এ আয়াতে বলা হচ্ছে, আল্লাহ তাদের চোখে এত গভীর ঘুম দিয়ে দেন যে, তাতে শুধু তাদের চোখই বন্ধ হয়নি, সেই সঙ্গে তাদের কানের উপরও এক ধরনের পর্দা টানা হয়েছিল যাতে কোনো শব্দ তাদের ঘুম ভাঙাতে না পারে
এখানে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, আল্লাহ এ কথা বলেননি যে, তাদের চোখে আমি গভীর ঘুম দিয়েছিলামবরং বলেছেন, তাদের কানের উপর নিদ্রার পর্দা টেনে দিয়েছিলামসাধারণত ঘুমের সময় মানুষের চোখ বন্ধ থাকলেও কান খোলা থাকে এবং শুনতে কোনো সমস্যা হয় নাএ কারণে বাইরের শব্দে মানুষের ঘুম ভেঙে যায়কিন্তু আসহাবে কাহাফের ঈমানদার পুরুষদের ঘুম যাতে কোনো শব্দে ভেঙে না যায় সেজন্য আল্লাহ তাদের কানের উপর নিদ্রার পর্দা টেনে দিয়েছিলেনএ দুই আয়াতের পরবর্তী অংশে আরো বলা হয়েছে: তাদেরকে ঘুম থেকে জাগিয়ে দেয়ার পর তারা ঠিক কত সময় ঘুমিয়ে ছিলেন এ নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়পরের আয়াতে এ বিষয়ে আলোচনা করা হবে
এ দুই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হচ্ছে:
১. আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে যদি কেউ বিদ্রোহ করে তাহলে আল্লাহ তাকে বিভিন্নভাবে দয়া ও সাহায্য করেনএ সাহায্য পাওয়ার জন্য জেগে থাকতেই হবে এমন কোনো কথা নেই, ঘুমের মধ্যেও সে সাহায্য পৌঁছে যায়
২. আল্লাহ সব বস্তু ও মানুষের ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখেন এবং সবকিছু জানেনযদিও মানুষ নিজের ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনের বহু বিষয় উপলব্ধি করতে পারে না বা সব বিষয় তার নিজের কাছেই স্পষ্ট নয়
সূরা কাহাফের ১৩ ও ১৪ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
نَحْنُ نَقُصُّ عَلَيْكَ نَبَأَهُمْ بِالْحَقِّ إِنَّهُمْ فِتْيَةٌ آَمَنُوا بِرَبِّهِمْ وَزِدْنَاهُمْ هُدًى (13) وَرَبَطْنَا عَلَى قُلُوبِهِمْ إِذْ قَامُوا فَقَالُوا رَبُّنَا رَبُّ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ لَنْ نَدْعُوَ مِنْ دُونِهِ إِلَهًا لَقَدْ قُلْنَا إِذًا شَطَطًا (14)
আপনার কাছে তাদের ইতিবৃত্ত সঠিকভাবে বর্ণনা করছিতারা ছিল কয়েকজনযুবকতারা তাদের পালনকর্তার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেছিল এবং আমি তাদেরসত্‌পথে চলার শক্তি বাড়িয়ে দিয়েছিলাম”(১৮:১৩)
আমি তাদের মন দৃঢ় করেছিলাম,যখন তারা উঠে দাঁড়িয়েছিল (বা অত্যাচারী শাসকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল)অতঃপর তারা বলল:আমাদের প্রভু আসমান ও জমিনের পালনকর্তাআমরা কখনও তার পরিবর্তে অন্য কাউকে উপাস্য বলে স্বীকার করব নাযদি করি,তবে তা হবেঅত্যন্ত গর্হিত কাজ” (১৮:১৪)
আসহাবে কাহাফের ঘটনা সংক্ষিপ্তভাবে বর্ণনা করার পর এ আয়াতে তাদের দেশত্যাগের ঘটনা বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করা হয়েছেপ্রথমে বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (স.)কে উদ্দেশ করে আল্লাহ বলেন: আসহাবে কাহাফের যুবকদের সম্পর্কে মানুষের মধ্যে নানা ধরনের ধারণা প্রচলিত থাকতে পারেকিন্তু আল্লাহর পক্ষ থেকে এ সম্পর্কে যা কিছু বলা হচ্ছে তাই সত্য ও বাস্তব
তারা কতজন ছিলেন, কতদিন গুহার মধ্যে লুকিয়ে ছিলেন এবং ইতিহাসের ঠিক কোন্‌ সময়ে এ ঘটনা ঘটেছিল তা গুরুত্বপূর্ণ নয়গুরুত্বপূর্ণ হল তারা ঈমানদার ছিলেন এবং নিজেদের ঈমান রক্ষা করার জন্য তারা অত্যাচারী শাসকের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন এ কারণে আল্লাহ তাদেরকে বিশেষভাবে হেদায়েত করেন এবং তাদের অন্তর সুদৃঢ় করে দেন যাতে তারা যে কোনো ধরনের সমস্যা মোকাবিলা করতে পারেনএমনকি বস্তুগত লোভ-লালসা বা পরিবার-পরিজনের প্রতি মায়া-মমতাও তাদেরকে ঈমানের পথ থেকে ফিরিয়ে রাখতে পারেনি
সাধারণত পাপাচারে পরিপূর্ণ সমাজে বসবাসকারী মানুষের মধ্যে তিনটি ভাগ লক্ষ্য করা যায়প্রথম দলের লোকজন সমাজের সঙ্গে মিশে যায়, তারা স্বাধীনভাবে চিন্তা করতে বা স্বতন্ত্র মতামত প্রকাশ করতে পারে নাদ্বিতীয় দল সমাজে প্রচলিত পাপাচার থেকে নিজেদের রক্ষা করে চলেনকিন্তু তৃতীয় দল শুধু নিজেদেরই বাঁচিয়ে রাখেন না, সেইসঙ্গে সমাজকেও পাপমুক্ত করার জন্য আন্দোলন করেননবী-রাসূল ও ঈমামগণ ছিলেন এসব সমাজ সংস্কারকদের অন্যতম
আসহাবে কাহাফের পুরুষরা ছিলেন দ্বিতীয় দলের অন্তর্ভূক্ততারা পাপাচারের গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে না দিয়ে দ্বীন রক্ষা করতে গিয়ে কঠিন সমস্যার মধ্যে পড়েন, এমনকি নিজেদের জীবনকে বিপদে ফেলতেও তারা দ্বিধা করেননি
অবশ্য তারা নিজেদের বিশ্বাস প্রকাশের ক্ষেত্রে কোনো হুমকিকে ভয় পাননিতারা পরিষ্কার ভাষায় শিরক ও মুর্তি পূজাকে ভ্রান্তি ও মিথ্যাচার বলে ঘোষণা করতেনসেইসঙ্গে প্রকাশ্যে আল্লাহর একত্ববাদের কথাও প্রচার করেন তারাআল্লাহর পথ ছাড়া অন্য সব পথকে ভুল ও বাতিল বলে উল্লেখ করেন এসব ঈমানদার মানুষ
যাই হোক, পবিত্র কুরআনের শিক্ষার অন্যতম পদ্ধতি হল- অতীত ইতিহাস তুলে ধরে তা থেকে শিক্ষা নিতে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করাএ কারণে কুরআনের একটি বড় অংশ জুড়ে অতীত জাতিগুলোর ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছেতবে এ ইতিহাস কাল্পনিক বা বানোয়াট কোনো গল্প নয়বিভিন্ন দেশ ও জাতির কবি-লেখকরা কল্পনা করে যে কাহিনী লিখে থাকেন, পবিত্র কুরআনের কাহিনী তা থেকে সম্পূর্ণ আলাদাকুরআনের এসব কাহিনীতে ইতিহাসের ঘটনা হুবহু তুলে ধরা হয়েছে
এ দুই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হচ্ছে:
১. আল্লাহপাক মানুষকে শিক্ষা দেয়ার জন্য পবিত্র কুরআনে বিভিন্ন কাহিনী বর্ণনা করেছেনএসব কাহিনী বাস্তব ঘটনার ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে, মনগড়া গল্প নয়
২. কেউ ঈমানের পথে চলার চেষ্টা করলে আল্লাহ তার ঈমানকে সুদৃঢ় করে দেনএ অবস্থায় ঈমানদার ব্যক্তি পরিপূর্ণতার দিকে ধাবিত হন


৩. অত্যাচারী শাসক ও পথভ্রষ্টদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হলে দৃঢ় ও শক্তিশালী ঈমানের প্রয়োজন, যা আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ ছাড়া অর্জন করা সম্ভব নয়

বৃহস্পতিবার, ৫ মে, ২০১৬

ktnbd: কাদিয়ানীরা কাফের কেন?

