সোমবার, ৯ মে, ২০১৬

ইসলামী রাজনীতির স্থপতি আল্লামা আতহার আলী


লাহোর প্রস্তাব

লেখক:মুফতি ওসমান আল-হুমাম 

মুহাদ্দিস. জামিয়া কুরআনিয়া দারুল উলূম ওসমানাবা রাজঘাটা চট্টগ্রাম।
ইসলামী রাজনীতির স্থপতি আল্লামা আতহার আলী রহ.


রাজনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ, সমাজ সংস্কারক আলেমেদীন, যোগ্য সংগঠক এবং এদেশের ইসলামী রাজনীতির মহান স্থপতি ও পথিকৃৎ আল্লামা আতহার আলী রহ.
হযরত আতহার আলী রহ. ১৮৯১ সনে মোতাবেক ১৩০৯ হিজরী সিলেটের বিয়ানীবাজার থানার গোঙ্গাদিয়া গ্রামের এক ধর্মপরায়ণ মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেনকথিত আছে, তার পূর্ব পুরুষগণ উত্তর ইরান থেকে প্রাচীন মুসলিম শাসকদের আমলে সিলেটে এসে বসবাস করেনতিনি নিজ এলাকাতেই প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা সমাপ্ত করার পর মুরাদাবাদের কাসেমিয়া মাদরাসায় ও রামপুর মাদরাসায় বিভিন্ন শাস্ত্রে জ্ঞান অর্জন করেনঅতঃপর সাহারানপুর ও পরে বিশ্ববিখ্যাত দারুল উলূম দেওবন্দে শিক্ষাগ্রহণ করেনতঁর উস্তাদদের মধ্যে ছিলেন আল্লামা আনওয়ার শাহ কাশ্মিরী, পাকিস্তানের অন্যতম প্রবক্তা মাওলানা শাব্বীর আহমাদ উসমানী ও জাফর আহমাদ উসমানীর মত প্রমুখ মনীষীগণশিক্ষা সমাপ্তির পর আতহার আলী রহ. উপমহাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ইসলামী সংস্কারক, আধ্যাত্মিক সাধক ও হাজারের অধিক গ্রন্থ প্রণেতা মাওলানা আশরাফ আলী থানবীর রহ. কাছে আধ্যাত্মিক প্রশিক্ষণ লাভ ও রূহানী তাযকিয়াহ তারাক্কি অর্জন করেন এবং তার থেকে খেলাফতপ্রাপ্ত হয়ে দেশে প্রত্যাবর্তন করেন
উস্তাদদের প্রতি যে তার কত গভীর শ্রদ্ধা ছিল, তাদের পবিত্র স্মৃতি নিজের অন্তরে জাগরুক রাখার জন্যে পুত্রের নাম আনোয়ার শাহ এবং দাদা পীর হাজী এমদাদুল্লাহ মহাজিরে মক্কীর রহ. নামে তার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নাম জামিয়া ইমদাদিয়া নামকরণ থেকেই তা সহজে অনুমেয়
দেশে ফিরে আল্লামা আতহার আলী ইসলামী শিক্ষা বিস্তারের কাজে আত্মনিয়োগ করেনতিনি সিলেট এবং কুমিল্লার জামিয়া মিল্লিয়া (বর্তমানে কাসেমুল উলূম) ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জামিয়া ইউনুসিয়াসহ একাধিক মাদরাসায় শিক্ষকতা করেনঅতঃপর কিশোরগঞ্জের একটি মাদরাসায় শিক্ষকতা ও পরে ঐতিহাসিক শহীদী মসজিদের ইমাম নিযুক্ত হন এবং একজন পীর হিসাবে ইসলামের যাবতীয় শিক্ষা আদর্শ প্রচার করতে থাকেনতখন তিনি ইসলামী আন্দোলন তথা রাজনীতির ফাউন্ডেশন বা প্রাথমিক স্তর বিনির্মাণে আত্মনিয়োগ করেন এবং মানুষকে এরশাদ ও নসীহতের মাধ্যমে ধর্মপরায়ণ করে তোলেন, জায়গায় জায়গায় মাদরাসা মক্তব স্থাপন করেনফলে তাকে কেন্দ্র করে কিশোরগঞ্জ এলাকায় একটি সুন্দর ইসালামী পরিবেশ গড়ে উঠেতার খ্যাতি বাইরের অন্যান্য জেলায়ও ছড়িয়ে পড়ে
আল্লামা আতহার আলীর শিক্ষাজীবন যেসব মহামনীষীর সংস্পর্শে অতিবাহিত হয়ে ছিল, তারা যেমন ছিলেন ইসলামী বিশেষজ্ঞ, উঁচু স্তরের পণ্ডিত ও জ্ঞানতাপস, তেমনি ছিলেন বিশ্ব পরিস্থিতির ব্যাপারেও সচেতন এবং ইংরেজবিরোধী আন্দোলনে ও রাজনীতিতে যাদের ছিল সক্রিয় পদচারণাতার উস্তাদদের মধ্যে শাব্বীর আহমাদ উসমানী, জাফর আহমাদ উসমানী, আনোয়ার শাহ কাশ্মিরী এবং আধ্যাত্মিক গুরু আশরাফ আলী থানবী রহ., যারা অবিভক্ত ভারতের আজাদী আন্দোলনের ত্যাগী ও সংগ্রামী সিপাহসালার ছিলেনফলে শিক্ষকদের প্রভাবে হযরত আতহার আলীর মধ্যেও স্বাভাবিকভাবেই ছাত্রজীবন থেকে রাজনৈতিক ভাবধারা ও সচেতনতার উন্মেষ ঘটেছিল