ktnbd: কাদিয়ানীরা কাফের কেন?: লিখেছেন মুফতি ওসমান আল হুমাম  মুহাদ্দিস জামেয়া কুরআনীয়া দারুল উলূম ওসামানাবাদ, রাজঘাটা, লোহাগাড়া, চট্টগ্রাম। কাদিয়ানীরা কাফের কেন? ...

সোমবার, ২ মে, ২০১৬

কাদিয়ানীরা কাফের কেন?


লিখেছেন মুফতি ওসমান আল হুমাম 
মুহাদ্দিস জামেয়া কুরআনীয়া দারুল উলূম ওসামানাবাদ, রাজঘাটা, লোহাগাড়া, চট্টগ্রাম।
কাদিয়ানীরা কাফের কেন?
==================
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম
الحمد لله وحده، وصلوات الله وسلامه على من لا نبي بعده، وبعد!
কাদিয়ানীদের বাহ্যিক চাকচিক্যময় কথা-বার্তায় অনেকেই প্রতারিত হয় এবং প্রশ্ন রাখে কাদিয়ানীদেরকে খারাপ বল কেন? তারা তো নিজেদেরকে মুসলিমই বলে থাকে।
এ উদ্ভূত প্রশ্নের উত্তর দিতে হলে আমাদের নিম্নের কয়েকটি বিষয়ের দিকে দৃষ্টি দিতে হবে।
ক. তাদের ইতিহাস
খ. তাদের আকিদা বিশ্বাস
গ. তাদের দৈনন্দিন সম্পাদিত কার্যাদি, অর্থাৎ আরকানে ইসলাম সম্পর্কে তাদের মতামত।
ক. তাদের ইতিহাস
প্রথমেই যেটা লক্ষ্যণীয় তা হলো: ব্রিটিশ উপনিবেশবাদীদের প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ সাহায্যে মীর্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী এ দলটি প্রতিষ্ঠা করেছিল। যারা ১৮৮৯ সালে ব্রিটিশের আনুগত্যের প্রতি নিষ্ঠাবান বলে সনদ লাভ করে এবং ১৯০০ সাথে ভারতস্থ ব্রিটিশ শাসনের অধীন ধর্মীয় দল হিসাবে নিবন্ধিত হয়। ১৯০৮ সালে যখন গোলাম আহমদ কাদিয়ানী মারা যায়, তখন থেকেই তাদের মধ্যে বিভিন্ন ব্যাপারে মত-পার্থক্য দেখা দিতে থাকে১৯১৪ সালে তা প্রকটরূপ লাভ করে, যার পরিনতিতে তারা দু’টি উপদলে বিভক্ত হয়ে পড়ে। ক. কাদিয়ানী: যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী তনয় মীর্যা বশীরুদ্দীন মাহমুদের নেতৃত্বাধীন. খ. লাহোরী: যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানীর নবুওয়াতের দাবীর প্রধান পৃষ্ঠপোষক মৌলবী মুহাম্মাদ আলীর নেতৃত্বাধীন। তাদের এ দু’টি উপদল ১৯৪৭ সাল থেকে পাকিস্তানের মাটিতে কাজ করছে,  তবে ১৯৭৪ সালে পাকিস্তান কর্তৃক তাদেরকে অমুসলিম সংখ্যালঘু বলে ঘোষিত হয়। ১৯৮৪ সালে পাকিস্তানে তাদের কর্মকাণ্ডের উপর নিষেধাজ্ঞা জারী করা হয়। ফলে তাদের বর্তমান নেতা: মীর্যা তাহের আহমাদ (গোলাম আহমাদ কাদিয়ানীর পৌত্র) পাকিস্তান থেকে পালিয়ে নিয়ে লন্ডনে স্বেচ্ছা নির্বাসনে রয়েছে। এ দিকে তাদের লাহোরী গ্রুপ পাঞ্জাবের দারুস্‌সালাম পল্লীতে তাদের আস্তানা গাড়ে, তবে তাদের প্রচার ও প্রসার অপরটির তুলনায় বেশী নয়। কিন্তু সবচেয়ে দুঃখজনক হলো যে, বিশ্বের সবচেয়ে বড় ইউনিভার্সিটিগুলো, (যেমন শিকাগো ইসলামিক ইউনিভার্সিটি যা তাদের প্রতিষ্ঠিত), বিভিন্ন ইসলামী দেশ ও প্রতিষ্ঠান থেকে তাদের শিক্ষায় শিক্ষিত করার জন্য ছাত্র গ্রহণ করে এবং তাদেরকে ব্রেন ওয়াশ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিভিন্ন প্রকার সুযোগ সুবিধা দ্বারা আকৃষ্ট করার ও ধর্মান্তরিত করার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে।
খ. তাদের আক্বীদা ও বিশ্বাস
১. আল্লাহর উপর ঈমান সম্পর্কে:
মুসলিম মাত্রই এটা বিশ্বাস করে যে, আল্লাহ তা‘আলার উপর বিশ্বাস তিন দিক থেকে হতে হয়:
এক: সমস্ত সৃষ্টি জগতের সৃষ্টি করা, পালন করা, আইন দান, মৃত্যু ও জীবন দান এগুলো একমাত্র আল্লাহ তা‘আলারই বিশেষত্ব। দুই: অনুরূপভাবে যিনি সৃষ্টি করেন, লালন করেন, জন্ম মৃত্যু প্রদান করেন জীবন বিধান নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন শুধু সে আল্লাহই যাবতীয় ইবাদত বা উপাসনার একমাত্র হক্কদার, অন্য কেউ এতে অংশীদার নয়সুতরাং দো‘আ,  মান্নত, কুরবানী, বিপদমুক্তি, সাহায্য ইত্যাদি তথা সর্বপ্রকার ইবাদতে একমাত্র তাঁকেই উদ্দেশ্য করতে হবে। তিন: আল্লাহ তা‘আলা ও তাঁর রাসূল কতৃক আল্লাহর জন্য নির্দিষ্টকৃত নাম ও গুণাগুণকে কোন প্রকার পরিবর্তন ও বিকৃত না করে তাঁর উপযোগী যেভাবে হবে সেভাবে তার জন্য তা সাব্যস্ত করা। কিন্তু যদি কাদিয়ানীদের দিকে দৃষ্টি দেয়া হয় তাহলে দেখা যাবে তারা এ তিনটি বিশ্বাসেই মুসলিমদের আক্কীদা-বিশ্বাসের বিরোধিতা করছে। যেমন: মীর্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী ‘শিরক ফির রাবুবিয়াত’ বা আল্লাহ তা‘আলার সাথে নিজেকেও সবকিছুর স্রষ্টা ও মালিক বলে দাবী করেছে। এ ব্যাপারে তার মতামত হলো: সে এ মর্মে ওহী বা বাণী পেয়েছে যে, তাকে বলা হচ্ছে:  “আমার যেমন আকাশ ও ভুমণ্ডলের মালিকানা রয়েছে তেমনি তা তোমারও।”[1] এ কথা ঠিক রাখতেই সে তার উর্দু ‘তাওদীহুল মারাম[2] বইয়ে আল্লাহ তা‘আলাকে ভয়ঙ্কর সামুদ্রিক  অক্টোপাস[3] এর সাথে তুলনা করেছে। অনুরূপভাবে ইবাদত যে, শুধুমাত্র আল্লাহকেই করতে হবে তাতেও সে দ্বিমত পোষণ করেছে, বরং আল্লাহর সাথে তারও ইবাদত করার জন্য সে লোকদের আহবান করেছে’ যেমন:  তার দাবী অনুযায়ী তার কাছে এই মর্মে বাণী এসেছে (!) যে:  “তোমার সাথে আমার সম্পর্ক হলো, তুমি আমার সাথে একীভূত, একই সূত্রে গ্রথিত...... আল্লাহ তোমার পবিত্রতা জপ করছে ..... আর যে কেউ আল্লাহর প্রকাশ্য রূপের[4] সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়, তার কাছে কোন মঙ্গল নেই।”[5] আল্লাহর একত্ববাদের প্রমাণবাহী কুরআন-হাদীস কর্তৃক প্রমাণিত আল্লাহর নাম ও গুনাবলীসমূহ সম্পর্কে তার মতামত আরো জঘন্য সে আল্লাহকে এমন কতেক নাম ও গুণে বিভূষিত করেছে যা কক্ষনো আল্লাহর (স্রষ্টার) শান এর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে পারে না। বরং তা কেবল বান্দার (সৃষ্টিজগতের) গুণই হতে পারে; যেমন সে বলছে “আল্লাহ .... তরবারী নির্মাতা[6] আরও বলছে: “আমার রব চৌকিদারের মত আমার সামনে সামনে হাঁটে।”[7] উপরন্তু সে সর্বেশ্বরবাদ (وحدة الوجود-Pantheism) বা জগতের সবকিছু এক, তথা সৃষ্টি জগত এবং স্রষ্টা একই বস্তুর দুইদিক, এ ভ্রান্ত বিশ্বাসের প্রবক্তা। তাই সে তার আরবী গ্রন্থ (الاستفتاء) তে তার দাবী মোতাবেক আল্লাহর সাথে কথোপকথনের সময় আল্লাহ তা‘আলা নাকি তাকে বলছে (!) “তুমি আমার থেকে, আর আমি তোমার থেকে।”[8]  অন্য এক স্থানে আল্লাহকে তার মহৎ গুণাগুণের বিপরীত গুণে ভূষিত করেছে। যেমন: তার দাবী অনুসারে আল্লাহর সাথে কথোপকথনের সময় তার কাছে নাকি এ মর্মে বাণী এসেছে যে,  “তোমার সাথে আমার সম্পর্ক পিতা পুত্রের সম্পর্ক, তুমি আমার পুত্রতুল্য।”[9] এতেই শেষ নয় বরং অন্য স্থানে বলছে তার কাছে নাকি ওহী এসেছে এই বলে যে,  “হে আল্লাহর নবী! আমি তোমাকে চিনতে পারি নি[10]  এ হলো তাওহীদ বা একত্ববাদ  সম্পর্কে কাদিয়ানীদের মোটামুটি সংক্ষিপ্ত বিশ্বাস প্রত্যেক মুসলিমকেই তাদের এ বিশ্বাস সম্পর্কে সম্যক জ্ঞানী হতে হবে। যাতে তারা কাদিয়ানীদের প্রকাশ্য কথা-বার্তা দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ধোকা না খায়; কারণ তারা প্রকাশ্যে শিরক থেকে মুক্ত থাকার অঙ্গিকার করে থাকে, কিন্তু প্রতিষ্ঠাতা নবুওয়াতের দাবীদারের সব গ্রন্থই শির্কে পরিপূর্ণ।
২. ফেরেশতার উপর ঈমান সম্পর্কে:
ফেরেশতা জগত সম্পর্কে ভণ্ড নবুওয়াতের দাবীদার গোলাম আহমদ কাদিয়ানীর আক্বীদা ও বিশ্বাস হলো ফেরেশতা ও আল্লাহ একই বস্তু। তাই সে তার আরবী গ্রন্থ (حمامة البشرى) তে ফেরেশতাদের সম্পর্কে বলছে: “এদেরকে আল্লাহ তার অঙ্গ প্রত্যঙ্গ রূপে তৈরী করেছেন”[11] এর থেকে বুঝলাম যে, সে ফেরেশতাদের অস্তিত্বই মানে না, বরং ফেরেশতা বলতে, আল্লাহর অঙ্গপ্রত্যঙ্গই বুঝে। মোটকথা: মুসলিমদের অবশ্যই তাদের এই বিশ্বাস সম্পর্কে জানতে হবে; আর জ্ঞানীদের জন্য ইঙ্গিতই যথেষ্ট
৩. ঐশী গ্রন্থ সমুহের উপর ঈমান আনা সম্পর্কে:
ভণ্ড কাদিয়ানী তার আরবী গ্রন্থ (الاستفتاء) তে বলছে, “আল্লাহ .... আমার সাথে কথা বলেছেন যেমন তার রাসূলদের সাথে বলেছেন। .... আর আমি এই কালেমাসমূহের সত্যতার বিশ্বাস রাখি যেমন আল্লাহর অন্যান্য কিতাবের উপর রাখি” পৃষ্টা নং : ২২, ৮৬ ফলে সে তার স্বহস্তে লিখিত বিভিন্ন ভাষার বিভিন্ন প্রবন্ধের সমষ্টি (تذكرة الوحي المقدس) বা ‘ঐশী বাণী স্মারক’ নামে যার নামকরণ করেছিল; সেটাকে আল্লাহর কাছ থেকে যথাযথ অবতীর্ণ অন্যান্য কিতাবাদীর সাথে তুলনা করেছে। এটা প্রমাণ করতে গিয়ে তার অনুসারীরা সূরা আল-বাকারার আয়াত:
﴿وَٱلَّذِينَ يُؤۡمِنُونَ بِمَآ أُنزِلَ إِلَيۡكَ وَمَآ أُنزِلَ مِن قَبۡلِكَ وَبِٱلۡأٓخِرَةِ هُمۡ يُوقِنُونَ ٤ [البقرة: 4]
এর মধ্যকার (ٱلۡأٓخِرَةِ) শব্দের বিকৃত অর্থ (Distortion) করে বুঝতে চায় যে, (আখেরাত)[12] দ্বারা কাদিয়ানীর নবুওয়াতের কথা বুঝানো হয়েছে; অবশ্য তারা কুরআন হাদীসের অর্থ বিকৃত করার কায়দা কানুন তাদের পুর্বসূরী কাদিয়ানীর কাছ থেকেই নিয়েছেফলে যদি তার স্বহস্তে লিখা বিভিন্ন ভাষায় রচিত রচনাবলীকে ঐশী বাণী বলতে হয়, তবে কুরআনকেও বলতে হয় যে, মানুষের রচনা বা মানবের লিখা।[13] আল্লাহর কালাম নয়। (নাউযুবিল্লাহ)
৪. রাসূলদের উপর ঈমান আনা সম্পর্কে:
মুসলিমদের বিশ্বাস হলো যে, নবীগণ পবিত্র নসল ও নসব থেকে নির্বাচিত হতে হয়ে থাকেন, সুতরাং তাদের নসব এ কোন প্রকার ব্যাভিচারের নাম গন্ধও নেই কিন্তু গোলাম আহমদ কাদিয়ানীর মতে নবীদের আসল নসব পবিত্র হতে হবে এমন কোন কথা নেই, বরং সে তার উর্দু বই (কিসতিয়ে নুহ) তে মরিয়াম (আ) সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বলছে, (সে তার গর্ভসহ বিবাহ বসতে বাধ্য হয়েছিল, কারণ তার স্বজাতীয় মুরব্বীরা তাকে বিবাহের জন্য পীড়াপীড়ি করছিল)[14] তারপর তার নবুওয়াতের দাবীর দ্বিতীয় পর্যাযে সে যখন নিজকে ঈসা (আ) এর অনুরূপ বা স্বদৃশ্য (Analogous) বলে বর্ণনা করত, তখন বলত “ঈশার সদৃশ ব্যক্তি ঈশা থেকেও উত্তম”[15] অতপর তার জীবনের তৃতীয় স্তরে যখন সে পূর্ণ নবুওয়াত দাবী করলো তখন সে স্পষ্টাক্ষরে নিজের নবুওয়াতের কথা বলতে নিরস্ত থেকে প্রথমে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর শানে না‘ত কসীদা লিখতে আরম্ভ করল, এ সমস্ত কসিদায় সে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর প্রশংসায় সীমালঙ্গন করতে লাগল। যেহেতু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দুই নাম ছিল, (মুহাম্মাদ, আহমাদ) সেহেতু সে এসব কসীদায় দ্বিতীয় নামটির ব্যবহার বেশী করে করতে লাগল; তবে এসব কিছুতে ধাঁধাঁ ও প্রহেলিকা এমন ব্যাপকহারে ব্যাবহার করতো যে, সে কি মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর প্রশংসা করছে নাকি আহমদ (নিজ নাম এর শেষাংশ) এর প্রশংসা করছে তা অনেকেই বুঝতে পারত না।  অতপর সে  সরাসরি আহমাদ দ্বারা নিজকে বুঝাবার এক চমৎকার পন্থা আবিস্কার করলো, এবং বললো “আমার এ জুব্বায় (পোষাকে) আল্লাহর নুর ছাড়া আর কিছুই নেই, আসহাবে সুফফা তোমার উপর দরুদ পাঠ করছে, আর মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সে মহীয়ানরূপে আত্মপ্রকাশ করেছে। কিন্তু আহমাদ সে আত্ম প্রকাশ করেছে, সম্মোহনীরূপ নিয়ে”[16] অনুরূপভাবে ধাঁধাঁর ব্যবহার সম্পন্ন হওয়ার পর এক সময় সরাসরি নবুওয়াতের দাবী করে বললো: “আমি যা কিছুই বলেছি, সেটা আমার রব এর পক্ষ থেকে যে আমার নিত্য সঙ্গী”[17] তার অনুসারীরা তার নবুওয়াতের দাবীকে চাঙ্গা করতে সূরা আল-জুমু‘আ এর আয়াত (২-৩)