আর যেহেতু পরাধীন ভারত থেকে ইংরেজ উৎখাত আন্দোলন ও ইসলামী তাহযীব-তামাদ্দুন প্রতিষ্ঠার সংকল্প নিয়ে প্রতিষ্ঠিত দারুল উলূম দেওবন্দ, সেহেতু এর শিক্ষানবীশ পরিবেশটাও ছিল রাজনৈতিক ভাবধারায় আচ্ছন্নফলে সে পরিবেশে অধ্যয়নের সুবাধে তখন থেকে তার মধ্যেও রাজনৈতিক চিন্তা-চেতনার উম্মেষ ঘটেতার এই চিন্তা-চেতনা ও সচেতনতা উত্তরকালে দেশ, জাতি ও ধর্মের মহান কল্যাণ সাধনে রাজনৈতিক অঙ্গনে টেনে আনেবস্তুত তার রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতা নিজের শিক্ষা পরিবেশ ও তৎকালীন রাজনৈতিক পারিপার্শিকতা থেকে উদগত
বৃটিশবিরোধী আজাদী আন্দোলন যখনই গতি সম্পন্ন হচ্ছিল, ভারতের জনগণ তখনই দুটি শিবিরে বিভক্ত হয়ে পড়ছিল। (ক) মুসলিম দল (খ) হিন্দু দলঅর্থাৎ খণ্ড ভারত আর অখণ্ড ভারতের দুটি দলেহিন্দুরা চেয়েছিল ইংরেজরা যেভাবে প্রায় দুইশত বছর মুসলমানদের শোষণ ও নির্যাতন চালিয়েছে, ভারতকে অখণ্ড রেখে মুসলমানদের স্বকীয়তা ও স্বাতন্ত্র্য বিনাশ করে ঠিক সেভাবে আজীবন তাদের শোষণ ও নির্যাতনের বন্দবস্ত করাএতে ইংরেজদেরও সায় ছিলকিন্তু ইউরোপীয় ও মঙ্গলীয় আর্যদের এই নীলনকশায় বাঁধ সেধে বসে ছিল আপামর সচেতন মুসলিম জনগণআর প্রত্যক্ষ নেতৃত্বে ছিলেন কায়েদে আযম মোহাম্মাদ আলী জিন্নাহ, মাওলানা শাব্বীর আহমাদ উসমানী, শেরে বাংলা এ.কে ফজলুল হক, মাওলানা জাফর আহমাদ উসমানী, আল্লামা আযাদ সোবহানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, আল্লামা আতহার আলী ও মাওলানা সৈয়দ মোসলেহ উদ্দীন প্রমুখ রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গযে ভাবনার দার্শনিক ও আধ্যাত্মিক উদ্যোক্তা ছিলেন হাকীমুল উম্মত আশরাফ আলী থানবী রহ. ও আল্লামা ইকবাল রহ.
আতহার আলী রহ. ১৯৪৫ সনে বঙ্গীয় ওলামা-মাশায়েখদেরকে নিয়ে নিখিল ভারতীয় ওলামা কনফারেন্সের আয়োজন করেন২৫ মে কলিকাতা মোহাম্মাদ আলী পার্কে আল্লামা আযাদ সোবহানীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মহাসম্মেলনে মাওলানা শাববীর আহমাদ উসামানীকে প্রধান করে জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম গঠিত হয়এই ঐতিহাসিক মহাসম্মেলন আয়োজনে আরো যেসব বঙ্গীয় ওলামায়েকেরামের অনবদ্য অবদান রয়েছে, তারা হলেন মাওলানা নেসার উদ্দীন আহমাদ (পীর সাহেব শর্ষীনা), মাওলানা সৈয়দ মুসলেহ উদ্দীন, মুফতী দ্বীন মুহাম্মাদ খাঁ ও মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরী রহ.
অতঃপর আল্লামা আতহার আলী পৃথক মুসলিম আবাসভূমি তথা পাকিস্তান কায়েমের লক্ষ্যে সমগ্র ভারতবর্ষ চষে বেড়ান ও প্রধান প্রধান শহরসমূহে সভা-সম্মেলনের আয়োজন করেন, বক্তৃতা দিয়ে পাকিস্তানের পক্ষে জনমত গড়ে তোলেন এবং মুসলমানদের মাঝে ঐক্যের প্রাচীর তৈরি করেনতিনি মুসলিম লীগের ঐতিহাসিক সিমলা কনফারেন্স ও বাংলার প্রতিনিধিত্বকারী নেতৃবৃন্দের অন্যতম ছিলেনযাদের মধ্যে ছিলেন শেরে বাংলা এ.কে ফজলুল হক, মাওলানা আকরম খাঁ, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, খাজা নাজিমুদ্দীন ও তাজুদ্দীন খান প্রমুখ নেতৃবৃন্দ