﴿هُوَ ٱلَّذِي بَعَثَ فِي ٱلۡأُمِّيِّۧنَ رَسُولٗا مِّنۡهُمۡ يَتۡلُواْ عَلَيۡهِمۡ ءَايَٰتِهِۦ وَيُزَكِّيهِمۡ وَيُعَلِّمُهُمُ ٱلۡكِتَٰبَ وَٱلۡحِكۡمَةَ وَإِن كَانُواْ مِن قَبۡلُ لَفِي ضَلَٰلٖ مُّبِينٖ ٢ وَءَاخَرِينَ مِنۡهُمۡ لَمَّا يَلۡحَقُواْ بِهِمۡۚ وَهُوَ ٱلۡعَزِيزُ ٱلۡحَكِيمُ ٣﴾ْ [الجمعة: 2-3]
এর অনুবাদ করতে যেয়ে সম্পূর্ণ বিকৃত ভাবে (وَءَاخَرِينَ مِنۡهُمۡ لَمَّا يَلۡحَقُواْ بِهِمۡۚ) এর অনুবাদে এ কথা ঢোকালো যে, এর অর্থ হলো (রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দ্বিতীয়বার গোলাম আহমাদ এর রূপ নিয়ে আবার দুনিয়ায় আসবে।[18] এর চেয়ে বড় কুফরী আর কি হতে পারে?  যেখানে সে নিজকে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পূর্ণজম্মের রূপ বলে দাবী করছে? [19]  মুসলিমরা এ ব্যাপারে যতটুকু সাবধান হয়েছে?  এ পুনর্জন্মবাদের এ বিশ্বাস হিন্দুদের থেকে ধার করা বুলি মাত্র।
৫. আখেরাতের উপর ঈমান সম্পর্কে:
প্রত্যেক মুসলিমই এটা বিশ্বাস করে যে, পরকাল আছে; যেখানে পাপ পূণ্যের বিচার হবে এবং প্রত্যেকের কাজ অনুযায়ী সে প্রতিফল ভোগ করবে, কিন্তু গোলাম আহমদ কাদিয়ানী এ ব্যাপারে ভিন্ন মত পোষন করে, সে ১৮৯৩ সর্বপ্রথম ১৩১১ হি মোতাবেক কেয়ামতের যে সমস্ত আলামত রয়েছে:
১. সেগুলোকে অস্বীকার করে যেমন তার আরবী বই (حمامة البشرى) তে সূরা আ‘রাফ এর ১৮৭ নং আয়াত[20]
﴿يَسَۡٔلُونَكَ عَنِ ٱلسَّاعَةِ أَيَّانَ مُرۡسَىٰهَاۖ قُلۡ إِنَّمَا عِلۡمُهَا عِندَ رَبِّيۖ لَا يُجَلِّيهَا لِوَقۡتِهَآ إِلَّا هُوَۚ ثَقُلَتۡ فِي ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَٱلۡأَرۡضِۚ لَا تَأۡتِيكُمۡ إِلَّا بَغۡتَةٗۗ يَسَۡٔلُونَكَ كَأَنَّكَ حَفِيٌّ عَنۡهَاۖ قُلۡ إِنَّمَا عِلۡمُهَا عِندَ ٱللَّهِ وَلَٰكِنَّ أَكۡثَرَ ٱلنَّاسِ لَا يَعۡلَمُونَ ١٨٧ [سورة الأعراف: 187]
এর ব্যাখ্যা বিকৃত করতে গিয়ে শব্দটিকে (بَغۡتَةٗۗ) হিসাবে লিখে:[21] আয়াতের ভুল ব্যাখ্যায় গিয়ে বলে যে, (بغطة) শব্দটি দ্বারা প্রকাশ্যভাবে বুঝায় যে, কিয়ামতের যে সমস্ত আকাট্য প্রমাণ বা প্রকাশিত হবে বলে বলা হয়, তা কখনো অনুষ্ঠিত হবে না।[22]
এতো গেল তার প্রথম প্রদক্ষেপ, দ্বিতীয় স্তরে এসে ১৩১৮ হিজরী মোতাবেক ১৯০১ সালে সে সরাসরি পরকাল অস্বীকার করার জন্য প্রথমে শব্দের নম্বর হিসাব করে গানিতীয় কায়দায় বললো “আজকের দিনে কাল তার সর্বশেষ গুর্ণায়নে পৌঁছেছে, সূরা ফাতেহায় বর্ণিত ইহকাল এর নির্ধারিত সময় সাত হাজার চন্দ্র বছর এবং সূর্য্য বছর শেষ হতে চলেছে”[23] এ কথার ব্যাখ্যায় তার ছেলে মাহমুদ বলে: “পরকাল মৃত্যুর পরেই শুরু হয়ে থাকে, মৃত্যু সময় থেকে পৃথক করে হাজার বছর পরে নির্দিষ্ট সময়ে পরকাল বলতে কিছু নেই”[24]
মোট কথা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী যখন দাবী করল যে, সেই হলো প্রতিশ্রুত মসীহ,[25] তখন থেকেই সে তার এ দাবীর সমর্থনে বলতে আরম্ভ করল যে, তার আবির্ভাবের পরবর্তী সময়টাই হলো কিয়ামত, আর এ ব্যাপারে তার যুক্তি হলো যে, প্রতিটি শব্দের গোপন একটা নম্বর রয়েছে। সেই শুধুমাত্র তা জানে আর সে অনুসারে হিসাব নিকাশ করে সে সিদ্ধান্ত নিয়াছে যে, ইহকালীন বয়স যত হবার কথা তা শেষ হয়ে গেছে তার আবির্ভাবের সাথে সাথেই; সুতরাং তার আবির্ভাবের পরবর্তী জীবনটাকে পরকালীন জীবন হিসাবে মানতে হবে। এভাবেই সে তার সমস্ত প্রচেষ্টা ইয়াহূদী নাসারাদের কিয়ামত সম্পর্কিত বিশ্বাস এর সাথে সম্পৃক্ত করতে চাইলো, কিন্তু যখন তার মারা যাওয়ার পরও দুনিয়ার অস্তিত্ব রয়ে গেল, তখন তার অনুসারীরা সেই বিশ্বাসটাকে নতুন করে সাজাবার চেষ্টা করতে লাগল, কিন্তু হায়! তার সমস্ত পুস্তকাদী এব্যাপারে এত স্পষ্ট সাক্ষ্য প্রমাণবহ যে সেটা কোন ব্যাখ্যাই গ্রহণ করছে না।
৬. তাকদীর বা ভাগ্যের উপর ঈমান আনা সম্পর্কে:
গোলাম আহমাদ কাদিয়ানী  অন্যান্য পাচঁটি রুকন এর মত এখানেও ভ্রষ্ট  হয়েছে।
এ ব্যাপারে সে তার আরবী বই (الاستفتاء) তে বলছে যে, আল্লাহ নাকি তাকে প্রেমের ভান বা ছিনালি করে বলছে “হে আল্লাহর নবী! আমি তোমাকে চিনতে পেরেছিলাম না”[26] [না‘উযুবিল্লাহ]
 এতে করে সে বুঝাতে চাইলো যে, আল্লাহ তার সম্পর্কে অজ্ঞ ছিল, এ জন্যই অনেক দেরীতে তাকে নবুওয়াতের খবর দিয়েছে। [না‘উযুবিল্লাহ]
এ সব দাবীর পিছনে যে রহস্যটা কাজ করেছে সেটা হলো, সে যে বারবার তার অবস্থান পরিবর্তন করত; সেটাকে টিকিয়ে রাখার আপ্রাণ প্রচেষ্টা; কারণ সে কখনো নিজেকে বলতো প্রতিশ্রুত মসীহ, আবার কখনো বলতো: মাহদী, আবার ক্ষনিক পরেই বলতো, সে হলো মুজাদ্দিদ বা ধর্ম সংস্কারক, আবার কখনো বলতো, সে হলো নবী: আবার কখনো দাবী করতো যে, সে সমস্ত ধর্মের সংশোধনকারী। সে যখন দেখলো যে, তার বিভিন্ন অবস্থান লোকের মনে প্রশ্নের উদ্রেক করবে, তখন দাবী করলো যে,  আল্লাহ তাকে প্রথমে চিনতে ভুল করেছিল। [না‘উযুবিল্লাহ] অনুরূপভাবে পূর্ববর্তী বইতেই সে বলছে যে, আল্লাহ তাকে বলছে “কোন কিছু করার ইচ্ছা করলে তখন তোমার শুধুমাত্র হও বলতে হবে, তাতেই তা হয়ে যাবে”[27]  সে এটাকে তার গ্রহনীয় প্রার্থনা হিসাবে বর্ণনা করে তার আরবী বই তে বলছে “কখনো কখনো আল্লাহ তার অমোঘ ইচ্ছাকে ত্যাগ করে তার বান্দার প্রার্থনা শুনেন”[28]  যাতে বুঝা গেল যে, তার মতে আল্লাহর অমোঘ ইচ্ছা পরিবর্তনশীল, সুতরাং সে তাকদীরের উপর ঈমান রাখার প্রয়োজন মনে করে না। আমরা যদি তার এ বিশ্বাসের মূল খুজতে যাই তাহলে দেখতে পাবো যে, সে এ কথাগুলো মথি লিখিত সু সমাচার থেকে গ্রহণ করেছে, কারণ সেখানে ঈসা (আ) এর দিকে সম্পর্কিত করে বলা হয়েছে, তিনি নাকি তার সাথী পিটারকে বলেছেন “তুমি ধরাপৃষ্ঠে যা কিছু করবে তাই উর্ধ্বাকাশে গৃহিত হবে, আর ভূপৃষ্ঠে যাই সংগঠিত হবে,  উর্ধ্বাকাশেও তাই ঘটবে)[29]
সুতরাং যদি তার শিক্ষা ইসলামী ধর্মবিশ্বাস অনুযায়ী না হয়ে অন্যান্য বিভিন্ন মতবাদ থেকে নেয়া হয়ে থাকে বা মন গড়া কিছু কার্যকলাপকে ধর্মের রূপে রূপায়িত করার চেষ্টা করা হয়ে থাকে, তা হলে কিভাবে বলা যাবে যে, তার অনুসারীদেরকে মুসলিমরা অনাহুত নিন্দা করে? আর কিভাবেই বা তাদেরকে আমরা মুসলিম বলবো? সুতরাং তারা যেখানেই থাকুক অবশ্যই নিন্দনীয় ও ধিকৃত।
গ. তাদের রীতি নীতি
১. কালেমায়ে শাহাদাত (لا إله إلا الله محمد رسول الله) সম্পর্কে তাদের মতামত:
আগেই বলেছি ইবাদতের ক্ষেত্রে কাদিয়ানী নিজকে আল্লাহর সাথে ইবাদতের জন্য আহবান করেছে এবং নিজকে আল্লাহর প্রকাশ্য রূপ বলে দাবী করেছে।[30]
 অনুরূপভাবে অন্যস্থানে বলছে যে, “আল্লাহ নবীদের সাজে সজ্জিত হয়ে জগতে আগমন করেছেন” অর্থাৎ নবীরা পূজনীয় হবার ক্ষমতা রাখেন, অন্যস্থানে নিজকে মূসা (আ) এর সাথে তুলনা করে বলছে তার কাছে যে ওহী এসেছে তাতে আছে “তুমি উম্মতে মুহাম্মাদীয়ার জন্য মূসার মত”[31] অর্থাৎ মূসা যেমন নতুন শরীয়ত নিয়ে এসেছিল তুমি তেমনি নতুন শরীয়ত নিয়ে প্রেরিত অনুরূপভাবে তুমি অন্যান্য নবীদের মত বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। উপরোক্ত কথা দ্বারা ভণ্ড নবুওয়াতের দাবীদার নিজকে ইবাদত পাওয়ার যোগ্য বলে সাব্যস্ত করছে। অপরদিকে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পরিবর্তে তাকেই সমীহ ও সম্মানের অধিকারী মনে করার জন্য তার অনুসারীদের চেষ্টার কারণও উদঘাটিত হয়েছে। এ জন্যই সে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দুটো রূপ সাব্যস্ত করেছে, প্রথমরূপে আরবীয় মুহাম্মাদ আর দ্বিতীয় রূপে; অনারব আহমদ হিসাবে আবির্ভূত হয়েছে, আর এটা প্রমান করার জন্য সে বাস্তবকে অস্বীকার করতেই এমন অসার তর্কে যেতেও দ্বিধা করে নি। সুতরাং বুঝা যাচ্ছে যে, কাদিয়ানীরা (لا إله إلا الله) (আল্লাহ ছাড়া কোন সঠিক উপাস্য নেই) এটাকেই অস্বীকার করছে; (محمد رسول الله) বা মুহাম্মাদ আল্লাহর বাসূল বা প্রেরিত পুরুষ, এটার সাক্ষ্য তাদের কাছে পাওয়া তো অনেক দূরের কথাফলে তারা ইবাদতের জন্য যেমন গোলাম আহমাদ কাদিয়ানীর ব্যক্তিত্বকে; তেমনি নবুওয়াতের জন্যও তারই সত্বাকে কল্পনা করবে এটাই স্বাভাবিক।
২. নামাজ কায়েম করা সম্পর্কে তাদের মতামত:
ইসলামের এ বিশেষ নিদর্শনের ব্যাপারে গোলাম আহমাদ কাদিয়ানী যে সব প্রকাশ্য বিরোধিতায় লিপ্ত তা হলো:
 # তার মতে যারা মসজিদে থাকবে তাদের জন্য মুয়াজ্জিনের আজানের জওয়াব দেয়া মুস্তাহাব নয়।[32]
# আরবী জানা সত্বেও যে কোন ভাষায় নামাজ পড়লেই শুদ্ধ হবে।[33]
# মাহিলাদের উপর জুমা ওয়াজিব, জুমা ওয়াজিব হওয়ার জন্য দুইজন লোকই যথেষ্ঠ; এমনকি কোন লোক তার স্ত্রী ব্যতীত কাউকে না পেলে স্ত্রীকে সাথে নিয়ে জুমা পড়া তার উপর ওয়াজিব[34]
অনুরূপভাবে সে সুফীবাদে বিখ্যাত নিরবিচ্ছিন্ন অনবরত চল্লিশ দিনের নির্জন বাস বা বদ্ধ ঘরে একাকীত্বে থাকাকে মনে প্রাণে সমর্থন দেয়, এবং এটাকে বিরাট পূণ্যের কাজ বলে মনে করে”[35]
যদিও সে পরকালে বিশ্বাস করে না তবুও মানুষকে ধোকা দেবার নিমিত্তে সে তার বই (الوصية) তে তার অনুসারী যারা বেহেস্তি কবরস্থান (যা ‘কাদিয়ান’ নামক স্থানে অবস্থিত) সেখানে দাফন হবে তাদেরকে বেহেস্তের ওয়াদা প্রদান করেছে।[36] সুতরাং গোলাম আহমাদ কাদিয়ানী যদি তার অনুসারীদের জন্য আল্লাহ ও তার রাসূল মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর প্রদর্শিত পথের বাইরে নতুন নতুন নিয়ম কানুন জারী করে, তা হলে তাদেরকে নিন্দা করা কি প্রত্যেক মুমিনের জন্য ওয়াজিব নয়?  তাদের প্রকাশ্যরূপে মানুষ যাতে বিভ্রান্ত না হয় সে ব্যাপারে লোকদেরকে সাবধান করা কি জরুরী নয়?  প্রশ্ন হতে পারে : তারা তো, আমাদের মতই নামাজে হাত বেধে দাঁড়ায়, নিবিষ্ট মন নিয়ে নামাজ পড়ে। এমনকি সিজদায় যাবার সময় আগে হাত রেখে তারপর দুই হাটু স্থপন করে থাকেন।[37] আপনি বি বলতে চান তারা এটা তাদের মোনাফেকী?