উল্লেখ্য, ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবে শেরে বাংলা এ.কে ফজলুক হক কর্তৃক পঠিত প্রস্তাব প্রণয়নে তার অবদান ছিল সিংহভাগএবং তা তিনি করেছিলেন মুর্শিদ মাওলানা আশরাফ আলী থানবীর রহ. বিশেষ ইঙ্গিতেলাহোর প্রস্তাব ঘোষণার ঐতিহাসিক সেই ছবিতে শেরে বাংলার পাশেই আল্লামা আতহার আলী ছিলেন
লাহোর প্রস্তাবে অংশগ্রহণকারী নেতৃবর্গ
আর সিলেট রেফারন্ডমে যারপর নাই ভূমিকার স্বীকৃতি স্বরূপ সিলেট আজ বাংলাদেশের অংশযেহেতু সিলেট তার জন্মভূমিতাই সিলেট পাকিস্তানের অন্তর্ভূক্ত হবে না! বিষয়টি স্বভাবতই তার পক্ষে মেনে নেয়া ছিল দুস্করতাই তিনি উত্তর প্রদেশের পাশাপাশি সিলেট রেফারন্ডমে পাকিস্তানের পক্ষে ভূমিকা পালন করেনতাতে তার অন্যতম সহযোগী ছিলেন মাওলানা সৈয়দ মুসলেহ উদ্দীন রহ. এবং তাতে পাকিস্তানের পক্ষে সকল আলেম, রাজনীতিবিদগণ ও সমাজ সচেতন নাগরিকবৃন্দ বিশেষ ভূমিকা রাখেন
অবশেষে বহু প্রত্যাশিত সেই দিবসটি আসলজীবনের সর্বক্ষেত্রে ইসলাম কায়েমের প্রতিশ্রুতি নিয়ে ১৪ আগস্ট ৪৭ সালে কায়েম হল পাকিস্তানপূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে একইসঙ্গে স্বাধীন পতাকা উত্তোলন করলে পাকিস্তান আন্দোলনে দুই অগ্রসৈনিক সিপাহসালার আল্লামা আতহার আলীর দুই উস্তাদ মাওলানা শাব্বীর আহমাদ উসমানী ও মাওলানা জাফর আহমাদ উসমানী
সৃষ্টি হলো ইতিহাসশুরু হলো নতুন দিনের যাত্রাকিন্তু শুরুতেই হোঁচট, বিতর্কইংরেজ বেনিয়াদের মানসিক উত্তরসূরি আমলা ও ওজির-ওজারাদের বিপত্তির কারণে কায়েদে আযম মোহাম্মাদ আলী জিন্নাহ প্রতিশ্রুত ইসলামী নেজাম কায়েমে হলেন ব্যর্থইতোমধ্যে সাধারণ জনগণের চাপে এবং মাওলানা শাব্বীর আহমাদ উসমানীর বলিষ্ট নেতৃত্বের কাছে পরাজিত হয় মুসলিম লীগ অনীহা সত্ত্বেও ১৯৪৯ সনে ইসলামী হুকুমাত কায়েমের লক্ষ্যে একটি আদর্শ প্রস্তাব গ্রহণে বাধ্য হয়কিন্তু এরইমাঝে মোহাম্মাদ আলী জিন্নাহ ও আল্লামা শাব্বীর আহমাদ উসমানী দুইজনেই ইন্তেকাল করায় মুসলিম লীগে ঘাপটি মেরে থাকা ইসলামবিরোধী মহলটি মাথাচাড়া দিয়ে উঠে এবং ইসলামী নেজাম কায়েমের লক্ষ্যে আদর্শ প্রস্তাবের পরবর্তী ধাপ হয়ে বাধাগ্রস্তজাতি আবার পতিত হয় হতাশার তিমিরেপাকিস্তান আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী বেশিরভাগ আলেমই মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন এবং রাজনীতিতে নিরুৎসাহিত হয়ে যার যার কর্মক্ষেত্র মসজিদ, মাদরাসা ও খানকায়ে নির্দিষ্ট হয়ে পড়েনএমতাবস্থায় আতহার আলী রহ. ইসলাম কায়েমের মহান ব্রত নিয়ে নিজ উস্তাদের অসামাপ্ত কাজকে আঞ্জাম দেয়ার লক্ষ্যে ভারতবর্ষে সুলতান শিহাবুদ্দীন ঘুরির ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। (দ্বিতীয় ও শেষ কিস্তি পরের বার)
লেখক:  


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

ইসলামের দৃষ্টিতে বৃক্ষরোপণ ও সবুজ বনায়নের গুরুত্ব

ইসলামের দৃষ্টিতে বৃক্ষরোপণ ও সবুজ বনায়নের গুরুত্ব হাফেয মাওলানা মুফতি ওসমান আল-হুমাম উখিয়াভী সিনিয়র মুহাদ্দিস জামেয়া ইসলামিয়া বাইতুল ক...