 উত্তরে বলবো : হ্যাঁ নি:সন্দেহে এটা তাদের মোনাফেকী।  আল্লাহ তা‘আলা বলছেন:
﴿۞لَّيۡسَ ٱلۡبِرَّ أَن تُوَلُّواْ وُجُوهَكُمۡ قِبَلَ ٱلۡمَشۡرِقِ وَٱلۡمَغۡرِبِ وَلَٰكِنَّ ٱلۡبِرَّ مَنۡ ءَامَنَ بِٱللَّهِ وَٱلۡيَوۡمِ ٱلۡأٓخِرِ وَٱلۡمَلَٰٓئِكَةِ وَٱلۡكِتَٰبِ وَٱلنَّبِيِّۧنَ [البقرة: 177]
(মুখ পূর্ব পশ্চিম ফিরানোর মাঝে কোন সওয়াব নেই, সওয়াব হলো ঐ ব্যক্তির জন্য যে, ঈমান এনেছে আল্লাহ পরকাল, ফেরেস্তা, আল্লাহর কিতাবাদী এবং তার রাসূলদের প্রতি।)[38]
৩. যাকাত আদায় করা সম্পর্কে তাদের মতামত:
গোলাম আহমাদ কাদিয়ানী কুরআনের আয়াত দ্বারা প্রমাণিত যাকাতকে নিজের মনগড়া ভাবে ফরয করেছে। কারণ সে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর যে সমস্ত হাদীসে যাকাতের বিধান বর্ণিত হয়েছে সেগুলোকে অস্বীকার করেছে কারণ তার মতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদীসসমূহ কুরআনের বিরোধিত করছে। অনুরূপভাবে সে মনে করে যে, হাদীস লেখা হয়েছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মৃত্যুর অনেক যুগ পরে। সুতরাং তা গ্রহনযোগ্য হতে পারে না। উপরন্ত সে মুসলিমদেরকে এই বলে আক্রমন করে বসলো যে, “যারা হাদীসের ব্যাপারে গুরুত্ব দেয় তারা কুরআনের মর্যাদাহানি করে।”[39]
 এ জন্যই সে তার প্রথম ফতোয়াতেই এই বলে আহবান করেছে যে, “তার মতের বিপরিত যত সহীহ বা বিশুদ্ধ হাদীস আছে তা বাদ দিতে হবে।”[40] আর এজন্যই সে তার অনুসারীদের প্রত্যেক জীবিত লোকের উপর নির্দিষ্ট করে দিয়েছে যে, তারা তাদের আয় থেকে মাসিক ১/১৬ অংশ বা ১/১০ থেকে শুরু করে ১/৩ অংশ পর্যন্ত সবাইকেই আন্দেলনের বাক্স এ আন্দোলনের স্বার্থে জমা দিতে হবে।[41] অনুরূপভাবে সে তার অনুসারী প্রত্যেক মৃত্যু পথ যাত্রীর উপর ধার্য করেছে যে, যদি সে বেহেস্তি কবরস্থানের সৌভাগ্যে গৌরবাম্বিত হতে চায় তবে যেন তার পরিত্যক্ত সম্পত্তির ১/১০ অংশ আন্দোলনের স্বার্থে দান করে যায়।[42] তার এই নির্দেশ কাদিয়ানীদের উভয় গ্রুপ (কাদিয়ানী ও লাহোরী) এর মাঝে এখনো প্রচলিত রয়েছে। এ সমস্ত কিছুর ফলে তারা: একদিকে নির্দিষ্ট পরিমান দান মনগড়াভাবে নিজেদের উপর ধার্য করলো, শরীয়ত এর হুকুমকে অস্বীকার করলো; অপর দিকে খৃষ্টানদের মত বেহেস্তের কেনা বেচার চেক হস্তান্তরের ন্যায় বেহেস্তি কবরস্থান বিক্রি করার অভিনব পদ্ধতি চালু করল।
 একবার ইসলামে যাকাত বিধানের দিকে তাকানো যাক, দেখা যাবে সেখানে অত্যন্ত ইনসাফের সাথে তা গ্রহণ করা হয়ে থাকে, যেমন: যে সমস্ত ভূমিতে নিজ কষ্টে কৃষকরা ফসল ফলায় সেখানে ১/২০ অংশ, আর যেখানে কৃষকের কষ্ট ব্যতীত প্রাকৃতিক নিয়মে ফসল উৎপন্ন হয় সেখানে ১/১০ অংশ, বরং অন্যান্য সম্পদের উপর মাত্র ১/৪০ অংশ যাকাত ধার্য করা হয়েছে; যাতে ইনসাফ ও ন্যায়ের চরম উৎকর্ষতা ফুটে উঠেছে। এর সাথে গোলাম আহমদ কাদিয়ানীর মতামতের কি কোন তুলনা চলে?
৪. রমজানের রোজা সম্পর্কে তাদের মতামত:
গোলাম আহমদ কাদিয়ানীর মতে রমজানের রোজা ভাঙ্গা প্রত্যেক মুসাফির ও রোগীর উপর ওয়াজিব, চাই কি তার সফর দীর্ঘ হউক বা সংক্ষিপ্ত হোক, রোগ বেশী হোক আর কমই হউক সর্বাবস্থায়ই রোজা ভঙ্গ করা ওয়াজিব। অনুরূপভাবে যারা ই‘তিকাফে থাকবে তাদের জন্য যে কোন দুনিয়ার কথা বলতে নিষেধ নেই, যেমনি ভাবে তারা ইচ্ছা করলে রোগীর দেখা শুনার জন্য বাহির হতে পারে।[43]
ফরজ রোজার ব্যাপারে উদাসীনতা স্বত্বেও সে সুফীদের থেকে ধার করে অনবরত ৮ মাস পর্যন্ত (১৮৭৫-১৮৭৬) নফল রোজা রাখার পদ্ধতি আবিস্কার করে।[44] তার আরেক অনুসারী তার এ অন্তরীন থাকার ঘটনাকে ফলাও করে প্রচার করতে গিয়ে কিভাবে চল্লিশ দিন পর্যন্ত সুফীদের নির্জনবাসে অবস্থান করে ধন্য হয়েছে তা বিস্তারিত বর্ণনা করেছে।[45]  বরং সে এ শরিয়ত গর্হিত কাজকে অশেষ পূণ্যের কাজ মনে করে বসেছে, এবং বলছে যে, সে এই নির্জন বাসের দ্বারা অদৃশ্যের পর্দাকে ছিন্ন করতে সক্ষম হয়েছে।
আর এখান থেকে বের হবার পরই সে ১৮৭৬ সালে তার বানোয়াট বিভিন্ন ভাষার ভুলে পরিপূর্ণ বাক্যাবলীকে ওহী বলে দাবী করতে লাগল।[46] সুতরাং তার অবস্থা থেকে আমরা স্পষ্ট বুঝতে পারছি যে, সে শয়তানের মন্ত্রনাকে ওহী বলে চালাতে চেষ্টা করেছে। তা হলে প্রত্যেক মুসলিমকে তার শয়তানী থাবা থেকে সাবধান করা কি জরূরী নয়?
৫. হজ্জ সম্পর্কে তাদের মতামত:
কাদিয়ানীদের চতুর্থ খলিফা মীর্যা তাহের আহমদ তার এক জুম‘আর আরবী খোতবায় এই বলে দাবী করেছে যে, গোলাম আহমদ কাদিয়ানী আন্তরিক আকাংঙ্খা ছিল মক্কা মদীনায় কবরগুলিতে গিয়ে সেগুলির মাটি দ্বারা ধন্য হবে।[47] (তবে হজ্জ করবে এ জন্য নয়) হজ্জের জন্য তার আকাংখা প্রকাশ না পাওয়ার কারণ বর্ণনা করতে গিয়ে তার মুখপাত্র (মৌলবী সায়ফী কাদিয়ানী তার ইংরেজী বই (ملفوظات المسيح الموعود) এ বলছে (যার পড়শী ক্ষুধার্ত থাকবে, ফকির থাকবে, তার জন্য হজ্জ করা হারাম, বরং গরিবের প্রতি সমবেদনা এবং পড়শীর রক্ষনাবেক্ষনের দায়িত্বকে ইসলাম ফরয হজ্জের উপর স্থান দেয়।)[48] সুতরাং বুঝা যাচ্ছে সে হজ্জ না করার জন্য শস্তা একটা যুক্তি দাড় করাতে চেষ্টা করেছে। তবুও ১৩১১ হি: (মোতাবেক ১৮৯৩) সালে তার সাথীরা তাকে নিজে স্বয়ং হজ্জ পালন করতে বললে সে শস্তা দামের জবাব দিল (حتى يأذن الله)[49] অর্থাৎ তার উপর আল্লাহর পক্ষ থেকে হুকুম হয় নি। কিন্তু এতেও সে সন্তুষ্ট হতে না পেরে ১৩১৫ হি: মোতাবেক ১৮৯৭ সালের দিকে তার আরবী বই (الاستفتاء) তে প্রহেলিকা এবং ধাঁধাঁর মত কিছু কথা বলে হজ্জের স্থান পরিবর্তন করতে উদ্বুদ্ধ করলো; তাই সে বলছে:
 (আল্লাহ চায় তোমাদের গুনাহ ঝরে যাক তোমাদের জিঞ্জির খসে যাক এবং শুস্ক ভূমি থেকে শষ্য শ্যামল ভূমিতে তোমরা স্থানান্তরিত হও। কিন্তু তোমরা নিজদের দেহ কে পাপ পঙ্কিলে রাখতে সচেষ্ট, তোমাদের প্রিয় ভূমি থেকে দুরে থাকতে তোমরা সন্তুষ্ট, আমি তোমদেরকে প্রাচীন ঘরের দিকে ডাকছি, তোমরা সেখান থেকে মূর্তির দিকে ধাবিত হচ্ছো, কতক্ষন তোমরা এ বিড়ম্বনায় থাকবে? )[50]  এ সমস্ত ধাধা আর প্রহেলিকা দ্বারা উদ্দেশ্য হলো ‘কাদীয়ান’ নগরী, যেখানে মানুষ নামের জানোয়ারগুলো বাস করে। যেখানকার মুসলিমরা চতুস্পদ জন্তুর চেয়েও অধম, যেমন সে নিজেই তার অন্য বইতে তা লিখছে। (তিনি অর্থাৎ আল্লাহ হিন্দুস্তানের দিকে তাকিয়ে এ (কাদীয়ান)কেই একমাত্র খিলাফতের কেন্দ্রস্থল হিসাবে পেলেন।[51]  এ সব কারণে তার অনুসারীদের যারা তখনো হজ্জে আগ্রহী ছিল তাদেরকে এই শর্ত আরোপ করতো যে, “হজ্জের জন্য বাধা-বিপত্তি দূরীভূত হওয়া দরকার”[52] তা হচ্ছে না বিধায় হজ্জ করা যাবে নাতার চেয়েও স্পষ্ট ভাবে নিজের অবস্থান বর্ণনা করতে গিয়ে সে বলছে “নিশ্চয়ই আমিই হচ্ছি হাজরে আসওয়াদ বা কৃষ্ণ পাথর। যমিনের উপর আমাকে গ্রহণ যোগ্য করা হয়েছে আমার স্পর্শতায় সবার জন্য বরকত নিহিত।”[53] কিন্তু এ সমস্ত ইশারা ইঙ্গিতে তার অনুসারীরা নিরস্ত না হয়ে মক্কায় হজ্জ করার জন্য আগ্রহ দেখায়; অথচ তাদের নবী তার উর্দু বই (دافع البلاء)[54] তে বলছে, “আমি তাকে অবতীর্ণ করেছি কাদিয়ানের নিকটে” অনুরূপভাবে আরও স্পষ্টভাবে অন্য স্থানে বলছে “আর আল্লাহ তার কাদিয়ানের ঘরকে নি:শঙ্ক ভয়হীন হারামে পরিণত করেছেন .... অথচ এর আশে পাশে মানুষের উপর ছিনতাই হচ্ছে।[55]
প্রিয় পাঠক! কাদিয়ানীর এ সব প্রহেলিকা বাদ দিয়ে একবার কুরআনের বাণীর দিকে তাকান দেখবেন সেখানে কোন প্রহেলিকা বা ধাঁধাঁর ব্যাবস্থা করা হয়নি, যা বলা হয়েছে তা স্পষ্টভাবে মানুষের শান্তি ও মুক্তির জন্য বিবৃত করা হয়েছে। সূরা আল-বাকারাহ এর ১৯৬ নং আয়াতের দিকে তাকান, দেখবেন যেখানে বলা হয়েছে “তোমরা আল্লাহর জন্যই হজ্জ এবং উমরা পূর্ণ করে আদায় করো।”[56]
তাহলে কাদিয়ানীদের বিরোধিতার কারণ আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়েছে আমরা আরও দেখতে পাই গোলাম আহমাদ কাদিয়ানী স্পষ্টাক্ষরেই বলছে “আমি এ সবগুলিতে স্বাতন্ত্র বোধ করছি। সুতরাং তোমরা মাকামে ইবরাহীমকে নামাজের স্থান বানাও।”[57]এর উপর টীকা লিখতে গিয়ে সে লিখছে “আমাকে ইবরাহীম নামে নামকরণ করা হয়েছে। অনুরূপভাবে আমাকে আদম থেকে খাতেমুর রাসূল মুহাম্মাদ পর্যন্ত সমস্ত নবীর নামে নামকরণ করা হয়েছে।”[58]এসব কিছু বলার মূল উদ্দেশ্য কিন্তু একটাই; আর তা’ হলো, এ কথা বলা যে, হাজরে আসওয়াদ এবং তাকে ইবরাহীম নামকরণ করার কারণে মাকামে ইবরাহীমে যে দুই রাকাত নামাজ পড়তে হতো তা পড়তে হবে সে যেখানে অবস্থান করছে সেখানে অর্থাৎ কাদিয়ানে।তবে তারকথা (খাতেমুর রাসূল) দ্বারা সে বুঝাতে চাচ্ছে নবীদের মোহর বা আংটি; মুসলিমরা যা বিশ্বাস করে যে, (খাতেমুর রাসূল) অর্থ শেষ নবী এটা তার উদ্দেশ্য নয়। কারণ সে নবুওয়াতের অভিনব নতুন ব্যাখ্যা সংযোজন করেছে, তার মতে নবুওয়াত দ্বারা “আল্লাহ কর্তৃক অধিক আলাপ সম্ভাষন”[59] করাকেই বুঝায়।সুতরাং তার (খাতেমুর রাসূল) দ্বারা অর্থ নেয়, উৎকৃষ্ট নবী; যদিও আরবী ভাষায় এর অর্থ হলো শেষ নবী। কিন্তু তারা এ অর্থ করতে নারাজ; কারণ এতে করে তাদের প্রতিষ্ঠাতার নবুওয়াতের দাবী করাকে সম্পূর্ণ মিথ্যা বলতে হয়।সবশেষে আমার অনুরোধ আমরা যেন তাদের তৎপরতায় প্রতারিত না হই। আর এ জন্যই মুসলিম যুবকদেরকে তাদের প্রতিষ্ঠানে, হাসপাতালে এবং প্রচার প্রপাগান্ডা থেকে দুরে রাখার জন্য দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলি সাথে সাথে অনুরোধ করব আমরা যেন আমাদের প্রতিটি সমাজে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সুন্নাতের ব্যাপক প্রসার ঘটাই; কারণ যেখানেই সুন্নাতের ব্যাপক প্রসার হয়েছে সেখান থেকে এসব বাতিল মতবাদ তিরোহিত হয়েছে। পক্ষান্তরে যেখানেই মুসলিমরা সুন্নাতে রাসূল থেকে দুরে সরে এসেছে সেখানেই বাতিল দানা বেঁধে উঠেছে। কারণ কাদিয়ানী নিজেই তার নবুওয়াতের দাবীর উৎস হিসাবে ঐ অঞ্চলের মানুষের ব্যাপক অজ্ঞতাকে কাজে লাগানোর কথা বলেছে, এ ব্যাপারে সে তার বইতে বলছে “তুমি মুসলিম যুবকদের দেখবে যে তারা ইসলামী আচার অনুষ্ঠান ত্যাগ করেছে, সুন্নাত ত্যাগ করেছে, দাড়ী কামিয়েছে, মাটি পর্যন্ত কাপড় পরিধান করছে, মোচ লম্বা রাখছে, খৃষ্টানদের যাবতীয় রসম রেওয়াজ তাদের মন মগজ দখল করে আছে।”[60]
পরিশেষে সবাইকে এ, ফেৎনা থেকে মুক্ত থাকার জন্য আবারো অনুরোধ জানিয়ে শেষ করছি।
ওমা তাওফিকী ইল্লা বিল্লাহ




[1] . Ahmadiet Movement: Mirja Bashiruddin . p. 118
[2] . توضيح المرام  পৃ.৬৮-৬৯
[3] . সামুদ্রিক প্রাণী বিশেষ, যার আটটি শিং থাকে আর শরীর থাকে অত্যন্ত নরম।
[4] .প্রকাশ্যরূপ বলতে তার উদ্দেশ্য: সে আল্লাহর প্রকাশ্য রূপ হয়ে দুনিয়াতে আগমন করেছে।
[5] الاستفتاءপৃ. ৫, ২৮, ৮৮, ৮৯, ৯৪।
[6] . الاستفتاءপৃ.৪৬
[7] مواهب الرحمن পৃ.২৩
[8] . الاستفتاءপৃ: ৮১
[9] الاستفتاءপৃ: ৯১
[10] . الاستفتاءপৃ: ৯৫
[11] .  حمامة البشرى পৃ: ২২১
[12] বস্তুত: আখেরাত দ্বারা মৃত্যু পরবর্তী জীবনকেই বুঝানো হয়ে থাকে।
[13] .মূলত আখেরাত দ্বারা পরকাল বা হিসাব নিকাসের দিনকেই আরবীতে বুঝাতে হয়েছে।
[14] . কিসতিয়ে নূহ: পৃ: ২১
[15] . Our teaching- p.17
[16] . আল-ইসতেফতা: পৃ. ১৮. ৮৮. ৯৪
[17] . কসীদা-পৃ: ৬
[18] কুরআনের ইংরেজী অনুবাদ সূরা জুম‘আ দ্রষ্টব্য।
[19] আয়াতটির সরল অর্থ হলো:  আল্লাহ বলছেন: (তিনি আল্লাহ যিনি অশিক্ষিত লোকদের মাঝে তাদের থেকে একজনকে নবী বানিয়ে পাঠিয়েছেন যিনি তাদের কাছে তাঁর আয়াত পাঠ করবে কিতাব ও সুন্নাত শিক্ষা দিবে, যদিও তারা এর পূর্বে প্রকাশ্য ভ্রষ্টতায় ছিল। আর (তার দ্বারা আরও যারা দুনিয়াতে আসেনি (অর্থাৎ পরবর্তী প্রজন্ম) তারাও হেদায়াত প্রাপ্ত হবে। আর আল্লাহ হলেন প্রবল পরাক্রমশালী,  বিজ্ঞময়, এই তাফসীরটাই সাহাবায়ে কেরাম এবং সলফে সালেহীন এর সর্বসম্মত মত: এখানে কারো কোন দ্বিমত নেই, আর আরবী ভাষার অনুবাদেও এর বাহিরে কিছু বুঝায় না,
সুতরাং কাদীয়ানীদের অনুবাদের সাথে এর কোন মিল নেই। বরং তাদের অনুবাদ এর সাথে আয়াতের কোন সম্পর্কেই নেই।
[20] .আয়াতটির অর্থ নিম্নরূপ: আল্লাহ বলেন “তারা আপনাকে প্রশ্ন করছে কিয়ামত কখন হবে? বলুন, এর জ্ঞ্ন একমাত্র আমার রব এর কাছেই, তিনি ছাড়া অপরের কাছে তার সময় তিনি প্রকাশ করেননা, আকাশ ও জমীন এর জ্ঞান জানতে অপারগ হয়েছে, শুধু হঠাৎ করেই সেটা সংঘটিত হবে, তারা আপনাকে প্রশ্ন করছে,  যেন আপনি এর সম্পর্কে পূর্ণ জ্ঞান রাখেন, বলুন, এর জ্ঞান শুধু আল্লাহর কাছেই অথচ অনেক লোকই সেটা জানেনা। সূরা আরাফ-১৮৭ গোলাম আহমাদ কাদিয়ানী এ কিয়ামতের “হঠাৎ করে অনুষ্ঠিত হবার” কথা দ্বারা কিয়ামতের পূর্বে যে সমস্ত আলামত বের হবার ভবিষ্যদ্বাণী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম করে গেছেন, সেগুলিকে অস্বীকার করতে চেষ্টা করল।
[21] . যদিও আরবী ভাষায় এমন কোন শব্দ নেই।
[22] . (حمامة البشرى) পৃ: ২৮৩
[23] . إعجاز المسيح في تفسير أم الكتاب পৃ: ২৯
[24] . (الحركة الأحمدية), AHMADIATS. MOVEMENT.P.103.
[25] ইসা আলাইহিসসালাম এর অপর নাম, বা উপনাম, মুসলিমরা সবাই বিশ্বাস করেন যে, তিনি বায়তুল মোকাদ্দাস এর মিনারায় দাজ্জালকে হত্যা করার জন্য, আকাশ থেকে অবতরণ করবেন।
[26] . (الاستفتاء) পৃ: ৯৫
[27] .(الاستفتاء) পৃষ্ঠা : ৯৬
[28] . (سفينة نوح)পৃষ্টা: ২৪
[29] . মথি ১৬/১৯
[30] .( الاستفتاء) পৃ: ৯৪
[31] . (الاستفتاء) পৃ: ৮৯
[32] .(ملفوظات المسيح الموعود) সংগ্রহও গ্রন্থনা:  আহমাদীয়া জামাতের মুখপাত্র নুর মুহাম্মাদ নাসিম সায়েফী কাদীয়ানী পৃ: ১০, ফতোয়া নং ৪ দ্র:
[33] . (ملفوظات المسيح الموعود) পৃ: ১৩, অনুবাদ, ১৩,১৮, ২০, পৃ: ১৯ এর ২৩ অনুচ্ছেদ।
[34] . (ملفوظات المسيح الموعود) পৃ: ৩৫ =৫৭, ও পৃ: ৩৭ অনু: ৬২ ।
[35] . AHMADIATS. MOVEMENT.P.39.  الأحمدية ولادة جديدة للإسلام পৃ. ৩৫, ৩৬, (ইংরেজি সংস্করণ)
[36] . (الوصية) পৃ: ৫০, ইংরেজী সংস্করণ।
[37]  এটা সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত
[38] . সূরা বাকারা: আয়াত নং ১৭৭।
[39] .(حمامة البشرى ) পৃ: ১, ১১৬, ১৮৬।
[40] .(ملفوظات المسيح الموعود) পৃ: ৮, ফতোয়া নং ১,ইংরেজী সংস্করণ
[41] . (الحركة الأحمدية) মীর্যা বশিরুদ্দিন মাহমুদ পৃ: ১৩১ ইংরেজী সংস্করণ।
[42] . (الوصية) গোলাম আহমাদ কাদীয়ানী পৃ: ৪১,৫৫।
[43] . (ملفوظات المسيح الموعود، لمولوي صائفي القادياني) পৃ: ৪০, ফতোয়া নং ৬৯; ও পৃ: ৪২ ফতোয়া নং, ৭১ ও পৃ. ৪৩ ফতোয়া নং ৭২।
[44] . حضرة أحمد পৃ: ৫ (ইংরেজী সংস্করণ)
[45] .(الحركة الأحمدية) পৃ: ৩৫, (ইংরেজী সংস্করণ)
[46] .( الاستفتاء) পৃ: ৩০.৩১।
[47] (حب العرب إيمان) পৃষ্টা: ১৩৫
[48] (ملفوظات المسيح الموعود) পৃ: ৩৮, ফতোয়া ৬৪ (ইংরেজী সংস্করণ)
[49] (حمامة البشرى) পৃ: ১২
[50] (الاستفتاء) পৃ: ৪০-৪১
[51] . (الاستفتاء) ২৮, ১২
[52] . (تعليمنا) পৃ: ১৪ ইংরেজী সংস্করণ।
[53] .( الاستفتاء) পৃ: ৪৫
[54] . (دافع البلاء) পৃ: ১৬
[55] . (الاستفتاء) পৃ: ১৯
[56] . সূরা বাকারা আয়াত নং : ১৯৬
[57] . (الاستفتاء) পৃ: ৯১
[58] . (الاستفتاء) পৃ: ৯১ (টীকা দ্রষ্ঠব্য)
[59] (الاستفتاء) ১৮ (টীকা)।
[60] .(الاستفتاء) পৃ: ৩৪

ইসলামের দৃষ্টিতে বৃক্ষরোপণ ও সবুজ বনায়নের গুরুত্ব

ইসলামের দৃষ্টিতে বৃক্ষরোপণ ও সবুজ বনায়নের গুরুত্ব হাফেয মাওলানা মুফতি ওসমান আল-হুমাম উখিয়াভী সিনিয়র মুহাদ্দিস জামেয়া ইসলামিয়া বাইতুল ক...